সাহিত্য

কবি সুকান্তের সংক্ষিপ্ত অথচ অনন্ত জীবন

এম এম উজ্জ্বল

বাংলা সাহিত্যে কিশোর কবি হিসেবে পরিচিত কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ১৯২৬ সালের ১৫ আগস্ট কলকাতায় নানা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁদের পৈতৃক বাড়ি ছিল ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার কোটালীপাড়ায়। সুকান্ত তাঁর বাবা নিবারণচন্দ্র ভট্টাচার্যের দ্বিতীয় স্ত্রীর দ্বিতীয় সন্তান। তাঁর মায়ের নাম সুনীতি দেবী। মাত্র ২১ বছরের সফরে তিনি জয় করেছেন সাহিত্যপ্রেমী মানুষের হৃদয়। সংক্ষিপ্ত জীবনের সফরেও পৃথিবীতে তাঁর পদচিহ্ন রয়ে গেছে—থাকবে যতদিন বাংলা সাহিত্য বেঁচে থাকে।

কিশোর বয়সেই নিজের বিদ্যালয় কমলা বিদ্যামন্দির থেকে প্রকাশিত ‘সঞ্চয়’ সাময়িকীতে তাঁর ছোটগল্প প্রকাশিত হয়। শিখা পত্রিকায় প্রকাশিত হয় স্বামী বিবেকানন্দ জীবনী নামে গদ্য। কমলা বিদ্যামন্দিরের পাঠ চুকিয়ে ভর্তি হন বেলেঘাটা উচ্চ বিদ্যালয়ে। তখন থেকেই তাঁর কবিতা ছাপা হতো বিভিন্ন পত্রিকা, সাহিত্য সাময়িকীতে। লেখালেখির সূত্রে পরিচয় হয় কবি অরুণাচল বসুর সাথে। দুজনে মিলে সম্পাদনা করেন হাতে লেখা পত্রিকা ‘সপ্তমিকা’।

সুকান্তের পরিবার ছিল শিক্ষিত ও সাহিত্যানুরাগী। শৈশব-কৈশোরে তিনি পরিচিত হয়েছেন বিখ্যাত সব কবি, সাহিত্যিকদের লেখার সাথে। কবির সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক তৈরিতে অবদান রাখেন তাঁর চাচাতো বোন রাণী ভট্টাচার্য। শিশুকাল থেকেই সুকান্তের সহচর রাণীদি শোনাতেন বিখ্যাত সব কবিদের ছড়া, কবিতা কিংবা লেখকদের গল্প। অকস্মাৎ রাণীদি কবিকে ছেড়ে পাড়ি জমান অজানার উদ্দেশ্যে। সুনীতি দেবীকেও হারান অল্প বয়সেই। মা এবং দিদিকে হারিয়ে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। জীবনের এক পর্যায়ে নেমে আসে নিঃসঙ্গতা, নির্জনতা, চরম একাকিত্ব কিংবা দরিদ্রতা। এই মর্মন্তুদ জীবনেও ইস্তফা দেননি সাহিত্যচর্চা। তিনি লিখেছেন—‘কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটিক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী-গদ্যময়:পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।’

সুকান্ত শৈশব পেরিয়ে কৈশোর কিংবা যৌবনের দিকে যাচ্ছিলেন; পৃথিবীতে তখন চলছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের তাণ্ডব পৈশাচিক নৃত্য, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ফ্যাসিবাদের আগ্রাসন, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন। রাজনীতি সচেতন কবি সুকান্ত জড়িয়ে পড়েন সমাজতন্ত্রের প্রতি। শোষণহীন সমাজ বিনির্মাণে তাঁর ক্ষুরধার কলম চলতে থাকে। লেখা প্রকাশিত হয় বিভিন্ন পত্রিকা, সাময়িকীতে। ১৯৪৪ সালে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিলে পড়াশোনায় ভাটা পড়ে। ফলাফল পরের বছর ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ফেল। ওই সময়ে বিভিন্ন ছাত্র আন্দোলন ও বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করায় আনুষ্ঠানিক শিক্ষার যবনিকাপাত ঘটে। শিক্ষাজীবনে যবনিকাপাত ঘটলেও বারুদের ঝাণ্ডা উড়তেই থাকে তাঁর কলমে। তিনি লেখেন—‘আমি একটা ছোট্ট দেশলাইয়ের কাঠিএত নগণ্য, হয়তো চোখেও পড়ি নাঃতবু জেনোমুখে আমার উসখুস করছে বারুদ—বুকে আমার জ্বলে উঠবার দুরন্ত উচ্ছ্বাস;আমি একটা দেশলাইয়ের কাঠি।’

আরও পড়ুন ফ্রেড্রিক নিৎসে ও তাঁর গোঁফ-দর্শন  কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় আধুনিকতার প্রভাব 

কিশোর কবি সর্বদাই গেয়েছেন তারুণ্যের জয়গান। তিনি মনে করতেন, মানুষের অধিকার আদায়ে দেশে দেশে বিপ্লব হবেই। আর এ বিপ্লবের নেতৃত্ব দেবে তরুণ সমাজ। তাই তারুণ্যের অপার সম্ভাবনা তিনি জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন তাঁর কর্মে, লেখায়—যা বিভিন্ন আন্দোলন, সংগ্রামে তরুণদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। তিনি উচ্চারণ করেছেন—‘আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহর্স্পধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,আঠারো বছর বয়সেই অহরহবিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।’

কবি সুকান্ত ফ্যাসিবাদ বিরোধী প্রচারণায় সব সময় সরব ছিলেন এবং গণনাট্য সংঘ নামে একটি নাট্যদলকে তিনি ফ্যাসিবাদ বিরোধী একাধিক নাটিকা লিখে দিয়েছেন। ১৩৫০ সালের দুর্ভিক্ষ শুরু হলে ছিন্নমূল মানুষের মাঝে সমানে কাজ করেছেন তিনিও। দুর্ভিক্ষের দুর্দশায় মহাজন, মজুতদারদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন— ‘শোনরে মালিক শোনরে মজুতদারতোদের প্রাসাদে জমা হলো কত মৃত মানুষের হাড়হিসাব দিবি কি তার?’

ক্ষণজন্মা কবি চাইতেন পৃথিবীতে নেমে আসবে সাম্য, সুন্দর—জয় হবে মানবতার। পৃথিবীর কোনো জঞ্জাল একটি মানব শিশুকেও স্পর্শ করবে না। তিনি পুত-পবিত্র করে রেখে যেতে চেয়েছেন সুন্দর এই ধরণী। তিনি জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ রেখে যেতে চাননি। তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ, প্রাণপণে সরাবেন পৃথিবীর সব জঞ্জাল। তাই তো তিনি ছাড়পত্র কবিতায় লিখেছিলেন— ‘এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠেচলে যেতে হবে আমাদের।চলে যাব—তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণপ্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমিনবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’

কবি তাঁর কবিতায় কবিসত্তার স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত ছিলেন—যা আমাদের চেতনাকে শানিত করেছে। রাজনীতি ও স্বাধীনতার প্রশ্নে সরব কর্মী অত্যধিক পরিশ্রমের ফলে দুরারোগ্যে রোগ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন। মাত্র ২১ বছর বয়সে পৃথিবীতে দীপ্ত কণ্ঠে মানবতার জয়গান গেয়ে যাওয়া কবির জীবন প্রদীপ ম্রিয়মাণ হয়ে যায় ১৯৪৭ সালের ১৩ মে কোলকাতার ১১৯ লাউডট স্ট্রিটের রেড অ্যান্ড কিওর হোমে। কবির জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা।

এসইউ/জিকেএস