সোশ্যাল মিডিয়া

ফিনল্যান্ডে আর থাকতে চাই না কেন?

আজ আপনাদের বলবো, আমি কেন আর ফিনল্যান্ডে থাকতে চাই না বা আগের মতো আর এখানে মজা পাই না কেন। আসলে ফেসবুকে সব সময় সুন্দর সুন্দর গল্প করা হয় কিন্তু বাস্তবিক গল্প আমরা কমই করি। ১৯ বছরে কখনো মনের মতো কোনো চাকরি পাইনি। শারীরিক পরিশ্রম ছাড়া ফিনল্যান্ডে বিদেশিদের জন্য কোনো ভালো জবের ব্যবস্থা নেই।

ফিনল্যান্ড—পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দেশ, সবচেয়ে নিরাপদ দেশ, সবচেয়ে মানবিক সমাজব্যবস্থা; যেখানে মানুষের জন্য সব ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কোথাও যদি রাষ্ট্রের আদর্শ মডেল বলতে হয়, তাহলে হয়তো এই ছোট্ট নর্ডিক দেশটির নামই প্রথম মনে পড়ে। আমি সেই সৌভাগ্যবানদের একজন, যে দীর্ঘ ১৯ বছর ফিনল্যান্ডের মাটিতে বসবাস করেছি। এই সময়টায় ফিনিশ সরকারের কল্যাণে পেয়েছি নিখরচায় চিকিৎসা, শিক্ষাগত সহায়তা, খাদ্য ও নিরাপত্তা—একটি সুশৃঙ্খল রাষ্ট্রের সমস্ত যত্ন ও দায়িত্ব।

তারপরও আর ফিনল্যান্ডে থাকতে চাই না। এটা কেবল একটি আবেগের বহিঃপ্রকাশ নয়। এটি একটি দীর্ঘ অভিজ্ঞতার, তীব্র বোধের ও অন্তর থেকে জাগা সিদ্ধান্তের ফল। হয়তো অনেকেই প্রশ্ন তুলবেন, যেখানে এত সুবিধা, এত সুযোগ, সেখানে কেন কেউ থাকতে চাইবে না? তাই আজ আমি সেই গল্পটাই করবো—একটি শীতল স্বর্গের গাঢ় একাকিত্বের গল্প, একটি উন্নত সমাজের ভেতরে আটকে থাকা মানুষের ক্ষয়ে যাওয়া সত্তার গল্প।

প্রথমেই বলি, ফিনল্যান্ড সত্যিই একটি অসাধারণ দেশ—সেখানে কোনো নিরাপত্তাহীনতা নেই, চিকিৎসা ব্যবস্থা দুর্দান্ত, সরকার মানুষের জন্য প্রকৃত অর্থে কাজ করে। বিদেশি একজন স্টুডেন্ট হয়ে আমি যে সম্মান, সেবা আর সহানুভূতি পেয়েছি, তা পৃথিবীর খুব কম দেশেই সম্ভব।

কিন্তু এখানকার আলো ঝলমলে কাঠামোর নিচে চাপা পড়ে থাকে এমন কিছু যন্ত্রণা, যা একজন বিদেশির হৃদয়ে প্রতি রাতে অন্ধকারের মতো জেঁকে বসে। সেই অন্ধকারের নাম—ভাষার প্রতিবন্ধকতা, আবহাওয়ার শীতলতা, কর্মসংস্থানের সীমাবদ্ধতা এবং একঘেয়েমির চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত।

শুধু ক্লিনিং, পিৎজা, কিংবা ট্যাক্সি—কেন বেছে নেওয়ার বিকল্প নেই? আপনি যদি একজন বিদেশি হন, তাহলে ফিনল্যান্ডে কাজের পরিসর কয়েকটি খুব নির্দিষ্ট গণ্ডিতে আটকে থাকে। আপনি হয়তো এক বা একাধিক কাজ করতে পারেন: ১. ক্লিনিং ২. কোনো পিৎজা দোকানে কাজ ৩. ট্যাক্সি ড্রাইভিং ৪. কোনো শপে ক্যাশিয়ারের দায়িত্ব ৫. অন্যের রেস্টুরেন্টে বুয়ার মতো খাটা।চেয়ার-টেবিলে বসে অফিসের কাজ করা? না, সেটি এখানে ‘হ্যালির ধূমকেতু’র মতো একটি বিরল সৌভাগ্য। যতই অভিজ্ঞতা থাকুক, যতই ডিগ্রি থাকুক। একটি প্রতিষ্ঠানে সম্মানজনক, সৃজনশীল, মেধার কাজে প্রবেশ করা একজন বিদেশির জন্য একরকম স্বপ্নমাত্র।

আমি নিজে জীবনের বিভিন্ন সময়ে এসব কাজ করেছি—ক্লিনিং করেছি, পিৎজা বানিয়েছি, দোকানে দাঁড়িয়ে দিন পার করেছি। আমি অবহেলার চোখে এসব কাজকে দেখি না—এ কাজগুলোই আমাকে বাঁচিয়েছে, জীবন দিয়েছে। কিন্তু এখন, ১৯ বছর পর আমি বুঝি, এ কাজগুলো আমার সত্তাকে আর তৃপ্তি দিতে পারে না। এখন আর টানে না। একেবারেই না।

আরও পড়ুন গোপাল সাঁওতালের জন্য মানবিক আবেদন ভাড়া করা ড্রেস ও একটি প্রেজেন্টেশন

অনেকেই বলবেন—‘আপনি তো এতদিন এসব কাজ করে এসেছেন, এখন কেন ভালো লাগছে না?’ আমি বলব—মানুষের মন পরিবর্তন হয়, চাহিদা ও উপলব্ধির ধরন বদলায়। আমি ইউরোপেই শিখেছি, যেখানে একজন ডাক্তার ট্যাক্সি চালাচ্ছে শুধু তার ভালো লাগার জন্য, কেউ শিক্ষকতা ছেড়ে গেছেন খামারে ফসল ফলাতে, কেউ বডি-ম্যাসাজ শেখার জন্য জীবন বদলেছেন। এ পরিবর্তনের স্বাধীনতা তো মানুষের মৌলিক অধিকার, তাই না?

তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি—আমি এখন আর এ কাজগুলো করবো না। গত একবছর আমি পুরোপুরি কাজ ছেড়ে দিয়েছি এবং ভবিষ্যতেও এ রুটিনভিত্তিক, শরীর-কাঁপানো কাজগুলোর দিকে আর ফিরেও তাকাবো না। পৃথিবীর গরম কোনো দেশে নতুন করে সেটেল হওয়ার স্বপ্ন দেখি। আমার সবচাইতে ফেভারিটের তালিকায় আছে আর্জেন্টিনা, কিউবা, নেপাল, পর্তুগাল, বাংলাদেশ, যেখানেই যাই না কেন, আর শীত প্রধান দেশে যেতে চাই না।

আমি এমন একজন মানুষ, যিনি ঘুরতে ভালোবাসেন, যিনি গল্প ভালোবাসেন, যিনি অন্যের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পছন্দ করেন, যিনি হৃদয়ে রং মেখে বাঁচেন। এরকম মানুষ ফিনল্যান্ডে খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। এখানে জীবনের গতি এতটাই ব্যক্তিকেন্দ্রিক, এতটাই নীরব ও একলা—যেখানে মানসিক ঘনিষ্ঠতা, কল্পনার বিস্তার কিংবা হঠাৎ আড্ডা দেওয়ার সংস্কৃতি প্রায় নেই বললেই চলে।

বাংলাদেশ কিংবা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে আমি এসব মানুষ খুঁজে পাই—যারা আমার মতো করে ভাবে, স্বপ্ন দেখে, কথা বলে, বাঁচে। আমি এমন মানুষদের খুঁজি যারা আমার ভাষায় কথা বলে, আমার চিন্তার গভীরতা বোঝে। কিন্তু এখানে ভাষা হয়ে দাঁড়ায় সবচেয়ে বড় দেওয়াল। ফিনিশ ভাষা না জানলে আপনি সারাজীবন এক প্রকার ‘অতিথি’ হয়ে থাকবেন—স্থায়ী নাগরিকত্ব পেলেও মন থেকে আপন হবেন না।

হ্যাঁ, ফিনল্যান্ডের শিক্ষা, চিকিৎসা, নিরাপত্তা—সবকিছুই পৃথিবীর মধ্যে সেরা। কিন্তু দিনশেষে আমরা কেবল নিরাপদ জীবন চাই না, আমরা চাই আনন্দ, মানুষের সংস্পর্শ, নিজের মতো করে বাঁচার স্বাধীনতা।

প্রতিদিন লম্বা শীত, ঘণ্টার পর ঘণ্টা অন্ধকার, একঘেয়েমি, ঠান্ডা আবহাওয়া—এ জীবন একটা সময়ের পর মনে হয় কোনো মেশিনের মতো জীবন। যেখানে গন্ধ নেই, রং নেই, হাসি নেই। তখন এ নিরাপত্তাও আর নিরাপত্তা মনে হয় না বরং মনে হয়—একটা সুন্দর খাঁচা, যেখানে আমি বন্দি।

এ সমস্ত অভিজ্ঞতার আলোকে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি—আমি ফিনল্যান্ডে হয়তো মাঝে মাঝে আসবো, হয়তো কিছুদিন থাকবো, কিন্তু এখানেই সারাজীবন থেকে যাওয়ার ইচ্ছা আর নেই। আমি এমন জায়গায় থাকতে চাই, যেখানে জীবন শুধুই উন্নয়ন নয়, জীবনের মাঝে মানবিকতা, রং, আড্ডা, ভাষা ও ভালোবাসা থাকবে।

আমার জীবনের শেষ অধ্যায়টা আমি কাটাতে চাই সেভাবে; যেভাবে আমি চাই—Not by survival, but by meaningful living। তারপরও বলবো, ফিনল্যান্ডকে আমি সবচাইতে বেশি ভালোবাসি, খুব বেশি ভালোবাসি।

এসইউ/এএসএম