অনিকা তাহসিন চৌধুরী সিলেটের মেয়ে। সিলেটের লিডিং ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতক পাস করেছেন। পড়াশোনা শেষে স্যামসাংয়ে বছর তিনেক চাকরিতে ছিলেন। তারপর আয়ারল্যান্ড পাড়ি জমান। বিদেশে গিয়েও দমে যাননি। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে ইন্টারভিউ চলতে থাকে। এরমধ্যে টেকজায়ান্ট প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফটও ছিল। এখানে ইন্টারভিউয়ের ধাপ পাড়ি দিয়ে পান অফার লেটার। অনিকা এক বছরেরও বেশি সময় ধরে আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন শাখায় ‘সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার’ হিসেবে চাকরি করছেন। তার পথচলার গল্প শুনে জাগো নিউজের পাঠকদের জন্য লিখেছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—
আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা সিলেট শহরে। শৈশবে যৌথ পরিবারে বড় হয়েছি। পরিবারের একমাত্র মেয়ে ছিলাম। এ কারণে সবার স্নেহ-মমতার ছায়াতলে বড় হয়ে উঠেছি। ছোটবেলায় নির্ধারিত কোনো কিছু হওয়ার স্বপ্ন ছিল না। তবে দাদু ভাই একদিন বললেন, ‘আনিকা তুমি বড় হয়ে কী হতে চাও?’ উত্তরে বলেছিলাম, ‘দাদু, আমি পাইলট হব—প্লেনে উড়ে বেড়াবো।’
পড়াশোনার সাথে প্রোগ্রামিংক্লাস সেভেন-এইটে থাকতে সায়েন্স নিয়ে পড়ার ইচ্ছে জাগে। সেই থেকে কম্পিউটার নিয়ে পড়াশোনার স্বপ্ন ছিল। এক কাজিন ছিল, সে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করতো। তার থেকে কিছু আইডিয়া নিই। ভাবি, এ বিষয় নিয়ে পড়লে প্রযুক্তির বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে পারবো। সবমিলিয়ে সিদ্ধান্ত নিই, কম্পিউটার সায়েন্সই হবে পড়াশোনার ঠিকানা। সেই থেকে সিলেটের লিডিং ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হই। পড়াশোনার শুরুতে প্রবলেম সলভিং, প্রোগ্রামিং কন্টেস্টের সাথে পরিচয় হয়। প্রবলেম সলভিং খুব ইন্টারেস্টিং মনে হতো। বন্ধুদের সাথে নিয়ে প্রবলেম সলভিং এনজয় করতাম। একসময় উপলব্ধি করি—প্রবলেম সলভিং শুধু দক্ষতা নয় বরং সৃজনশীলও।
চাকরির স্বপ্নসালটা ২০১৩, নিউজপেপার পড়ছিলাম। পাতা ওল্টাতেই গুগলে এক আপুর চাকরির খবর আবিষ্কার করলাম। সেসময় বড় আপুদের এমআইটি-হার্ভার্ডে পড়ার নিউজ পেতাম। ভার্সিটিতেও বড় ভাই ও আপুদের আমাজন, গুগল, মাইক্রোসফটসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে চাকরির খবর দেখতাম। তাদের দেখে মনের কোণে স্বপ্ন জাগতো। ইস! আমিও যদি তাদের মতো পারতাম। এরমধ্যে কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতকের পাঠ শেষ হয়। এরপর স্যামসাংয়ে চাকরি নিই। পাশাপাশি বিদেশে চাকরির প্রস্তুতি চলে। শুধু মাইক্রোসফটে চাকরি করবো, এমন নয়। টেকজায়ান্ট যে কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরির ইচ্ছে ছিল। এ ছাড়া যেখানে নিজের শেখার, জানার ও উন্নতির জায়গা থাকবে—এমন প্রতিষ্ঠান পছন্দের তালিকায় ছিল।
২০২২ সালে আয়ারল্যান্ডে পাড়ি জমাই। তখন মাইক্রোসফটে লেঅফ চলার কারণে হায়ারিং ছয় মাস বন্ধ। বিদেশে পা রাখার ছয় মাসের মধ্যে উপযুক্ত চাকরি খুঁজে বের করার সিদ্ধান্ত ছিল। তবে বছরখানেকের মধ্যে কোনো চাকরির সুরাহা হয়নি। আমি নন-ইউরোপীয়ান। পাশাপাশি ভিসার স্ট্যাস্টাসও তলানিতে। সব মিলিয়ে শুরুতে কঠিন সময় পার করতে হয়েছে। ২০২৪ সালের প্রথমে মাইক্রোসফটে অ্যাপ্লাই শুরু হয়। তখন হাজবেন্ডের (গুগলার) রেফারেল নিয়ে অ্যাপ্লাই করি। মার্চ মাসে এক প্রতিষ্ঠান থেকে রিজেকশন মেইল আসে। মজার বিষয় হলো, সেদিন রিক্রুটার একই পজিশনের জন্য মাইক্রোসফট থেকে রিচ করেন। আমি একবাক্যেই ইন্টারভিউয়ের জন্য রাজি হয়ে যাই। রিক্রুটার আমাকে দ্রুত অ্যাসেসমেন্টগুলো দিতে বলেন। দিনক্ষণ ঠিক করে প্রথম ইন্টারভিউতে বসি। ইন্টারভিউর আধা ঘন্টা পর রিক্রুটার জানান, ‘তুমি এই অ্যাসেসমেন্ট পাস করেছো, পরবর্তী ইন্টারভিউয়ের জন্য তারিখ ঠিক করো।’ তখন অনসাইট ইন্টারভিউয়ের তারিখ ঠিক করলাম। অনসাইটের মধ্যে কোডিং, অবজেক্ট অ্যারিয়েন্টেড প্রোগ্রামিং এবং সিস্টেম ডিজাইন—তিনটি রাউন্ড হয়। ইন্টারভিউ ভালোই হয়েছিল। তিন-চার দিনের মধ্যে জানানোর কথা ছিল। এরমধ্যে কোনো খবর না আসায় হতাশা বাড়ে। সাত-আট দিন পর রিক্রুটার কল দিলো। জানালেন, হায়ারিং ম্যানেজার আমার সাথে কথা বলতে চান। তার সাথে বিহেভিওয়ারাল ইন্টারভিউতে বসতে হবে। এটাই ছিল ফাইনাল ইন্টারভিউ। দিন পাঁচেক পর রিক্রুটার জানালো, ‘আই ডিড ওয়েল ইন দ্য ইন্টারভিউ।’ মাইক্রোসফট থেকে যখন অফার পাই, তখন বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। এত চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে মনো হলো, দীর্ঘদিনের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পারলাম।
আরও পড়ুনযুক্তরাষ্ট্রের নক্স কলেজে ৩ কোটির বৃত্তি পেলেন সাদ জাপানের মেক্সট বৃত্তিতে পড়তে যা করবেন
যাদের পাশে পেয়েছিপড়াশোনা, ভার্সিটি, চাকরির প্রস্তুতি, মাইক্রোসফটে চাকরি—এ সমস্ত পথচলায় সবার অনেক সাপোর্ট ছিল। মাইক্রোসফটে প্রথমবারেই সব পরীক্ষায় উতরে যাই। আমার ভাগ্য ভালো, আল্লাহ তাআলার ইচ্ছে ছিল। প্রস্তুতির সময় অনেক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমি যেন ভেঙে না পড়ি—সেই জায়গা থেকেই পরিবার ও কাছের মানুষেরা সব সময় পাশে থেকেছেন, সাহস জুগিয়েছেন।
পরিবার ছেড়ে ডাবলিনেদেশ ছেড়ে থাকার ফলে এখানে মানুষ অনেক ডিপ্রেশনে ভোগে। পরিবার ছেড়ে ৫ হাজার মাইল দূরে থাকা খুবই কষ্টের। আগে হয়তো পরিবার ছেড়ে বড়জোর ঢাকাতে থাকতাম। তবে এখন অনেক দূর, চাইলেও পরিবারের কাছে যাওয়া যায় না। নতুন মানুষজন, পরিবেশ, আবহাওয়া, পারিপার্শ্বিক অবস্থা—এসব বিষয় প্রথমদিকে মানিয়ে নেওয়া খুবই কষ্টের ছিল। মানসিকভাবে সব কিছু মানিয়ে নেওয়াটা বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল।
স্যামসাংয়ের পর মাইক্রোসফটে এত দক্ষ লোকদের সাথে কাজ করতে পারবো, দশ বছর আগে এসব ভাবনার বাইরে ছিল। এই জায়গায় আসাটাও চ্যালেঞ্জিং ছিল। আরেকটা বিষয়, ছেলেদের সাথে পাল্লা দিয়ে নিজের দক্ষতা প্রমাণ করতে হয়েছে। ভার্সিটিতে কনটেস্ট প্রোগ্রামে টিমের পার্ট হওয়াটা কঠিন ছিল। তাদের ধারণা, মেয়ে মানুষ হয়তো বেশি মনোযোগী হবে না, সময় দিতে পারবে না। দেখা গেল, ভার্সিটিতে আমাদের টিম প্রথমবার টপ টেনের মধ্যে এলো। এটি বিশাল একটা অর্জন। সবকিছু মিলিয়ে আমি নিজেকে প্রমাণ করতে পেরেছি। আমি ‘ইন্ট্রোভার্ট’ প্রকৃতির মানুষ। ইন্ট্রোভার্ট হয়েও নিজেকে সামনে নিয়ে আসাটা প্রমাণ করতে হয়েছে। ভার্সিটি থেকে যখন বের হই; তখন সিলেটে সফটওয়্যার ফার্ম বা টেক প্রতিষ্ঠান ছিল না। এজন্য চাকরি নিতে হবে রাজধানীতে। বিষয়টি চ্যালেঞ্জিং ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে ঢাকায় আসতে পরিবারকে বোঝানোটা সহজ ছিল না। ইন্টারভিউতে বসতে প্রতিবার বাবার সাথে ঢাকায় যাওয়া-আসা করতাম। এ ক্ষেত্রে ছেলেদের কোনো সমস্যা হতো না। তবে চ্যালেঞ্জগুলো আমার জীবনের জন্য একটি লার্নিং। আমার শেখার বড় একটি পার্ট।
চাকরির অভিজ্ঞতামাইক্রোসফটে পথচলা এখন ১ বছরের বেশি সময়ের। এখানে খুব দক্ষ লোকজন চাকরি করেন। তাদের সাথে কাজ করতে পারাটা ভাগ্যের ব্যাপার। প্রথমদিকে খাপ-খাইয়ে নেওয়ার চ্যালেঞ্জ ছিল। তবে টিমের সবার সাপোর্ট পেয়ে সামনে এগিয়ে যাই। তাছাড়া সিনিয়র ইঞ্জিনিয়াররা খুব সাপোর্ট করতেন। তাদের গাইডেন্স, ডিরেক্টশন ও সাপোর্ট পেয়ে আত্মবিশ্বাস বাড়ে। টিম এখন আমার ওপর ভরসা করতে পারে। এক বছরে টেকনিক্যাল বিষয়গুলো শিখেছি। বড় স্কিলে কীভাবে একটা প্রোডাক্ট রান করা যায়, এই বিষয়গুলো রপ্ত করেছি। পাঁচটা সমস্যার মধ্যে কীভাবে একটি সমস্যা সমাধান করতে হয়, যা টিম ও প্রোডাক্টের জন্য ভালো। সিস্টেম ডিজাইন, প্রোডাক্ট ডিজাইন এবং ফিচার ডিজাইন—বিষয়গুলোতে আরও উন্নতি হয়েছে। পাশাপাশি প্রোডাক্টের উন্নতি করতে হলে কী করতে হয়? প্রোডাক্টগুলো কাস্টমারদের কাছে যায়। তাদের কথা চিন্তা করে প্রোডাক্ট করতে হয়। আমি প্রায় ৩০ জনের একটি টিমে ‘সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার’ হিসেবে। কনজিউমারদের জন্য আমাদের সার্ভিস কাজ করে থাকে। বর্তমান কাজ এআই ফোকাস করে চলছে।
মাইক্রোসফটে সুযোগ-সুবিধামাইক্রোসফটে চাকরিতে বেসিক স্যালারির সাথে স্টক বোনাস দেওয়া হয়। বছরের ২৫ দিন ছুটি রয়েছে। মেয়েদের গর্ভকালীন ছুটি বা মেন্টাল হেলথের জন্য ভালো একটা সাপোর্ট দেয়। হেলথ ইন্স্যুরেন্স, লাইফ ইন্স্যুরেন্স দিয়ে থাকে। মেন্টাল হেলথের জন্য মাইক্রোসফটে জিম, খেলাধুলা, হ্যাকাথনের মাধ্যমে নিজেকে প্রতিভা প্রমাণের সুযোগ আছে। এ ছাড়া এখানে ভালো কাজের পরিবেশ আছে।
ভবিষ্যতে এআই নিয়ে কাজআপাতত আমার টিমের মধ্যে ভালো ‘ইম্পেক্ট’ ফেলতে চাই। আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্ট ব্যবহার করে আমাদের জীবনকে কীভাবে আরও সহজ করা যায়—সেটা নিয়ে ভাবছি। ভবিষ্যতে এআই নিয়ে কোনো কাজের সাথে সংযুক্ত হতে চাই। এআইয়ের সাথে মানুষ যাতে মনষ্যত্বটাও ধরে রাখতে পারে—সেই চিন্তা করছি। আল্লাহ তাআলার ওপর ভরসা করে এগিয়ে যেতে চাই।
এসইউ/জিকেএস