ছাত্রলীগকর্মী রোহিত হত্যার নেপথ্যে কী?
চট্টগ্রাম মহানগরের দেওয়ানবাজারে ছাত্রলীগকর্মী আশিকুর রহমান রোহিত হত্যাকাণ্ডের ‘মোটিভ’ নিয়ে সংশ্লিষ্ট থানা, ঊর্ধ্বতন পর্যায় এবং হত্যার শিকার রোহিতের বক্তব্য থেকে ভিন্ন ভিন্ন মত পাওয়া গেছে। থানা পুলিশ ঘটনাটিকে ‘আধিপত্য নিয়ে বিরোধের জের’ বললেও নগর পুলিশের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মাদক ব্যবসার বিরোধিতা করায় ছাত্রলীগকর্মী রোহিতকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।
আবার হামলায় গুরুতর আহত হয়ে মৃত্যুর আগে রোহিতের একটি বক্তব্য মোবাইলে ধারণ করা হয়। যেখানে তিনি বলে যান, তার বড় ভাই নাজিমকে এই ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী মোহাম্মদ মহিউদ্দিন (২৯) গুলি করার হুমকি দিয়েছিলেন। সে ঘটনার পর মহিউদ্দিনকে গ্রেফতারে পুলিশকে সহায়তা করায় সাইফুল ইসলাম বাবু (২০), সাহাবুদ্দিন ওরফে বাবু ও আকবর তাকে ছুরিকাঘাত করেছেন।
এদিকে রোহিত হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী চিহ্নিত সন্ত্রাসী মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ওরফে ‘দাঁড়ি মহিউদ্দিন’ ও হামলাকারী সাইফুল ইসলাম বাবুকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এ বিষয়ে সোমবার (১৮ জানুয়ারি) দুপুর ১টার দিকে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) উপ-কমিশনারের (দক্ষিণ) কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলন শুরুর আগে বাকলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন স্বাক্ষরিত একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয় সাংবাদিকদের। ওই বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, এলাকায় ইট-বালুর ব্যবসা ও ক্লাবের (মা-মনি ক্লাব) নিয়ন্ত্রণ নিতে আশিকুর রহমান রোহিতকে পূর্বপরিকল্পনার অংশ হিসেবে হত্যা করা হয়েছে।
গ্রেফতার দুই আসামি হলেন- মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ওরফে দাঁড়ি মহিউদ্দিন ও সাইফুল ইসলাম বাবু । এদের দুইজনকে গতকাল রোববার (১৭ জানুয়ারি) ঢাকার মুগদা ও মিরপুর থেকে গ্রেফতার করা হয়।
প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, চকবাজার থানাধীন ডিসি রোড চাঁনমিয়া মুন্সি লেইন এলাকাভিত্তিক ইট-বালুর ব্যবসা, ক্লাবভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে পূর্বপরিকল্পনার অংশ হিসেবে ছাত্রলীগকর্মী আশিকুর রহমান রোহিত হত্যা করা হয়। ঘটনার পরপরই মূল পরিকল্পনাকারী মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ওরফে দাঁড়ি মহিউদ্দিন তার মুখের দাঁড়ি ফেলে দিয়ে এবং অপর দুই আসামি সাইফুল ইসলাম বাবু ও সাহাবুদ্দিন ওরফে সাবু নিজেদের বেশভূষা পরিবর্তন করে ভারতে পালানোর উদ্দেশে ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। পুলিশ গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে মহিউদ্দিনকে মুগদা ও সাইফুল ইসলাম বাবুকে মিরপুর থেকে গ্রেফতার করে।
রোহিত হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী চিহ্নিত সন্ত্রাসী মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ওরফে ‘দাঁড়ি মহিউদ্দিন’ ও হামলাকারী সাইফুল ইসলাম বাবু পুলিশের জালে
‘আশিকুর রহমান রোহিত ঘটনার দিন বিকেল ৪টা ৩০ মিনিটের দিকে “বাজার আনার” উদ্দেশে রওনা করলে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী সাইফুল ইসলাম বাবু ও সাহাবুদ্দিন ওরফে বাবু কৌশলে রোহিতের সঙ্গে মোটরসাইকেলে ওঠেন। রোহিত মোটরসাইকেল চালিয়ে বাকলিয়া থানাধীন দেওয়ানবাজার ভরা পুকুর পাড় সংলগ্ন কেডিএস গলির ভেতর নির্মাণাধীন একটি বিল্ডিংয়ের সামনে পৌঁছে দেখেন, সেখানে মহিউদ্দিন দাঁড়িয়ে আছেন। পরে মোটরসাইকেলে থাকা সাবু ও বাবু তাদের কোমর থেকে ধারালো ছোরা বের করে রোহিতের কোমরে, পেটে ও পিঠে উপর্যুপরি আঘাত করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।’
তবে পরে সংবাদ সম্মেলনে সিএমপির উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) এসএম মেহেদী হাসান বলেন, ‘চকবাজার থানাধীন ডিসি রোডের মা-মনি ক্লাবের সক্রিয় সদস্য ছিলেন আশিকুর রহমান রোহিত। এ ক্লাবের সদস্যরা এলাকায় মাদকবিরোধী সচেতনতা তৈরির কাজে জড়িত। তারা সবসময় বিশেষ করে মাদক ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতেন। এ ঘটনাগুলোকে কেন্দ্র করে ওই এলাকার কিছু সংক্ষুব্ধ লোক (যারা মাদকের ব্যবসা করে বা সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত থাকতে চায়) ও দুষ্ট প্রকৃতির লোকজন পরিকল্পনা করে রোহিতকে হত্যা করার জন্য।’
‘পরিকল্পনামাফিক গত ৮ তারিখে তারা (হামলাকারীরা) বিকেলবেলার কোনো এক সময় কোনো এক জায়গায় গমনাগমন পথে তাকে (রোহিতকে) প্রতিরোধ করে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে। পুলিশ তাকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ট্রিটমেন্টের জন্য নিয়ে যায় এবং এই রোহিত গত ১৫ তারিখ সকালবেলা মৃত্যুবরণ করেন’— বলেন এসএম মেহেদী হাসান।
তবে মৃত্যুর আগে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ধারণ করা রোহিতের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। যেখানে রোহিতকে বলতে শোনা যায়, ঘটনার দিন বিকেলে তিনি বাজার করতে নয়, বরং আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরীর গণসংযোগ থেকে ফিরছিলেন। এ সময় দেওয়ানবাজার ভরা পুকুর পাড় সংলগ্ন কেডিএস গলিতে সাইফুল ইসলাম বাবু, সাহাবুদ্দিন ওরফে সাবু ও আকবর তাকে ছুরিকাঘাত করেন। এর আগে তার বড় ভাই নাজিমকে এই ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী মহিউদ্দিন গুলি করার হুমকি দিয়েছিলেন। ওই ঘটনায় পুলিশকে সহায়তা করায় তাকে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে।
ওই ভিডিওতে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় রোহিত বলেন, ‘কেডিএস গলির ভেতর দিয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে যাওয়ার সময় দুই দিক থেকে দৌড়ে এসে আমাকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে বাবু, সাবু ও আকবর।’
কী কারণে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে জানতে চাইলে রোহিত তখন বলেন, ‘আমার বড় ভাই নাজিমকে মহিউদ্দিন গুলি করার হুমকি দিয়েছিলেন। সে ঘটনায় তাকে ধরতে পুলিশকে সহায়তা করায় আমাকে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে।’
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন সিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) এসএম মেহেদী হাসান
এক ঘটনায় নিহত ব্যক্তির বয়ান ও পুলিশের কর্মকর্তাদের ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে চট্টগ্রামের সচেতন মহলে। অনেকের আশঙ্কা, হত্যাকাণ্ডের মত বড় ঘটনার ‘মোটিভ’ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য এলে তা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ন্যায়বিচার পেতে বিড়ম্বনায় ফেলবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই ঘটনায় নিহত ব্যক্তির বয়ানকে পুলিশ কেন গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছে না, তা খতিয়ে দেখা উচিত।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাকলিয়া থানার ওসি মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘মাদক ও ইট-বালু নিয়ে বিরোধ, দুই কারণেই এই ঘটনা ঘটেছে। ঘটনার মূল কারণ জানতে আসামিদের রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে। এরপর এ বিষয়ে বলা যাবে।’
উপ-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) এসএম মেহেদী হাসান বলেন, ‘প্রেস বিজ্ঞপ্তিটি এ ঘটনায় দায়ের মামলার এজহারমূলে করা হয়েছে। আর নিহত ব্যক্তির বক্তব্যের ভিডিও ফুটেজ আমরা দেখেছি, বিষয়টি তদন্তে আমলে নেয়া হবে।’
তবে চট্টগ্রাম সনাক-টিআইবির সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘তদন্তাধীন মামলা নিয়ে মন্তব্য করাটা একেবারেই উচিত নয়। তাই কেউ যদি কথা বলেন, দায়িত্ব ও জবাবদিহিতার জায়গা থেকে বলা উচিত। আমরা দেখি যে আইন মানার দায় যাদের বেশি, তারাই এখন কম মানছেন।’
চট্টগ্রাম বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মো. আইয়ুব খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘কেন এই ঘটনা ঘটেছে এটি তদন্তাধীন বিষয়। এটি নির্ধারণ করবেন মামলার আইও (তদন্ত কর্মকর্তা) সাহেব। এমনকি তদন্ত কর্মকর্তারও এই পর্যায়ে মামলা নিয়ে কোনো ধরনের মন্তব্য করার সুযোগ নেই। ভিকটিমের বক্তব্য মামলার গুরুত্বপূর্ণ আলামত; এটিকে গুরুত্ব দেয়া তদন্ত কর্মকর্তার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।’
আবু আজাদ/এইচএ/জেআইএম