উম্মে মাহবুবা ইমা
যেসব সাহিত্যকর্ম সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে চিরকাল পাঠকের মনে আলো জ্বালিয়ে রেখেছে; তার মধ্যে অন্যতম হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’। একটি বিখ্যাত রোমান্টিক উপন্যাস। উপন্যাসটিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইংরেজ কবি জন ডনের নান্দনিক পঙক্তি ‘ফর গড’স সেক, হোল্ড ইওর টাং অ্যান্ড লেট মি লাভ’ ব্যবহার করেন। ১৯২৯ সালে প্রকাশিত উপন্যাসটি ১৭টি অনুচ্ছেদে বিভক্ত।
উপন্যাসের প্রধান নায়ক হলেন অমিত রায়। আইন ব্যবসায়ী ধনাঢ্য বাবার একমাত্র ছেলে অক্সফোর্ড থেকে পড়াশোনা করে এসেছে। আইনের ছাত্র হয়েও সাহিত্যের প্রতি তার বিশেষ ঝোঁক ছিল। আবার সাহিত্যিকদের নিয়ে তিনি সমালোচনাও করতেন। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরুদ্ধে সমালোচনা করতেও তিনি দ্বিধাবোধ করতেন না। তার প্রখর সাহিত্যিক ও দার্শনিক মন্তব্যগুলো আজও পাঠকের মনে দাগ কাটে। তিনি যখন বলেন, ‘ফ্যাশানটা হল মুখোশ, স্টাইলটা হল মুখশ্রী’। তখন কেবল পোশাক নয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভণ্ডামি ও সারল্যের পার্থক্য চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন।
মিশুক স্বভাবের অমিত সহজেই সবার মন জয় করে নিতো। মেয়েদের প্রতি তার বিশেষ আগ্রহ না থাকলেও উৎসাহ ছিল। ছুটি কাটানোর জন্য শিলং পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে হঠাৎই তার সঙ্গে পরিচয় হয় লাবণ্যর। এক সুশিক্ষিতা, সংযত এবং বাস্তববাদী তরুণী। একটি দুর্ঘটনা-প্রবণ মুহূর্তে তাদের কথোপকথন শুরু হয়, যা পরিণত হয় এক গভীর বন্ধুত্ব এবং ক্রমে প্রেমে। এ প্রেম স্থূল নয়, দৈনন্দিন জীবনের বাঁধাধরা সংসারের চেয়ে অনেক ঊর্ধ্বে—এটি এক মুক্তির পথ।
লাবণ্যর এ গভীর উপলব্ধির প্রকাশ ঘটেছে বক্তব্যে, যেখানে সে বলেছে, ‘দূরত্ব যদি সত্যিই ভালবাসার গভীরতা বাড়িয়ে দেয়, তবে আমি দূরেই থাকতে চাই। অনেক অনেক দূরে।’ এ কথাতেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, সে ভালোবাসার ক্ষণস্থায়ী আসঙ্গ চাননি, চেয়েছিলেন তার অমর, অপরিবর্তনীয় রূপ।
আরও পড়ুনসুদিন ফিরে আসছে: যে যাত্রা পাঠকের মায়াপথিক: সমাজের আঁধার এবং আধেয় মুখ
উপন্যাসের শেষে অমিত ও লাবণ্য দু’জন দু’জনকে আপন ভুবনে মুক্তি দেয়। এ মুক্তির মাধ্যমেই তাদের প্রেম অমরত্ব লাভ করে। এখানেই উপন্যাসের গভীরতম দর্শন নিহিত। অমিতের নিজের কথাতেই প্রকাশ পায় সেই সত্য; যেখানে অমিত বলেছে, ‘আমাদের সকলের চেয়ে বড়ো যে পাওনা সে মিলন নয়, সে মুক্তি।’
লাবণ্যর সিদ্ধান্তই এ উপন্যাসের প্রাণ। সংসারের বন্ধনে জড়িয়ে তাদের ভালোবাসা যেন মলিন না হয়। তাই লাবণ্য এক মহান ত্যাগ স্বীকার করে। সে অমিতকে কেতকীর কাছে ফিরিয়ে দিয়ে বেছে নেয় বিরহের পথ। যেখানে বিচ্ছেদের মাঝেই থাকে চিরন্তন মিলন। এ বিরহই তাদের প্রেমকে আরও গভীর ও অমর করে তোলে।
লাবণ্যর লেখা শেষের কবিতার সেই বিখ্যাত চরণগুলো প্রেমের এক নতুন সংজ্ঞা রচনা করে। তার সেই অবিস্মরণীয় বিদায়-বাণী, ‘হে বন্ধু, বিদায়’ আসলে ব্যক্তি মানুষের কাছে প্রেমের মুক্তি ঘোষণার এক মহাকাব্যিক উচ্চারণ।
যেসব পাঠক কেবল একটি মিষ্টি প্রেমের গল্প খুঁজছেন, ‘শেষের কবিতা’ তাদের জন্য নয়। যারা প্রেমের গভীরে জীবনের দর্শন, স্বাতন্ত্র্যের আনন্দ এবং ত্যাগের মহিমা খুঁজে পেতে চান; তাদের জন্য এ উপন্যাস আজও এক অপরিহার্য পাঠ। রবীন্দ্রনাথের এ কাব্যধর্মী উপন্যাস পাঠকের কাছে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। যেখানে প্রেম কেবল বন্ধন নয় বরং মুক্তির আরেক নাম।
লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়।
এসইউ/জিকেএস