সাহিত্য

স্মারক বক্তৃতায় সেই ‌‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’

‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’ নামে বই লিখেছিলেন আনিসুজ্জামান। ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত সেই বই আজ কালজয়ী বইয়ের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। প্রকাশের ষাট বছর পরেও সেই গবেষণাগ্রন্থ নিয়ে আলোচনা হলো লেখকের স্মরণায়োজনে।

গত ১৪ মে ছিল প্রয়াত বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ষষ্ঠ প্রয়াণ দিবস। সে উপলক্ষে তাকে স্মরণ করে শুক্রবার (১৬ মে) ধানমন্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়ে স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করে সাহিত্য সাময়িকী ‘কালি ও কলম’। এতে ‘উনিশ শতকের মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’ শীর্ষক বক্তব্য উপস্থাপন করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক, প্রাবন্ধিক-গবেষক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম।

মোহাম্মদ আজম বলেন, বর্তমানময়তার জন্য উনিশ শতক একমাত্র না হলেও খুবই জরুরি বর্গ। যে ধরনের আধুনিকায়নের পথ ধরে বাংলাদেশের জনসমাজের গরিষ্ঠাংশ, অর্থাৎ মুসলমান সমাজের বিকাশ ঘটেছে, এবং আজতক যে ধরনের জীবনদৃষ্টি ও ইতিহাসবোধ বর্তমানকে সবচেয়ে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, তার অধিকাংশ মূল-ধারণা কাঠামোপ্রাপ্ত হয়েছিল উনিশ শতকেই। ঠিক এ ধরনের একটা প্রয়োজনবোধের প্রকাশ হিসাবে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এ সময়ের মুসলমান সমাজ ও বাংলা সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করেছিলেন।

আনিসুজ্জামানের বইটির কথা উল্লেখ করে মোহাম্মদ আজম বলেন, এটি একাডেমিক গবেষণার সংশ্লিষ্ট এলাকায় দেশে ও বিদেশে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি উদ্ধৃত গ্রন্থ। কয়েক দশক পরে প্রকাশিত গ্রন্থটির এক নতুন মুদ্রণে লেখক জানিয়েছেন, বইটিতে প্রকাশিত মতামত ও বিশ্লেষণ তখনো বিশেষ পরিবর্তন করার দরকার তিনি বোধ করেননি। এই যে কয়েক দশক ধরে তিনি নিজের মতে নিষ্ঠ থাকতে পেরেছেন, আর অন্য ব্যবহারকারীরাও এ বয়ানে সম্মতি দিয়ে গেছেন, তা একদিকে বইটির শক্তিমত্তার পরিচায়ক, অন্যদিকে পরিবর্তিত তথ্য-উপাত্ত এবং দৃষ্টিভঙ্গি অঙ্গীভূত না করা দু-তরফেই কিছু সীমাবদ্ধতাও নির্দেশ করে।'

মোহাম্মদ আজম বলেন, ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’ গ্রন্থটি গবেষক আনিসুজ্জামানের তথ্যনিষ্ঠার চমৎকার নিদর্শন। তার সাথে যুক্ত হয়েছে সাহিত্যপাঠের কায়দা-কানুন ও দক্ষতা। গবেষকের বস্তুনিষ্ঠ মনও এ বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। আনিসুজ্জামান গবেষণার সীমা নির্ধারণ ও তদনুযায়ী গোছগাছের জন্য সুখ্যাত। এ বইয়ে সে খ্যাতির উল্লেখযোগ্য অভিব্যক্তি ঘটেছে। এ সবগুলো বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন ঘটেছে গ্রন্থটির গদ্যরীতি আর উপস্থাপনভঙ্গিতে। ফলে বইটি সুখপাঠ্য হয়েছে।’

ইতিহাস-পাঠে ‘সত্যমূলকতা’ তুলনামূলক গৌণ ব্যাপার। কারণ, ইতিহাসে বস্তুত বর্তমানকেই পাঠ করা হয়। আনিসুজ্জামান তার কালের প্রগতিশীল ও প্রয়োজনীয় ভাবধারা হিসেবে জাতীয়তাবাদ অবলম্বন করেই বয়ান নির্মাণ করেছেন। সেকালের পটভূমিতে জরুরি প্রয়োজন মেটানোর জন্য উত্তম বিবরণী হাজির করাই ছিল তার লক্ষ্য। সেজন্য তিনি পর্যাপ্ত প্রশংসাও পেয়েছেন। বক্তব্যে একথা উল্লেখ করে মোহাম্মদ আজম বলেন, কিন্তু জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির নিজস্ব সীমাবদ্ধতা রয়েছে। উদারনৈতিক অবস্থান, আধুনিকতাবাদ এবং প্রগতিশীলতাও বিশেষ স্থান-কালের বাস্তবতা দ্বারাই চালিত হয়। এর প্রত্যেকটি বর্গের সাধারণ সীমাবদ্ধতা এই যে, সুবিধাপ্রাপ্ত তুলনামূলক শিক্ষিত-নাগরিক জনগোষ্ঠীর ভিত্তিতেই এ বর্গগুলো কাজ করে থাকে।

ড. আনিসুজ্জামানের জন্ম ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৭ সালে, কলকাতায়। কর্মজীবনে তিনি ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন। পরবর্তীকালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং সর্বশেষ জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া দেশ-বিদেশে বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন তিনি। অবদান ও কাজের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশ সরকার তাকে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পদক প্রদান করেছে। এছাড়া তিনি একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ বিভিন্ন সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। ভারত সরকার তাকে পদ্মভূষণ পদক দিয়ে সম্মানিত করেছে। তিনি আনন্দ পুরস্কার, জগত্তারিণী পদকসহ বিভিন্ন বিদেশি সম্মাননা ও পদক লাভ করেন। এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে তার অর্ধশতাধিক গ্রন্থ। তিনি অসংখ্য বই সম্পাদনাও করেছেন।

অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণ করেন কালি ও কলম সম্পাদক সুব্রত বড়ুয়া। তিনি বলেন, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ছিলেন প্রতিষ্ঠানলগ্ন থেকে কালি ও কলমের সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি। তার অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও মানুষ হিসেবে তার প্রিয়তা আমরা উপলব্ধি করি। গবেষক ও শিক্ষক হিসেবে শুধু নয়, মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন অনন্য। তার এই শূন্যতা কখনো পূরণ হতে দেখতে পাবো বলে মনে হয় না।

এর আগে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে নিয়ে নির্মিত একটি তথ্যচিত্র বড় পর্দায় দেখানো হয়। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী। সুধীজনদের পাশাপাশি এ আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন আনিসুজ্জামানের পরিবারের সদস্যরাও।

আরএমডি/এসআর