মুহাম্মাদ রাহাতুল ইসলাম
শিল্পবিপ্লব গ্রেট ব্রিটেনে আঠারো শতকের শেষ থেকে উনিশ শতকের শুরুতে শুরু হয়। এর আগে মানুষের জীবনধারা মূলত কৃষিনির্ভর ছিল। কৃষকেরা নিজেদের জমিতে বা জমিদারের অধীনে কাজ করতেন। পরিবারকেন্দ্রিক কুটিরশিল্প ও গ্রামীণ জীবনই ছিল মূল কাঠামো। কিন্তু শিল্পবিপ্লব এসে সবকিছু বদলে দিলো।
শিল্পবিপ্লবের প্রথম ধাক্কা ছিল শ্রমিকের অভাব। কারখানা স্থাপিত হলেও শুরুতে সহজে শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছিল না। কারণ—১. মানুষ জমি ও কৃষির সাথে জড়িয়ে ছিল; তারা মনে করতেন, কারখানায় যাওয়া মানে অচেনা এবং অস্বস্তিকর পরিবেশে কাজ করা।২. কুটিরশিল্প ও হস্তশিল্প তখনো কার্যকর ছিল; মানুষ নিজেদের হাতে পণ্য তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করতো।৩. শহুরে পরিবেশ ছিল অস্বাস্থ্যকর ও ঝুঁকিপূর্ণ; মানুষ সেখানে যেতে চাইতো না।
ফলে শিল্পোদ্যোক্তারা প্রথমে শ্রমিক সংকটে পড়েন। তারা মানুষকে চাকরিতে টেনে আনার কৌশল অবলম্বন করেন। কৃষিনির্ভর জনগণকে কারখানায় টানতে যে প্রক্রিয়াগুলো কাজ করেছিল, তা হলো—
এনক্লোজার মুভমেন্টব্রিটেনে জমিদাররা গ্রামের সাধারণ জমিগুলোকে নিজেদের দখলে নিতে শুরু করল। কৃষকেরা যেসব জমিতে আগে গবাদিপশু চরাতো বা চাষ করতো; সেসব জমি ঘিরে দেওয়া হলো। ফলে গ্রামীণ দরিদ্ররা জমিহারা হয়ে পড়লো। জমি হারানো কৃষকেরা বেঁচে থাকার জন্য বাধ্য হয়ে শহরে কাজ খুঁজতে লাগলো।
কুটিরশিল্পের পতনকারখানার মেশিনের উৎপাদন দ্রুত ও সস্তা ছিল। ফলে হস্তশিল্পীরা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারলেন না। কাজ হারিয়ে তারাও শিল্পাঞ্চলে ভিড় জমাতে শুরু করলেন।
আরও পড়ুনআন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে পড়লে ক্যারিয়ার কেমন হবে? নিজেকে সব সময় আত্মবিশ্বাসী রাখার চেষ্টা করেছি: শারমিন
শহরে কাজের সুযোগ তৈরিশিল্পোদ্যোক্তারা নিয়মিত বেতন দিতেন। যদিও সেটা সামান্য ছিল। তবুও কৃষিজীবনের অনিশ্চিত আয়ের চেয়ে অনেকের কাছে সেটিই টিকে থাকার ভরসা হয়ে দাঁড়ালো।
রাষ্ট্রীয় আইন ও নীতিঅনেক সময় আইন করে মানুষকে বাধ্য করা হয়েছিল শ্রমবাজারে আসতে। যেমন- ভবঘুরে বা বেকার হিসেবে ধরা পড়লে শাস্তি দেওয়া হতো। দরিদ্রদের জন্য ‘ওয়ার্কহাউজ’ চালু হয়। যেখানে কঠোর পরিশ্রম ছাড়া খাবার পাওয়া যেত না।
শহরের প্রসার ও নগরায়ণশিল্পাঞ্চলে নতুন শহর গড়ে উঠতে লাগলো। গ্রামীণ মানুষেরা টিকে থাকার জন্য ধীরে ধীরে এই শহরে ভিড় জমাতে শুরু করলো।
চাকরির বাধ্যতা যেভাবে তৈরি হলো> একসময় মানুষ বুঝতে পারলো, শিল্প সমাজে টিকে থাকতে হলে জমির মালিকানা বা স্বাধীন কৃষিজীবন নয় বরং মজুরিভিত্তিক চাকরিই তাদের একমাত্র পথ।> জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাওয়ায় নগদ অর্থ অপরিহার্য হয়ে উঠলো।> শিক্ষা ও দক্ষতার পরিবর্তন নতুন প্রজন্মকে সরাসরি শ্রমবাজারমুখী করে তুললো।> সামাজিক কাঠামোর রূপান্তর মানুষকে ‘কৃষক’ থেকে ‘শ্রমিক’ বানিয়ে দিলো।
শিল্পবিপ্লব শুধু মেশিন আর কারখানা তৈরির ইতিহাস নয়; এটি মানুষকে কৃষিনির্ভর স্বাধীন জীবন থেকে মজুরিভিত্তিক নির্ভরশীল জীবনে ঠেলে দেওয়ার ইতিহাস। জমি হারানো, কুটিরশিল্প ধ্বংস হওয়া, রাষ্ট্রীয় আইন এবং নগরায়ণ—সব মিলিয়ে মানুষকে ধীরে ধীরে চাকরির দুনিয়ায় বাধ্যতামূলকভাবে প্রবেশ করানো হলো। সেখান থেকেই আধুনিক কর্মজীবী সমাজের জন্ম।
এসইউ