অর্থনীতি

রমজানের আগাম ভোগ্যপণ্য আসছে খাতুনগঞ্জে, কমছে দাম

• আমদানি বেশি; কমছে ছোলা, ডাল, চিনির দাম• ভারত থেকেও এসেছে ছোলা, মটর, মসুর, খেজুর, চিনি

রমজান শুরু হতে আরও আড়াই মাসের মতো সময় রয়েছে। এর মধ্যে রমজানের প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য আমদানি শুরু করেছেন ব্যবসায়ীরা। ভোগ্যপণ্যে দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ বাদেও সারাদেশের আমদানিকারকরা ঋণপত্র খুলেছেন। ডলার সংকট কেটে যাওয়ায় এবং সরকারি নীতিগত বাধা উঠে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবে ঋণপত্র খুলতে পেরেছেন আমদানিকারকরা।

ছোলা, ডাল, খেজুর, ভোজ্যতেল, চিনির মতো রমজানের অতিপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য আগাম আসতে শুরু করেছে খাতুনগঞ্জের বাজারে। এরমধ্যে ভারত থেকেও আসছে ছোলা, মটর, মসুর, খেজুর এবং পরিশোধিত চিনিও। আগের বছরের তুলনায় আমদানি বেশি হওয়ায় দামও কমছে। এতে রমজানে পণ্যের দাম ভোক্তাদের নাগালে থাকবে বলে অভিমত ব্যবসায়ীদের।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য মতে, চলতি (২০২৫-২৬) অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে গত ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত ১ লাখ ৯০ হাজার ৭৪৮ টন মটর আমদানি হয়েছে। এরমধ্যে ৮৬৯ টন এসেছে ভারত থেকে, ১ লাখ ৮৪ হাজার ৪৫৫ টন কানাডা এবং ৫ হাজার ৪২৩ টন এসেছে অস্ট্রেলিয়া থেকে। গত অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ৫৭ হাজার ৯৪৯ টন। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১ লাখ ৩২ হাজার ৭৯৯ টন মটর বেশি আমদানি হয়েছে।

একইভাবে চলতি অর্থবছরের এই সময়ে আমদানি হওয়া ছোলা খালাস হয়েছে ৪৩ হাজার ১০৩ টন। এরমধ্যে ৮ হাজার ৩৬৬ টন ছোলা এসেছে ভারত থেকে এবং ৩৪ হাজার ৭৩৭ টন এসেছে অস্ট্রেলিয়া থেকে। গত অর্থবছরের এই সময়ে ছিল ২৭ হাজার ৪৫৩ টন। গত বছরের তুলনায় এই সময়ে ১৫ হাজার ৬৫০ টন ছোলা বেশি আমদানি হয়েছে।

তবে গত অর্থবছরের তুলনায় মসুর আমদানি কমে এক-তৃতীয়াংশে নেমেছে। চলতি অর্থবছরের ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত মসুর ডাল আমদানি হয়েছে ৬৬ হাজার ৪৪৮ টন। এর মধ্যে ১২ হাজার ৭৫৪ টন এসেছে ভারত, ৭৫৩ টন নেপাল ও ৫২ হাজার ১৫১ টন অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে ২ লাখ ১৯ হাজার ৬৬৩ টন মসুর ডাল আমদানি হয়েছিল।

আরও পড়ুনখাতুনগঞ্জে এবার গরম মসলার দামে উত্তাপ কমখাতুনগঞ্জে নিয়ন্ত্রণহীন পাম অয়েলের দামভারত থেকে ‘পেঁয়াজ আসার খবরে’ অস্থির খাতুনগঞ্জের বাজারআদা-রসুনে ক্ষতির মুখে আমদানিকারকরা, খুচরায় বেশি লাভ

চলতি অর্থবছরের ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত খেজুর আমদানি হয়েছে ৮ হাজার ৮১ টন। এর মধ্যে ভারত থেকে এসেছে ৫৬০ টন। গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় দ্বিগুণের চেয়েও বেশি আমদানি হয়েছে। গত অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ৩ হাজার ৩০৩ টন।

চলতি অর্থবছর অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে ৪ লাখ ৫৪ হাজার ৪৭১ টন, পরিশোধিত পাম তেল আমদানি হয়েছে ১০ লাখ ৭৬ হাজার ১৬৭ টন। এরমধ্যে ১৪ হাজার টন এসেছে ভারত থেকে। গত অর্থবছরের একই সময়ে ৪ লাখ ৬২ হাজার ৯১০ টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেল ও ৯ লাখ ৫২ হাজার ৯২১ টন পরিশোধিত পাম অয়েল আমদানি হয়েছিল।

২০২৫-২৬ অর্থবছরের ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত অপরিশোধিত ও পরিশোধিত মিলে চিনি আমদানি হয়েছে ১৩ লাখ ৯১ হাজার ৫১১ টন। গত বছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ৯ লাখ ৮৫ হাজার ৭৬০ টন। গত বছরের তুলনায় এবার ৪ লাখ ৫ হাজার ৭৫১ টন বেশি আমদানি হয়েছে।

এরমধ্যে মেঘনা গ্রুপ ৫ লাখ ৭২ হাজার ৭৪৩ টন, আবদুল মোনেম সুগার রিফাইনারি ২ লাখ ৮১ হাজার ৫৫১ টন, সিটি গ্রুপ ৪ লাখ ২১ হাজার ৪৯৬ টন ও এস আলম গ্রুপ ৪৬ হাজার ১১৪ টন অপরিশোধিত চিনি এবং আকিজ গ্রুপ ২৪ হাজার ৩১ টন ও প্রাণ গ্রুপ ২৩ হাজার ৮৭৭ টন পরিশোধিত চিনি শুল্কায়ন করে। এরমধ্যে ৬২ হাজার ৩৪৩ টন পরিশোধিত সাদা চিনি এসেছে ভারত থেকে।

খালাস হওয়া এসব ভোগ্যপণ্য বাদেও পাইপলাইনে রয়েছে হাজার হাজার টন ভোগ্যপণ্য। রমজান আসার আগেই এসব পণ্য দেশে চলে আসবে। তাছাড়া রমজানের চাহিদাসম্পন্ন ভোগ্যপণ্য ছোলা, ডাল, গম, ভোজ্যতেল, চিনি ও খেজুর নিয়মিত চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে খালাস হচ্ছে।

বন্দরের তথ্য মতে, ৬০ হাজার ৪৪৯ টন ভোজ্যতেল নিয়ে আসা ‘মেঘনা ভিক্টরি’ জাহাজটিতে বহির্নোঙরে খালাস চলমান। জাহাজটিতে আরও ৩৮ হাজার টনের মতো ভোজ্যতেল রয়েছে। গত ১৮ নভেম্বর জাহাজটি চট্টগ্রামে আসে। একইদিন ৫৯ হাজার ২৮৪ টন সয়াবিন নিয়ে সিঙ্গাপুর থেকে আসে ‘একুয়াপ্রাইড’ নামের জাহাজটি। জাহাজটিতে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৬ হাজার ৩১২ টন সয়াবিন খালাসের অপেক্ষায় ছিল।

গত ২৫ নভেম্বর ৪০ হাজার ৩১১ টন সয়াবিন নিয়ে আসে ‘হারভেস্ট লিগেসি’ নামের জাহাজটি। জাহাজটিতে এখনো ৩১ হাজার ২২৭ টন সয়াবিন খালাসমান। পাশাপাশি ‘এমভি কনকারান’ ৬০ হাজার টন ভোজ্যতেল নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে আসার কথা রয়েছে। তাছাড়া ৫৭ হাজার ১০০ টন ভোজ্যতেল নিয়ে ‘ইএফই বসফরাস’ নামের জাহাজটি ৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরে আসার কথা রয়েছে।

৪ নভেম্বর ৫৪ হাজার ৫৫০ টন অপরিশোধিত চিনি নিয়ে চট্টগ্রামে আসে ‘লিমনস’ নামের জাহাজটি। ওই জাহাজে এখনো ৩২ হাজার ৮৫৮ টন চিনি খালাসের অপেক্ষায়। ৭ নভেম্বর ৬১ হাজার ৮৬ টন চিনি নিয়ে আসে ‘জল কুমুদ’ নামের জাহাজটি। ওই জাহাজে এখনো ৩৮ হাজার ২১৪ টন চিনি খালাস অবস্থায় রয়েছে। ২৫ নভেম্বর ৬০ হাজার ৩৭৭ টন চিনি নিয়ে আসে ‘ওশেন অয়েস্টেন্ডিং’। জাহাজটিতে এখনো ৩৬ হাজার ৪১৫ টন চিনি খালাস অপেক্ষায়। ৫৪ হাজার ৮০০ টন চিনি নিয়ে ২৭ নভেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে আসে ‘মায়রা বে’ নামের আরও একটি জাহাজ। এতে এখনো ৩৩ হাজার ৯৩ টন চিনি রয়েছে। ৬১ হাজার ৮০০ টন চিনি নিয়ে ২৯ নভেম্বর চট্টগ্রামে আসে ‘সেটো ইটার্নিটি’। ওই জাহাজে বর্তমানে ৩৩ হাজার ৬৩০ টন চিনি রয়েছে খালাসের অপেক্ষায়। ব্রাজিল থেকে ৬৩ হাজার ৮০০ টন অপরিশোধিত চিনি নিয়ে আগামী ৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরে আসার কথা রয়েছে ‘সিএল কিওয়ামি’র।

আরও পড়ুনখাতুনগঞ্জে নিম্নমুখী তেল-পেঁয়াজসহ নিত্যপণ্যের দামরোজার পণ্যে ভরপুর বাজারে দামও কমপেঁয়াজের দামে হঠাৎ মৌসুম শেষের অস্থিরতাএলাচের স্লিপ বেচে ৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে ব্যবসায়ীর চম্পট

এদিকে গত ২৯ অক্টোবর ৫৯ হাজার ৩৩০ টন গম ও মটর নিয়ে চট্টগ্রামে আসে ‘এডিসাইকোস’ জাহাজ। জাহাজটিতে এখনো খালাস সম্পন্ন হয়নি। ২১ নভেম্বর ৫৫ হাজার ২০০ টন ছোলা নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে ‘ডিয়ানা’। জাহাজটিতে এখনো ২৩ হাজার ২২৪ টন ছোলা খালাসের অপেক্ষায়। গত ১৫ নভেম্বর অস্ট্রেলিয়া থেকে ২২ হাজার টন মসুর ডাল নিয়ে চট্টগ্রামে ‘স্পিনাকের এসডব্লিউ’ জাহাজটি। ওই জাহাজে এখনো ১৯ হাজার ৮৩৬ টন ছোলা খালাসের অপেক্ষায়।

খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছরের তুলনায় এবার ভোজ্যতেল বাদে সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের দাম কম।

খাতুনগঞ্জের মেসার্স এম কে ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী মুহাম্মদ রফিকুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘খাতুনগঞ্জের বাজারে মঙ্গলবার চিনি বিক্রি হয়েছে প্রতি মণ ৩ হাজার ২২০ টাকা। এসব চিনি গত ফেব্রুয়ারি মাসেও প্রতি মণে এক হাজার টাকা বেশি ছিল। সয়াবিন বিক্রি হয়েছে প্রতি মণ ৬ হাজার ৮০০ টাকায়। বাজারে আবুল খায়ের গ্রুপের বাটারফ্লাই পাম অয়েল ৫ হাজার ৭৯০ ও এস আলমের ৫ হাজার ৯৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।’

তিনি বলেন, এবার রমজান সামনে রেখে প্রচুর পণ্য আমদানি হয়েছে। দামও আগের তুলনায় অনেক কম। সামনেও ভোগ্যপণ্যের দাম কম থাকবে বলে জানান তিনি।

খাতুনগঞ্জের আরেক ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, বাজারে ভোজ্যতেল ও চিনির দাম কম। চিনির দাম লাগাতার কমছে। আন্তর্জাতিক বাজারেও চিনির দাম কমেছে। যার প্রভাব পড়েছে খাতুনগঞ্জের বাজারে।

চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলহাজ মো. মহিউদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘রমজান সামনে রেখে প্রচুর এলসি (ঋণপত্র) খুলেছেন আমদানিকারকরা। মটর, মসুর ও ছোলার যথেষ্ট মজুত রয়েছে। নতুন নতুন এলসির পণ্য ঢুকছে দেশে। যার প্রভাবে পাইকারি বাজারে ছোলা-মসুরের দাম কমছে। সামনে আরও কমতে পারে। এতে বোঝা যাচ্ছে রমজানে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়বে না।’

আরও পড়ুনদেশি পেঁয়াজে ঠাসা আড়ত, দাম কম আদা-রসুনেরওখাতুনগঞ্জে ‘স্লিপ’ বেচাকেনার কুচক্রে এলাচভর্তুকি মূল্যে বিক্রির জন্য তেল-ডাল-চিনি কিনছে সরকারদরপত্র ছাড়াই ১১৫ টাকা কেজি দরে চিনি কিনছে সরকার

তিনি বলেন, ‘মসুর গত বছর বেশি আমদানি হয়েছিল। গত বছরের মসুর এখনো মজুত রয়েছে। বাজারে মসুরের দাম একেবারে কমে গেছে। অস্ট্রেলিয়ান মসুর এখন পাইকারি বাজারে কেজিপ্রতি ৭৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক মাস আগেও এসব মসুর ৮০ টাকার বেশি ছিল। বাজারে ভারতীয় মসুরের দাম কমেনি। এখন পাইকারিতেও ১৫৪ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। চিকন হওয়ায় ভারতীয় মসুর ডালের চাহিদা রয়েছে।’

এ ব্যবসায়ী নেতা বলেন, গত সোম ও মঙ্গলবার খাতুনগঞ্জে মটর ডাল বিক্রি হয়েছে ৪৩ টাকা। আস্ত মটর ৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। এক মাস আগেও এসব মটর ৪৭-৪৮ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। তাছাড়া এখন পাইকারি বাজারে ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৮৩ টাকা কেজিতে। এক মাস আগেও এসব ছোলা ১০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছিল।

খাতুনগঞ্জের লামার বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ইদ্রিস জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখন মৌসুমের শেষ সময় হওয়ায় বাজারে পেঁয়াজের দাম একটু বেশি। রসুন, আদার দাম স্বাভাবিক রয়েছে। আর কয়েকদিনের মধ্যে বাজারে নতুন পেঁয়াজ আসা শুরু করবে। আশা করছি রমজান সামনে রেখে এসব পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকবে।’

এমডিআইএইচ/এমএমএআর/এমএফএ/এমএস