তথ্যপ্রযুক্তির যুগে ইঞ্জিনিয়ারিং টেকনোলজির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং। বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেটের বিস্তার, কনটেন্ট স্ট্রিমিং সেবা, ক্লাউড কম্পিউটিং ও গ্লোবাল কানেক্টিভিটির কারণে প্রতিনিয়ত বাড়ছে এই টেকনোলজির চাহিদা। আধুনিক বিশ্বে কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং ছাড়া উন্নত জীবনযাপন ও প্রযুক্তিনির্ভর পরিবেশ কল্পনাই করা যায় না। অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে—কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং আসলে কী? এ টেকনোলজির কাজ কী? এ বিষয়ে ডিগ্রি অর্জনের পর শিক্ষার্থীর ক্যারিয়ার কেমন হতে পারে? এ ছাড়া আরও অনেক প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খায়। সেসব নিয়েই আজকের আয়োজন—
কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং কীকমিউনিকেশন টেকনোলজি হলো ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা, যা তথ্য যেমন- ডাটা, ভয়েস, ভিডিও ইত্যাদি আদান-প্রদানের প্রযুক্তি, সিস্টেম ও পদ্ধতি নিয়ে কাজ করে।
এটি মূলত বিভিন্ন যোগাযোগমাধ্যমের (রেডিও, টেলিভিশন, মোবাইল, স্যাটেলাইট, ইন্টারনেট প্রভৃতি) প্রযুক্তিগত কাঠামো তৈরি ও পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত।
এ প্রযুক্তির মাধ্যমে আমাদের দৈনন্দিন জীবন হয়ে উঠেছে আরও সহজ, দ্রুত ও কার্যকর। বিশ্ব এখন কার্যত চলে এসেছে আমাদের হাতের মুঠোয়। আধুনিক যুগে এ প্রযুক্তির গুরুত্ব যেমন ব্যাপক, তেমনই ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাও সীমাহীন।
যেসব বিষয়ে পড়বেন১. সিগন্যাল ও সিস্টেম> সিগন্যালের প্রকারভেদ> সিস্টেমের বৈশিষ্ট্য> ফুরিয়ার সিরিজ ও ফুরিয়ার ট্রান্সফর্ম> ল্যাপ্লাস ও জেড-ট্রান্সফর্ম
২. অ্যানালগ কমিউনিকেশন> এমপ্লিটিউড মডুলেশন> ফ্রিকোয়েন্সি মডুলেশন> ফেজ মডুলেশন> ট্রান্সমিশন মিডিয়া
৩. ডিজিটাল কমিউনিকেশন> ডিজিটাল মডুলেশন> সোর্স ও চ্যানেল কডিং> বিট রেট, বাউড রেট> ট্রান্সমিশন এরর ও নইজ
৪. টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং> মোবাইল কমিউনিকেশন> সেলুলার নেটওয়ার্ক স্থাপনা
৫. সিগন্যাল প্রসেসিং> ডিজিটাল সিগন্যাল প্রসেসিং> ফিল্টার ডিজাইন> কনভলিউশন ও ডিসক্রিট ফুরিয়ার ট্রান্সফর্ম
৬. মাইক্রোওয়েভ ও অ্যান্টেনা> মাইক্রোওয়েভ কমিউনিকেশন> অ্যান্টেনার ধরন ও বৈশিষ্ট্য> রেডার সিস্টেম
৭. স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন> জিইও, এমইও, এলইও স্যাটেলাইট> আপলিংক ও ডাউনলিংক> ট্রান্সপন্ডার ও ট্র্যাকিং
৮. ফাইবার অপটিক্স কমিউনিকেশন> অপটিক্যাল ফাইবার স্ট্রাকচার> আলো পরিবহন প্রক্রিয়া> অপটিক্যাল ট্রান্সমিটার ও রিসিভার
৯. ডেটা কমিউনিকেশন ও কম্পিউটার নেটওয়ার্কিং> ওএসআই ও টিসিপি বা আইপি মডেল> ল্যান, ওয়্যান, রাউটার, সুইচ> প্রোটোকল ও আইপি অ্যাড্রেসিং
১০. ইলেকট্রনিক ডিভাইস ও সার্কিট> ট্রানজিস্টর, ডায়োড, অপ্যাম্প> আরএফ ও মিক্সড সিগন্যাল সার্কিট> যোগাযোগ ডিভাইসের হার্ডওয়্যার ডিজাইন
১১. নইজ ও র্যান্ডম প্রসেস> নইজ মডেলিং> সিগন্যাল টু নইজ রেশিও> র্যান্ডম প্রসেস থিওরি
১২. ইলেকট্রোম্যাগনেটিক থিওরি> ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ> ওয়েভ প্রোপাগেশন> গাইডেড মিডিয়া ও ফ্রি স্পেস প্রোপাগেশন
আরও পড়ুনইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের টিকে থাকার কৌশলবিদেশে পড়তে যাওয়ার পর যেসব বিষয় জানা জরুরি১৩. কোডিং ও ইনফরমেশন থিওরি> ইনফরমেশন এন্ট্রপি> হাফম্যান ও শ্যানন কোডিং> এরর কারেকশন ও ডিটেকশন
১৪. সফটওয়্যার ও প্রোগ্রামিং> ম্যাটল্যাব বা পাইথন সিমুলেশন> ভেরিলগ বা ভিএইচডিএল> নেটওয়ার্ক সিমুলেশন টুলস।
কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ভবিষ্যৎবর্তমান যুগ তথ্য ও প্রযুক্তির যুগ। প্রতিদিন আমরা যেভাবে তথ্য আদান-প্রদান করছি—ফোনে কথা বলা, ই-মেইল পাঠানো, ভিডিও কনফারেন্সে অংশ নেওয়া বা ইন্টারনেট ব্যবহার করা—এসবের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং।
এই প্রযুক্তির মাধ্যমে রেডিও তরঙ্গ, স্যাটেলাইট যোগাযোগ, ফাইবার অপটিক্স, মোবাইল নেটওয়ার্ক এবং ইন্টারনেট অব থিংসের মতো ক্ষেত্রগুলোতে কাজ পরিচালিত হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন দক্ষ ও প্রশিক্ষিত কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়াররা।
এদিকে বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অটোমেশন এবং মেশিন লার্নিংয়ের ব্যাপক অগ্রগতির ফলে কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। ভবিষ্যতে স্মার্ট সিটি, সেলফ-ড্রাইভিং কার, ই-হেলথ, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ও রিমোট সার্জারির মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তিগুলো আরও উন্নত হবে। তাই সব মিলিয়ে বলা যায় কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল ও সম্ভাবনাময়।
কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ক্যারিয়ার কেমনকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং চ্যালেঞ্জিং হলেও দারুণ সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার। টেলিকম কোম্পানি, ইন্টারনেট সেবা, স্যাটেলাইট, রেডিও ও টেলিভিশনসহ বিভিন্ন প্রযুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে এই টেকনোলজির ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য রয়েছে প্রশস্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ। বেসরকারি খাতের পাশাপাশি এই প্রযুক্তিতে সরকারি চাকরির সুযোগও রয়েছে।
দেশের তুলনায় বিদেশে এই খাতে ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ আরও বেশি, বিশেষ করে উন্নত প্রযুক্তির দেশগুলোতে চাহিদা অনেক। তবে প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তনের কারণে এই পেশায় সব সময় আপডেট থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সরকারি চাকরি১. বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেড২. বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন৩. বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড৪. বাংলাদেশ পোস্ট অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন বিভাগ৫. বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি লিমিটেড৬. বাংলাদেশ রেডিও৭. বাংলাদেশ টেলিভিশন৮. স্পেকট্রাম ম্যানেজমেন্ট সেন্টার।
বেসরকারি চাকরি১. টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি২. আইটি ও নেটওয়ার্কিং ফার্ম৩. সফটওয়্যার ও টেকনোলজি কোম্পানি৪. রিসার্চ ও ডেভেলপমেন্ট ফার্ম৫. টেলিভিশন, ব্রডকাস্টিং এবং মিডিয়া হাউজ৬. টেলিকম ইক্যুইপমেন্ট নির্মাতা।
অন্য ক্যারিয়ারপ্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারি-বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতার মাধ্যমে ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ আছে। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন কারিগরি ট্রেনিং সেন্টার ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে পারবেন। এ ছাড়া বিভিন্ন বাহিনীতেও ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ রয়েছে।
এ পেশায় স্বাধীনভাবেও কাজ করা যায়। কেউ চাইলে ডিজিটাল সেবা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে উদ্যোক্তা হিসেবেও সফল হওয়ার বিশাল সুযোগ রয়েছে। আবার অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ফ্রিল্যান্সার হিসেবেও কাজ করতে পারেন। যা বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা অর্জনের পথ খুলে দেয়। কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং এমন একটি পেশা, যেখানে জ্ঞান, প্রযুক্তি ও সৃজনশীলতাকে একসঙ্গে কাজে লাগিয়ে একজন ইঞ্জিনিয়ার নিজের জন্য গড়তে পারেন উজ্জ্বল ও সফল ক্যারিয়ার।
ভালো দক্ষতা, নতুন প্রযুক্তির অভিজ্ঞতা এবং সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে খুব সহজেই এ টেকনোলজি নিয়ে উজ্জ্বল ও সফল ক্যারিয়ার গড়া সম্ভব।
কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং কারা পড়বে?যারা প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী এবং নতুন কিছু শিখতে ভালোবাসেন, বিশ্লেষণধর্মী চিন্তা করতে পছন্দ করেন এবং গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানে দক্ষ, তাদের জন্য কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং উপযুক্ত। এই বিষয়ে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তির প্রতি ভালোবাসা থাকার পাশাপাশি সমস্যা সমাধানে ধৈর্য ও জটিল বিষয় সহজে বোঝার ক্ষমতাও থাকতে হবে।
কোথায় পড়বেন?যদি কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ার বা ডিপ্লোমা কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ার হতে চান, তাহলে ৪ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং অথবা ৪ বছর মেয়াদি বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করতে হবে। ডিপ্লোমা ইন কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ার পড়ার জন্য সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট আছে। ডিপ্লোমা শেষে সরকারির পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও বিএসসি করা যাবে।
এসইউ/জেআইএম