আর্থিক ক্ষতি পোষাতে বিশ্বকাপ-এশিয়া কাপের দিকে তাকিয়ে বিসিবি
এমনিতেই জনজীবন স্থবির। যত সময় গড়াচ্ছে, করোনা পরিস্থিতি তত জটিল হচ্ছে। এরকম অবস্থা চলমান থাকলে এবারের প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগ আদৌ হবে কি না? তা নিয়েই রয়েছে সংশয়। আর লিগ একদমই না হলে জাতীয় দলের ক্রিকেটার ও বিসিবির সাথে চুক্তিভুক্ত ক্রিকেটাররা ছাড়া বাকিদের ওপর নেমে আসবে চরম অর্থনৈতিক সংকট।
কারণ এই প্রিমিয়ার লিগই তাদের আয় রোজগারের একমাত্র মাধ্যম। এই লিগ খেলে গড়পড়তা অনেকেই ৫-৭ থেকে লাখ দশেক টাকা পান। তা দিয়েই নিজে ও পরিবারের ভরনপোষণ করেন। লিগ না হলে তারা নিদারুণ অর্থ কষ্টে পড়ে যাবেন। তাদের বছরের পুরো সময় পার করাই হবে মুশকিল। জাগো নিউজের পাঠকরা সে সম্পর্কে আগেই ধারণা পেয়েছেন, প্রিমিয়ার লিগ আদৌ না হলে কী হবে? তা নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
এখন দেখার বিষয় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের কী অবস্থা? সবরকম ক্রিকেটীয় কর্মকান্ড বন্ধ। হোম সিরিজ নেই। দেশের বাইরে গিয়ে কোথাও খেলার সুযোগ ও সম্ভাবনা নেই। এরই মধ্যে দুইটি সিরিজ স্থগিত হয়ে গেছে। এপ্রিলে পাকিস্তান আর মে মাসে আয়ারল্যান্ড-ইংল্যান্ড সফর ছিল, সেটাও বন্ধ।
চারদিকের এরকম স্থবির অবস্থায় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের কী অবস্থা হবে? একটা ধাক্কা নিশ্চয়ই বিসিবির গায়ে এসে লগবে। বিসিবির সামনেও হয়ত আর্থিক ক্ষতির হুমকি থাকবে। যদি সত্যিই আর্থিক ক্ষতির শঙ্কা থাকে, তাহলে সেটা কী পরিমাণ? ঐ ঘাটতি পুষিয়ে নেয়ার পর্যাপ্ত সামর্থ্য কি বোর্ডের আছে?
যদিও কদিন আগে বোর্ডের প্রধান নির্বাহী নিজামউদ্দিন চৌধুরী সুজন জাগো নিউজকে আশ্বস্ত করে জানিয়েছেন, এখনই তেমন আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনা কম। বোর্ডের আয়ের যে সব বড় বড় খাত ও উৎস আছে, তার কোনটাই এখনও ক্ষতিগ্রস্ত বা বন্ধ হয়নি। এটা একটা বড় স্বস্তি এবং আগামী কয়েক মাসেও এমন কোন ক্ষেত্র নেই, যা না হলে ব্যাপক ক্ষতি হয়ে যাবে।
তবে বিসিবি সিইও নিজামউদ্দীন চৌধুরী সুজন এও বলেছিলেন, এ অবস্থা বেশি দিন চললে ভিন্ন কথা। তখন তো একটা ধাক্কা এসে লাগবেই। এখন সেই ধাক্কা কত ব্যাপক ও বড় হতে পারে? বোর্ডে এ প্রশ্নের উত্তর যার সবচেয়ে ভাল জানার কথা, সেই অর্থ কমিটির চেয়ারম্যান ইসমাইল হায়দার মল্লিক অবশ্য এখনই খুব চিন্তিত নন।
তার ভাবটা এমন, হ্যাঁ করোনার একটা নেতিবাচক প্রভাব তো পড়বেই। তবে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনা কম। আজ (সোমবার) দুপুর গড়ানোর আগে জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপে ইসমাইল হায়দার মল্লিক বলেন, ‘আশা করছি ওরকম লস হবে না। জার্সি স্পন্সর, গ্রাউন্ডস রাইটস, টিভি রাইট- এগুলোর মূল্য তো কিছু কমবেই। সেটা আমার হিসেবে ২০-২৫ শতাংশ হতে পারে। টাকার অংকে হয়তো ৩০-৪০ কোটি টাকার মত হতে পারে। আমাদের ফান্ডে হয়তো অতিরিক্ত কোন টাকা গচ্ছিত থাকবে না। তবে আমাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনায় আশা করি সমস্যা হবে না। আমাদের বোর্ডের সব কার্যক্রম আশা করি স্বাভাবিকভাবে চলবে। তবে কিছু টাকা তো কমবেই।’
মল্লিক আরও বোঝানোর চেষ্টা করেন, বিসিবির নিজস্ব আয়ের যে সব উৎস বা ক্ষেত্র আছে, করোনার প্রভাব তো তাদের ওপরও পড়বে। তাই বিভিন্ন স্পন্সর খাত থেকে আয় যাবে কমে।
তাই মল্লিকের মুখে এমন কথা, ‘আমাদের যারা স্পন্সর আছে তারাও তো ভাল নেই। তারা নিশ্চয় শতভাগ দিতে চাইবে না। দেয়ার অবস্থাও হয়তো থাকবে না। তাই ধরে নিতে হবে কিছু কম দেবে। আমাদের জার্সি স্পন্সর স্বত্ত্ব বিক্রি হয়নি এখনও। এই করোনা সংক্রমণের কারণেই করা সম্ভব হয়নি। জার্সি স্পন্সর থেকে যে মূল্যটা পাই, করোনার প্রভাবে তা নিশ্চয়ই কমবে। গ্রাউন্ডস স্বত্ত্ব থেকে যা পাই মানে যে সব স্পন্সরশিপ বিক্রি হয়ে গেছে, সেখান থেকেও তো কম পাওয়া যাবে। কারণ ঐ স্বত্ত্ব যারা কিনেছে, তাদের ওপরও তো করোনার প্রভাব আছে। তারাও তো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এখন তারা দেয়ার সময় নিশ্চয়ই কিছু পরিমাণ কম দিতে চাইবে বা কম দেবে।’
তাহলে করোনার প্রভাবে বিসিবির অর্থনৈতিক অবস্থা কি দাড়াতে পারে? জবাবে মল্লিকের ব্যাখ্যা, ‘আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যত অবস্থা কী হতে পারে?- তা নির্ণয় করার জন্য আমরা বসেছিলাম। তাতে আমাদের পর্যালোচনায় বেরিয়ে এসেছে, ২০-২৫ শতাংশ কম আয় হবে।’
জাগো নিউজকে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের বোর্ডের মোট আয়ের মূল উৎস আসলে দুইটি। একটি আমরা মানে বিসিবি জেনারেট করি। বিভিন্ন স্পন্সর, রাইটস বিক্রি, ঘরোয়া সিরিজ আয়োজন থেকে আসে। আর বাকি ৫০ ভাগের উৎস হলো আইসিসি ও এসিসি। বিশ্ব ক্রিকেটের অভিভাবক সংস্থা আর এশিয়ান ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থা থেকেও মেলে বিভিন্ন অনুদান। এর বাইরে মহাদেশীয় ও বিশ্ব আসরে অংশ নেয়া এবং আনুষঙ্গিক সাহায্য ও সহযোগিতা থেকেও একটা বড়সড় অংক আসে।’
মল্লিক বোঝানোর চেষ্টা করেন, বিসিবির নিজের আয় ২০-২৫ শতাংশ কমলেও আইসিসি ও এসিসির আয়ের উৎস তো আর বন্ধ হয়নি। তার ভাষায়, ‘আইসিসি আর এসিসির কোন ইভেন্ট তো বাতিল হয়নি। দুটিই আছে।’
আইসিসি আর এসিসির খাত বলতে বিসিবি অর্থ কমিটির চেয়ারম্যান আসলে এশিয়া কাপ ও বিশ্ব টি-টোয়েন্টি আসরের কথা বুঝিয়েছেন। তার সরল ব্যাখ্যা, ‘ধরেন ঐ দুই আসরে অংশগ্রহণের একটা আয় থাকে। এর বাইরেও আনুষঙ্গিক অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধা থাকে। এখন যদি সেই দুই ইভেন্ট হয় তাহলে তো আমরা কিছু রেভিনিউ পাবোই। হয়তো কিছু কমবে। কমলেও আমাদের জন্য অত ভয়ের কিছু দেখি না।’
কেন ভয়ের কিছু দেখেন না? মল্লিকের আস্থাপূর্ণ উচ্চারণ, ‘আমাদের একটা উদ্ধৃত তহবিল আছে। নাজমুল হাসান পাপন বোর্ডের দায়িত্ব নেয়ার পর যেটা হয়েছে। এতে করে বোর্ডের অন্যরকম একটা অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা চলে এসেছে। আমার স্থির বিশ্বাস, ঐটা দিয়ে আমরা ৪-৫ বছরের সমস্যা সমাধান করতে পারবো, ক্ষতি পুষিয়ে চলতে পারবো। তবে আমার ধারণা এক-দেড় বছরের মধ্যেই পরিস্থিতি ঘুরে যাবে। সেটা ঘুরে গেলে আমাদের জন্য বিশেষ সমস্যা হবে না। তবে প্রাথমিকভাবে কিছু ধাক্কা আসবেই, ২০-২৫ শতাংশ রেভিনিউ কমে যাবে।’
উল্লেখ্য, আগামী সেপ্টেম্বরে এশিয়া কাপ। আর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ অক্টোবর-নভেম্বরে। এখন করোনা পরিস্থিতি ভাল হয়ে গেলে হয়তো ঐ দুই আসর মাঠে গড়াতে পারে। সেক্ষেত্রে বিসিবির মোট আয়ের যে অর্ধেক খাত আছে, সেখান থেকে যা পাওয়ার কথা- তা যদি ২০ ভাগ কমও মেলে, তারপরও মোটামুটি ভাল অর্থই আসবে। কিন্তু করোনার প্রভাবে ঐ দুই আসর না হলে বিসিবির আয়ের দুইটি বড় ক্ষেত্র যাবে বন্ধ হয়ে। মানে একটা বড় ধাক্কা লাগবে এবং সেক্ষেত্রে বিসিবির সম্ভাব্য আয়ের ৫০ শতাংশ যাবে কমে।
এখন দেখার বিষয় এশিয়া কাপ আর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ হয় কি না? হলে খানিক কম মিললেও সম্ভাব্য আয়ের অন্তত ৭৫-৮০ ভাগ ঠিকই চলে আসবে। আর না হলেই চিন্তা। তখন মোট ক্ষতির পরিমাণ ২০-২৫ শতাংশ অর্থাৎ ৩০-৪০ কোটি টাকা থাকবে না। বেড়ে দ্বিগুণ তথা ৬০-৭০ কোটি টাকা হয়ে যাবে।
এআরবি/এসএএস/জেআইএম