কখনো কি শুনেছেন যে, আপনার শরীরের হাড়ও ক্ষুধার্ত হয়ে যেতে পারে? একটু অবাক করা হলেও, চিকিৎসাবিজ্ঞানে এমনই এক বাস্তব সমস্যা আছে – এর নাম হাংগ্রি বোন সিনড্রোম।
এটি এমন একটি শারীরিক জটিলতা, যা সাধারণত থাইরয়েড বা প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থির অস্ত্রোপচারের পর দেখা দেয়। এই অবস্থায় শরীরের হাড় যেন হঠাৎ ক্যালসিয়ামের জন্য ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ে এবং রক্ত থেকে অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম শুষে নেয়। ফলে মাথা ঘোরা, হাত-পা ঝনঝন করার মতো লক্ষণ দেখা দেয়, এমনকি খিঁচুনিও হতে পারে। এটি একধরনের হাইপোক্যালসেমিয়া, অর্থাৎ রক্তে ক্যালসিয়াম কমে যাওয়া।
বাংলাদেশে অহরহ থাইরয়েড সংক্রান্ত অস্ত্রোপচার হচ্ছে, অথচ এই জটিলতা সম্পর্কে অনেকেই জানেন না। তাই সময় থাকতে সাবধান হওয়া জরুরি। হাংগ্রি বোন সিনড্রোম চিনে প্রয়োজনমতো ব্যবস্থা নিন।
এটা যাদের হতে পারে-
>> যেসব রোগীর প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থি অতিরিক্ত হরমোন তৈরি করছিল এবং পরে সেটি কেটে ফেলা হয়েছে, অর্থাৎ হাইপারপ্যারাথাইরয়েডিজম।
>> ডায়ালাইসিস করা রোগী যারা সেকেন্ডারি হাইপারপ্যারাথাইরয়েডিজমে আক্রান্ত।
>> অ্যাডভান্স প্রোস্টেট ক্যানসার যাদের হাড়ে ছড়িয়ে গেছে।
সবারই কি অপারেশনের পরে এটি হয়?
প্রাথমিক প্যারাথাইরয়েড অপারেশনের পরে প্রায় চার থেকে ১৩ শতাংশ ক্ষেত্রে এই সমস্যা দেখা যায়। তৃতীয় পর্যায়ের হাইপারপ্যারাথাইরয়েডিজম অপারেশনের পরে এই হার বেড়ে ২০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।
বাংলাদেশে থাইরয়েড বা প্যারাথাইরয়েড অপারেশন অনেক রোগীরই করতে হয়, তাই এই সমস্যা অপরিচিত হলেও গুরুত্বপূর্ণ।
হাড় কেন ক্ষুধার্ত হয়ে যায়?
প্যারাথাইরয়েড হরমোন বা পিটিএইচ আমাদের শরীরে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে। যখন প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থি অতিরিক্ত কাজ করে, তখন শরীরে রক্তে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বেড়ে যায়। কিন্তু অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে এই গ্রন্থি কেটে ফেলা হলে পিটিএইচ হঠাৎ করে কমে যায়। তখন হাড়গুলো হঠাৎ করে অনেক ক্যালসিয়াম শুষে নেয়। ফলে রক্তে ক্যালসিয়াম কমে যায় এবং দেখা দেয় হাংগ্রি বোন সিনড্রোম।
লক্ষণ:
>> হাত-পা, ঠোঁট বা মুখে ঝনঝন অনুভব হওয়া।
>> পেশিতে টান বা খিঁচুনি।
>> মাথা ঘোরা, ক্লান্তি।
>> মনোযোগে সমস্যা, মাথা কাজ না করা।
>> হাড়ে ব্যথা বা দুর্বলতা।
>> খুব খারাপ অবস্থায় চেতনা হারানো, খিঁচুনি, বা শ্বাসকষ্ট।
এসব লক্ষণ সাধারণত অপারেশনের ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শুরু হয়। যদি রক্তে ক্যালসিয়ামের মাত্রা ৮.৪ মি.গ্রা./ডেসি.লি-এর নিচে নেমে যায় এবং ৪ দিন বা তার বেশি সময় স্থায়ী থাকে, তাহলে সন্দেহ করা হয় এইচবিএস হয়েছে।
চিকিৎসা এইচবিএস-এর চিকিৎসা মূলত রক্তে ক্যালসিয়ামের মাত্রা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা। যেসব উপায়ে চিকিৎসকরা তা করে থাকেন-
>> শিরায় ক্যালসিয়াম ইনজেকশন দেওয়া।
>> মুখে খাওয়ার ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট।
>> ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট।
>> প্রয়োজনে ম্যাগনেসিয়াম ও ফসফরাস-এর ঘাটতি পূরণ করা হয়।
এই চিকিৎসা চলতে পারে কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত।
চিকিৎসার ফলাফল
ভালো খবর হলো যথাযথ চিকিৎসা পেলে রোগীরা সম্পূর্ণ সেরে উঠেন। তবে চিকিৎসা না করালে হাংগ্রি বোন সিনড্রোম থেকে জটিল হাইপোক্যালসেমিয়া, এমনকি খিঁচুনি বা হৃদযন্ত্রের সমস্যা পর্যন্ত হতে পারে।
প্রতিরোধের উপায়
অপারেশনের আগে ও পরে কিছু সতর্কতা নিলে এই সমস্যা এড়ানো সম্ভব-
>> অপারেশনের আগে রক্তে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ভিটামিন ডি পরীক্ষা করে ভারসাম্য আনা
>> ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের আগেই ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি দিয়ে প্রস্তুত করা
>> অপারেশনের পরে নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ।
>> লক্ষণ দেখলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।
>> প্রয়োজনে কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই বোন মিনারেল ডেনসিটি স্ক্যান করা।
বাংলাদেশে প্যারাথাইরয়েড ও থাইরয়েড অস্ত্রোপচার খুব সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু অনেক সময় রোগীরা অপারেশনের পরে হঠাৎ দুর্বলতা, খিঁচুনি বা ঝনঝন অনুভব করলে সেটিকে গুরুত্ব দেন না।
এই উপসর্গগুলো অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। বিশেষ করে যারা কিডনি রোগী, দীর্ঘদিন ডায়ালাইসিসে আছেন, বা বড় থাইরয়েড অপারেশন করেছেন, তাদের ঝুঁকি বেশি।
তাই আপনি যদি থাইরয়েড বা প্যারাথাইরয়েড অপারেশনের পরে উপরের লক্ষণগুলো খেয়াল করেন, তবে দেরি না করে আপনার চিকিৎসককে জানান।
তথ্যসূত্র: ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক
এএমপি/জিকেএস