লাইফস্টাইল

ব্যক্তিত্বজনিত মানসিক সমস্যা হতে পারে শৈশবের ট্রমা থেকে

আপনার বা আপনার আশেপাশে কি এমন কেউ আছেন, যিনি হঠাৎ ভালো মুডে থাকেন আবার মুহূর্তেই প্রচণ্ড রেগে যান বা মন খারাপ করে ফেলেন?

অনুভূতির পরিবর্তন সাধারণত একটি স্বাভাবিক বিষয়; এটি প্রাকৃতিক। তবে কিছু মানসিক রোগ এই বিষয়টিকে এতটাই বাড়িয়ে তুলতে পারে যে, সেই মানুষটির স্বাভাবিক জীবন, সম্পর্ক, কাজ ও স্বাস্থ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এমন একটি মানসিক অসুখের নাম বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার (বিপিডি), যা একটি ব্যক্তিত্বজনিত মানসিক সমস্যা।

বিপিডি কী?বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার বা বিপিডি মূলত একটি জটিল মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, যা ব্যক্তির অনুভূতি, সম্পর্ক, আত্ম-চেতনা ও আচরণে গভীর প্রভাব ফেলে। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা খুব দ্রুত এবং তীব্রভাবে তাদের আবেগ, চিন্তা, আচরণ ও সম্পর্ক পরিবর্তন করেন।

এই অবস্থায় আক্রান্ত ব্যক্তি কখনো খুব ভালো অনুভব করেন, আবার কিছু সময়ের মধ্যে প্রচণ্ড হতাশা, রাগ বা একাকীত্বে ভোগেন। সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়—নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারা এবং সম্পর্ক ধরে রাখার ক্ষেত্রে অস্থিরতা।

বাংলাদেশের মানসিক স্বাস্থ্য গবেষণা কেন্দ্রের (Bangladesh Mental Health Research Center) এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের তরুণ ও যুবকদের মধ্যে এই বিপিডির হার প্রায় ১ থেকে ২ শতাংশ। অর্থাৎ, প্রতি হাজারে ১০ থেকে ২০ জন এই সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারেন। গবেষকরা বলছেন, নারীরা ও তরুণরা এই রোগে বেশি আক্রান্ত হন।

যেসব লক্ষণ দেখে সতর্ক হবেন

বিপিডি সচেতনতা সপ্তাহ (১-৭ অক্টোবর) উপলক্ষে জেনে নিন বিপিডির কিছু সাধারণ লক্ষণ, যা আপনার কাছের মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে সাহায্য করবে—

১. হঠাৎ করে রাগ, কান্না বা তীব্র আবেগের ওঠানামাবিপিডিতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা তাদের আবেগের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেন না। তাদের অনুভূতিগুলো খুব দ্রুত পরিবর্তিত হয়। তাই বাইরে থেকে দেখে মনে হবে যে, তাদের মুড যেন মুহূর্তে পাল্টে যাচ্ছে।

২. কাছের মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও ঘৃণার মধ্যে দ্রুত পরিবর্তনবিপিডি এমন এক সমস্যা, যা আক্রান্ত ব্যক্তিকে তার মতামত দ্রুত বদলে দেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে কাছের মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের ওপর।

৩. পরিত্যক্ত হওয়ার ভয়অ্যাব্যান্ডনমেন্ট বা অন্যের কাছে অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাওয়ার ভয় তাদের আরও বেশি অস্থির করে তোলে, এবং তারা এলোমেলো আচরণ করতে পারে।

৪. আত্মসম্মানবোধে অস্থিরতাআক্রান্ত ব্যক্তি কখনো নিজেকে খুব মূল্যবান মনে করেন, আবার কখনো খুব তুচ্ছ মনে করেন।

৫. হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেওয়া বা আত্মবিধ্বংসী আচরণবিপিডির কারণে অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে পারে বা নিজেকে আঘাত করতে পারে। এ ধরনের লক্ষণ দেখলে দ্রুত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।

৬. মানসিক শূন্যতা বা একাকীত্ব অনুভব করাঅবিরত আবেগের ঝড়ের মধ্যে বিপিডি আক্রান্ত ব্যক্তি মানসিক শূন্যতা অনুভব করতে পারে।

কেন হয় বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার?

আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন এই রোগের কিছু কারণ উল্লেখ করেছে—

>> শৈশবে মানসিক ট্রমা বা অবহেলা>> পারিবারিক সহিংসতা বা অস্থির সম্পর্ক>> জেনেটিক বা বংশগত প্রভাব>> মস্তিষ্কের আবেগ নিয়ন্ত্রণের অংশে রাসায়নিক ভারসাম্যের সমস্যা

অর্থাৎ, বিভিন্ন কারণের সংমিশ্রণে এই সমস্যা দেখা দিতে পারে। তবে, সঠিক চিকিৎসা ও সমর্থন নিয়ে রোগী স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন। তাই লক্ষণগুলো দেখা গেলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার কোনো দুর্বলতা নয়—এটি একটি চিকিৎসাযোগ্য মানসিক অবস্থা।

সেই সঙ্গে, আমাদের সমাজে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে যে ট্যাবুগুলো আছে, সেগুলোও ভাঙতে হবে। এর ফলে মানুষ কষ্ট লুকিয়ে না রেখে, বিজ্ঞানের সাহায্য ও কাছের মানুষের ভালোবাসায় নিরাপদ জীবন পেতে পারে।

সূত্র: বাংলাদেশের মানসিক স্বাস্থ্য গবেষণা কেন্দ্র, ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন, আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ, হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল স্টাডি

এএমপি/জেআইএম