লাইফস্টাইল

বুলিরা কেন বুলিং করে

সানজানা রহমান যুথী

বুলিং বা হয়রানি আমাদের সমাজে খুব পরিচিত একটি শব্দ। এটি নানাভাবে হতে পারে। শারীরিক, মৌখিক, মানসিক, আবেগীয়, সাইবার, জাতিগত, যৌন হয়রানিমূলক- নানা ধরনের।

সহজ ভাষায় বলতে গেলে যে বুলিং করে তাকে বুলি বলে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমরা বুলি বা হয়রানিকারীর চেয়ে ভুক্তভোগীকে নিয়ে বেশি আলোচনা করি। জানতে চাই না একজন বুলি কেন অন্যকে হয়রানি করে।

ইংরেজি শব্দ বুলিং অর্থ- কাউকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে তাকে বারবার বিভিন্নভাবে হয়রানি করা। ইউনেস্কোর হিসাব অনুযায়ী, আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ তরুণ-তরুণী বুলিংয়ের শিকার। কিন্তু একজন মানুষ কেন অন্যকে এভাবে আঘাত করে?

এই ভয়াবহ অবস্থাকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার পালিত হয় বিশ্ব হয়রানি প্রতিরোধ দিবস। আজকের এই দিবসে আমরা একজন পেশাদার মনোবিজ্ঞানীর কাছে জানবো বুলিরা কেন বুলিং করে?

এ বিষয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলর মাহমুদা ইসলাম মিম-

জাগো নিউজ: প্রথমেই জানতে চাই বুলিং আসলে কী?

মাহমুদা ইসলাম মিম: কাউকে মানসিকভাবে অপদস্থ বা হয়রানি করার উদ্দেশ্যে বারবার ইচ্ছাকৃতভাবে আঘাত করা বা হাসির পাত্র হিসেবে উপস্থাপন করাই বুলিং। বুলিং নানান ধরনের হতে পারে- শারীরিক, মানসিক, আবেগীয়, যৌন হয়রানিমূলক, সাইবার বুলিং ইত্যাদি।

জাগো নিউজ: মানুষ কেন অন্যকে হেয় বা কষ্ট দিতে চায়? এ প্রবণতার মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি কী?

মাহমুদা ইসলাম মিম: অন্যকে হেয় করে বা কষ্ট দিয়ে আনন্দ পাওয়ার মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি বেশ গভীর ও নেতিবাচক। একজন মানুষ যখন যে কোনো মূল্যে আত্ম-অহংকারবোধ বৃদ্ধি করতে চায়, নিজেকে অন্যের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও শক্তিশালী মনে করে, কিন্তু নিজের প্রতিহিংসামূলক আচরণ, ক্ষোভ, হিংসা জাতীয় আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না– তখন সে অন্যকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পায়।

জাগো নিউজ: কিশোর বা তরুণ বয়সে বুলিংয়ের প্রবণতা বেশি দেখা যায় কেন?

মাহমুদা ইসলাম মিম: কিশোর বা তরুণ বয়সে দলগত প্রভাবে বুলিংয়ের প্রবণতা বেশি দেখা যায়। অনেক সময় বন্ধুদের গ্রুপে নিজের জায়গা তৈরি করার উপায় হিসেবে সে ভিন্ন একজনকে বুলিং করার রাস্তা বেছে নেয়। এই বয়সে অনুভূতি বুঝতে অসুবিধা হয় কারণ তাদের ‘প্রিফনটাল কর্টেক্স’ পুরোপুরি পরিপক্ব হয় না, ফলে তাদের মধ্যে সহানুভূতির অভাব লক্ষ্য করা যায়।

এছাড়া পরিচয় সংকট, আত্ম-প্রমাণের চেষ্টা, সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব, নিরাপত্তাহীনতা, নিজের দুর্বলতা ঢাকতে চাওয়া, পারিবারিক বা সামাজিক পরিবেশের প্রভাবে কিশোর ও তরুণ বয়সে বুলিংয়ের প্রবণতা বেশি দেখা যায়।

জাগো নিউজ: যারা নিয়মিত অন্যকে বুলি করে, তাদের মানসিক গঠন বা শৈশবের অভিজ্ঞতায় সাধারণত কী ধরনের মিল পাওয়া যায়?

মাহমুদা ইসলাম মিম: যারা নিয়মিত অন্যকে বুলি করে তাদের মধ্যে সাধারণত আত্মসম্মানবোধের ঘাটতি, সহানুভূতির অভাব, আবেগ নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতা দেখা যায়। এছাড়া যারা সামাজিক বা পারিবারিক পরিবেশে বুলিংয়ের শিকার হয় তাদের মধ্যে বুলি করার প্রবণতা বেশি থাকে। অন্যের ওপর ক্ষমতা খাটিয়ে তারা নিজেদের শক্তিশালী প্রমাণ করতে চায়।

জাগো নিউজ: আত্মসম্মানবোধের অভাব বা পারিবারিক অবহেলা কাউকে ‘বুলি’ বানাতে পারে?

মাহমুদা ইসলাম মিম: হ্যাঁ। আত্মসম্মানবোধের অভাব বা পারিবারিক অবহেলা কাউকে ‘বুলি’ বানাতে পারে। যখন কেউ নিজের প্রতি বিশ্বাস হারায় বা নিজেকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে তখন সে অন্যকে আঘাত করে নিজেকে শক্তিশালী বা গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ করতে চায়। পারিবারিক অবহেলা বা ভালোবাসার অভাব থেকে জন্ম নেয় মানসিক শূন্যতা রাগ বা হতাশা। এসব কারণে অনেকে আগ্রাসী হয়ে ওঠে, নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, তখন তারা অন্যকে বুলি করে এক ধরনের মানসিক তৃপ্তি পায়।

জাগো নিউজ: বুলিরা কি সবসময়ই ‘খারাপ মানুষ’, নাকি তারাও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত?

মাহমুদা ইসলাম মিম: বুলিরা সবসময় খারাপ মানুষ নয়, বরং অনেক সময় তারা ভেতরে ভেতরে মানসিকভাবে ভঙ্গুর, অসহায় বা কষ্টে থাকা মানুষ। তাদের আচরণ যদিও ক্ষতিকর বা অগ্রহণযোগ্য, কিন্তু তারা এখান থেকে সহজে বের হতে পারে না এবং এর পেছনে থাকে গভীর মানসিক যন্ত্রণা, অবহেলা বা হতাশা।

অনেকে শৈশবে ভালোবাসা, নিরাপত্তা বা সঠিক স্বীকৃতি পায়নি। তারা হয়তো নিজেরাই অনেক সময় অপমান, নির্যাতন বা অবহেলার শিকার হয়েছে। ফলে তারা সেই কষ্টকে সঠিকভাবে সামলাতে শেখেনি, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। অন্যকে আঘাত করেই নিজের নিয়ন্ত্রণ বা শক্তিশালী প্রমাণের চেষ্টা করে।

জাগো নিউজ: তারা কেন নিজের ক্ষমতা বা প্রভাব দেখাতে বুলিংয়ের পথ বেছে নেয়?

মাহমুদা ইসলাম মিম: বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানুষ ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে নিজেকে শক্তিশালী মনে করে। তারা অন্যকে ছোট করে বা ভয় দেখিয়ে নিজের গুরুত্ব বা সামাজিক অবস্থা প্রমাণ করতে চায়। যারা ভেতরে ভেতরে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে তারা বাইরে নিজেদের শক্তিশালী প্রমাণ করতে চায়, অন্যের কষ্ট অনুভব করার ক্ষমতা কম থাকায় তারা নিজেদের স্বার্থ প্রায়োরিটি দেয়, শৈশবে যারা ক্ষমতার অপব্যবহার, সহিংসতা বা অন্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে দেখেছে, তারা সেই আচরণকে শক্তির প্রতীক মনে করে। এসব ধারণা থেকে তারা অন্যদের বুলিং করে নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করে।

জাগো নিউজ: সমাজে প্রতিযোগিতা, ক্ষমতা দেখানো বা মজার ছলে অন্যকে অপমান করা— এসব কি বুলিং সংস্কৃতিতে কী প্রভাব ফেলে?

মাহমুদা ইসলাম মিম: সমাজে বা স্কুলে সফলতার প্রভাব বা সামাজিক অবস্থানকে যখন অতি মূল্য দেওয়া হয়, তখন অনেকের মধ্যেই অন্যকে ছোট বা অপমান করে নিজেকে বড় করার চেষ্টা দেখা যায়। এছাড়া মজার ছলে বা ঠাট্টার ছলে অন্যকে হেয় করলে যখন কেউ তাকে থামায় না বা এ ধরনের কাজে প্রশংসা করা হয়, তখন স্বাভাবিকভাবে তার মধ্যে বুলিং আচরণ গড়ে ওঠে। ফলে এই ধরনের প্রতিযোগিতা বা ক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যমে অনেক সময় সমাজে বুলিং গ্রহণযোগ্যতা পায়।

জাগো নিউজ: গণমাধ্যম, সিনেমা বা সোশ্যাল মিডিয়ার কনটেন্টগুলো কিশোরদের বুলিং আচরণে কীভাবে প্রভাব ফেলছে?

মাহমুদা ইসলাম মিম: অনেক সময় দেখা যায় অন্যকে ছোট করা, ভয় দেখানো বা ক্ষমতা প্রদর্শন করা কনটেন্টগুলো অনেক জনপ্রিয় হয়। কিশোররা যেহেতু অনুকরণ করতে পছন্দ করে, তারা এসব অনুকরণ করে জনপ্রিয় হতে চায়। সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতিক্রিয়া, লাইক বা শেয়ার বৃদ্ধির মাধ্যমে তারা নিজেদের জনপ্রিয় মনে করে।

জাগো নিউজ: পারিবারিক পরিবেশ এক্ষেত্রে কীভাবে প্রভাব বিস্তার করে?

মাহমুদা ইসলাম মিম: পারিবারিক পরিবেশে যেখানে মারধর, অপমান বা হীনম্মন্যতার চর্চা আছে, সেখানে বেড়ে ওঠা শিশুরা সাধারণত বুলিংয়ে বেশি জড়ায়। শৈশবে যারা এ ধরনের নেতিবাচক আচরণ দেখে বড় হয়, তারা এটাকেই স্বাভাবিক মনে করে। এ ধরনের পরিবেশে ভালোবাসা, সহমর্মিতা ও সহায়তার অভাব থাকায় শিশুরা আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। সঠিকভাবে আবেগ প্রকাশ করতেও পারে না।

জাগো নিউজ: আমাদের সমাজ কি বুলিদের মানসিকতা ‘গ্রহণযোগ্য’ করে তোলে?

মাহমুদা ইসলাম মিম: যখন ক্ষমতার প্রভাব বা সামাজিক অবস্থানকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়, তখন কেউ কেউ অন্যকে ছোট বা অপমান করে তাদের সামাজিক অবস্থান গড়ে তুলতে চায়। অনেক সময় মজা, ঠাট্টা বা বন্ধুদের সাথে আড্ডায় বুলিংকে সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য হিসেবে ধরা হয়। গণমাধ্যম, সোশ্যাল মিডিয়ায় যখন একে অন্যকে উপহাস করা দেখানো হয় এবং জিনিসগুলো জনপ্রিয় হয়, তখন কিশোররা এ ধরনের আচরণ অনুকরণ করতে উৎসাহিত হয়। এভাবেই বুলিং সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে।

জাগো নিউজ: একজন বুলিকে কীভাবে চিহ্নিত করা যায় এবং মনোচিকিৎসা দিয়ে তার আচরণ পরিবর্তন সম্ভব কি?

মাহমুদা ইসলাম মিম: আচরণ এবং মনোভাব দেখে একজন বুলিকে সহজেই চিহ্নিত করা যায়। সাধারণ লক্ষণগুলো হলো- অন্যদের ওপর নিয়মিত চাপ বা ভয় দেখানো, অপমান বা আক্রমণাত্মক মন্তব্য করা, নিজের ক্ষমতা দেখানো, আবেগ নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতা, নিজের নিরাপত্তাহীনতা ও আত্মসম্মানহীনতা ঢাকার চেষ্টা ইত্যাদি। অনেক সময় সামাজিকভাবে জনপ্রিয় হতে এবং নিজের অবস্থান শক্ত করার জন্য এ আচরণ তারা চালিয়ে যায়।

মনোচিকিৎসক বা মানসিক সহায়তার মাধ্যমে তাদের আচরণ পরিবর্তন সম্ভব। তাদের চিন্তা, আচরণ বুঝতে সাহায্য করা, নিয়ন্ত্রণ ও সহানুভূতি শেখানো, আত্মসম্মান বাড়ানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া, পারিবারিক বা সামাজিক সমর্থন বৃদ্ধি করা ও নিয়মিত সাইকোথেরাপির মাধ্যমে তাদের মধ্যে বুলিংয়ের প্রবণতা কমানো সম্ভব।

জাগো নিউজ: স্কুল বা কলেজে বুলিদের জন্য কী ধরনের কাউন্সেলিং বা থেরাপি কার্যকর হতে পারে?

মাহমুদা ইসলাম মিম: স্কুল বা কলেজে বুলিদের জন্য কার্যকর থেরাপি মূলত ‘তাদের ভুল চিন্তা-ভাবনা, আগ্রাসী আচরণ চিহ্নিত করা এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণের দক্ষতা অর্জন’। তাদের চিন্তাভাবনা চিহ্নিত করে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা, পাশাপাশি সোশ্যাল স্কিল ও আবেগ নিয়ন্ত্রণের প্রশিক্ষণ দেওয়া।

তাদের মধ্যে সহানুভূতি বাড়ানো, রাগ ও হতাশা নিয়ন্ত্রণ, দ্বন্দ্ব সমাধানের দক্ষতা অর্জন করা। এছাড়া পারিবারিক বা গ্রুপ কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে তাদের সমর্থন এবং পরিবেশের ইতিবাচক পরিবর্তন আনা দরকার। এসব পদ্ধতি তাদের আত্মসম্মানবোধ বৃদ্ধি এবং অন্যকে সম্মান করার মানসিকতা তৈরি করতে সাহায্য করে।

জাগো নিউজ: পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একসঙ্গে কীভাবে বুলিং কমাতে পারে?

মাহমুদা ইসলাম মিম: পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বুলিং কমানোর জন্য সহযোগী হিসেবে কাজ করতে পারে। পরিবার শিশুকে ভালোবাসা, সমর্থন ও মানসিক নিরাপত্তা দেবে। অভিভাবকরা শিশুদের আচরণ পর্যবেক্ষণ করে ইতিবাচক আচরণ শেখাতে এবং নেতিবাচক আচরণ সংশোধনে ভূমিকা রাখতে পারে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একইসঙ্গে নিরাপদ ও সম্মানজনক পরিবেশ, স্পষ্ট নিয়ম নীতি ও বুলিং প্রতিরোধমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পারে।

পরিবার ও স্কুলের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ নিশ্চিত করলে, শিশুদের আচরণের ধারাবাহিকতা আসে। এতে তারা সহমর্মী হয় এবং তাদের সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধি পায়, যা বুলিং কমানোর একটি শক্তিশালী পরিবেশ গড়ে তুলতে পারে ।

এএমপি/এমএস