সরকারি চাকরিজীবীদের নতুন বেতন কাঠামো দিতে পে-কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু সম্প্রতি অর্থ উপদেষ্টা জানিয়েছেন, নতুন বেতন কাঠামোর বিষয়ে পরবর্তী সরকার এসে সিদ্ধান্ত নেবে। তবে তারা নতুন পে-স্কেলের একটা ফ্রেমওয়ার্ক রেখে যাবেন। উপদেষ্টার এ বক্তব্যে ক্ষুব্ধ প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এতদিন এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কেউ কিছু না বললেও এখন নিজেদের অসন্তোষ তুলে ধরে সরব হচ্ছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনগুলোর নেতারা ডিসেম্বরের মধ্যে নতুন বেতন কাঠামোর গেজেট জারির আলটিমেটাম দিয়েছেন। চলতি মাসজুড়ে নানান কর্মসূচির মাধ্যমে তারা সরকারের কাছে তাদের দাবি তুলে ধরবেন। ডিসেম্বরের মধ্যে গেজেট না হলে জানুয়ারি থেকে কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন সংগঠনগুলোর নেতারা।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে গঠিত জাতীয় বেতন কমিশন নিয়ে সরকারি কর্মচারীদের দীর্ঘ প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু সুপারিশ চূড়ান্তকরণ পর্যায়ে গিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, যা ন্যায্য দাবি বাস্তবায়নের পক্ষে অনুকূল নয়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও জীবনযাত্রার ব্যয় লাগামহীনভাবে বাড়ায় নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীরা মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। বেতন কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নে দেরি হওয়ায় কর্মচারীদের মধ্যে তীব্র হতাশা ও ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে।
তবে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতি পাঁচ বছর পর পর নতুন বেতন কাঠামো হওয়ার কথা থাকলেও এরইমধ্যে ১০ বছর পেরিয়ে গেছে। কর্মচারীদের আন্দোলনের দাবি যৌক্তিক। তবে অন্তর্বর্তী সরকার নতুন বেতন কাঠামো না দিলে তাদের পে-কমিশন গঠন করা ঠিক হয়নি বলেও মন্তব্য করেন তারা।
আরও পড়ুন৯ম পে-স্কেলের দাবিতে শুক্রবার মহাসমাবেশ করবেন গণকর্মচারীরানতুন পে-স্কেলের ফ্রেমওয়ার্ক দিয়ে যাবে বর্তমান সরকার সরকারি চাকরিজীবীদের বর্তমান বেতন কাঠামো ২০১৫ সালে করা হয়। সর্বশেষ ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা সাড়ে ১৪ লাখ।
বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ হুঁশিয়ারি দিয়েছে-ফাইল ছবি
গত ২৭ জুলাই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নতুন বেতন কাঠামো নির্ধারণের জন্য পে-কমিশন গঠন করা হয়। এই কমিশনের প্রধান সাবেক অর্থসচিব ও পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান জাকির আহমেদ খান। এই কমিশনকে ছয় মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।
বেতন কাঠামো ঘিরে কর্মচারীদের আন্দোলনের হুমকির বিষয়ে সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ কাজটি সরকার ঠিক করেনি। তারা যদি না-ই দেবে তবে পে-কমিশন কেন গঠন করলো, এটার দরকার ছিল না।’
প্রতি পাঁচ বছর অন্তর গণকর্মচারীদের পে-স্কেল দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও ১০ বছর কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পুনর্মূল্যায়ন হয়নি, বিষয়টি অমানবিক। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে বর্তমান বেতন কাঠামো দিয়ে নিম্ন গ্রেডের একজন কর্মচারীর পক্ষে পরিবার চালানো কোনো ক্রমেই সম্ভব নয়। সরকারের উচিত যত দ্রুত সম্ভব কর্মচারীদের পরিবারের ব্যয় বিবেচনায় নিয়ে নবম পে-স্কেল বাস্তবায়ন করা।
তিনি বলেন, ‘কর্মচারীরা আন্দোলন করবেন, তাদের এটায় তো যুক্তি আছে। সর্বশেষ পে-স্কেল হয়েছে ২০১৫ সালে, এরমধ্যে ১০ বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু প্রতি পাঁচ বছর পর পর কমিশন গঠনের কথা। এরইমধ্যে জিনিসপত্রের দাম অনেকে বেড়েছে। নতুন বেতন কাঠামো তো সময়ের দাবি।’
আরও পড়ুনশিক্ষকদের কর্মবিরতিতে সরকারি মাধ্যমিক স্কুলে আজও পরীক্ষা বন্ধপরীক্ষা না নেওয়ায় প্রাথমিক শিক্ষকের মাথা ফাটালেন অভিভাবকরা
‘এটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, তাদের হাতে সময় কম। যদি তারা নতুন বেতন কাঠানো না দিতে চায়, তবে তাদের পে-কমিশন গঠন করা ঠিক হয়নি। তারা পে-কমিশন গঠন না করলে কোনো প্রশ্ন উঠতো না। তাই সরকার কাজটি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে করেনি। এটা আনাড়ির মতো কাজ হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে তাদের বুঝে-শুনে হাত দেওয়া উচিত ছিল’ বলেন আবদুল আউয়াল মজুমদার।
পে-স্কেলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে পরবর্তী সরকারগত ৯ নভেম্বর সচিবালয়ে সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক এবং অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক শেষে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, নতুন পে-স্কেলের বিষয়ে আগামী সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।
জানুয়ারিতে কঠোর কর্মসূচিতে যেতে পারে কর্মচারীদের সংগঠনগুলো-ফাইল ছবি
এরপর গত ১২ নভেম্বর সচিবালয়ে অর্থ উপদেষ্টা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আবারও বলেন, ‘আমাদের সময় এটা (পে-স্কেল) করতে পারবো কি না, এটা কিছুটা অনিশ্চিত। আমরা মোটামুটি একটা ফ্রেমওয়ার্ক দিয়ে যাবো এবং আগামী সরকার বিষয়টি সিরিয়াসলি নেবে।
তিনি বলেন, ‘রিপোর্টটা পাওয়ার পর মোটামুটি একটা ফ্রেমওয়ার্ক দিয়ে যাবো। কারণ আমরা এই সময়ের মধ্যে যদি এটা রিকনসাল করতে পারি করবো। এখানে সবচেয়ে বড় হলো অর্থের সংস্থান।’
কর্মচারীরা আন্দোলন করবেন, তাদের এটায় তো যুক্তি আছে। সর্বশেষ পে-স্কেল হয়েছে ২০১৫ সালে, এরমধ্যে ১০ বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু প্রতি পাঁচ বছর পর পর কমিশন গঠনের কথা। এরইমধ্যে জিনিসপত্রের দাম অনেকে বেড়ে গেছে। নতুন বেতন কাঠামো তো সময়ের দাবি।
আপনারা যদি না পারেন রাজনৈতিক সরকার আসলে ঝুলে যাবে কি না, সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে- এ বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, এটাতে ক্ষোভের সৃষ্টি হওয়া অপ্রত্যাশিত। এটা তো আমি ইনিশিয়েটিভ নিয়ে, আমরাই ইনিশিয়েটিভ করেছি। ৮ বছর ওরা (সরকারি চাকরিজীবীরা) অপেক্ষা করতে পেরেছেন, এখন আমাদের ১২ মাসে আমরা একটা চেষ্টা করছি আমরা করবো। একটু ধৈর্য ধরতে হবে।
কর্মচারীদের সংগঠনগুলোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারিআগামী ১০ জানুয়ারি থেকে কঠোর কর্মসূচিতে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের একাংশ।
সংযুক্ত পরিষদের মহাসচিব নিজাম উদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, চলতি মাসের (ডিসেম্বর) মধ্যে প্রজ্ঞাপন জারি এবং আগামী ১ জানুয়ারির মধ্যে গেজেট প্রকাশ না হলে ১০ জানুয়ারি থেকে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
তিনি বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে গঠিত জাতীয় বেতন কমিশন নিয়ে সরকারি কর্মচারীদের দীর্ঘ প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু সুপারিশ চূড়ান্তকরণ পর্যায়ে গিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, যা ন্যায্য দাবি বাস্তবায়নের পক্ষে অনুকূল নয়।
মহাসচিব বলেন, ‘দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও জীবনযাত্রার ব্যয় লাগামহীনভাবে বাড়ায় নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীরা মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। বেতন কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নে দেরি হওয়ায় কর্মচারীদের মধ্যে তীব্র হতাশা ও ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে।’
আরও পড়ুনশাটডাউনে শিক্ষকরা: প্রশাসনের লোকের কাছে সন্তানের পরীক্ষায় রাজি না অভিভাবকরাশ্রেণিকক্ষের তালা ভেঙে পরীক্ষা শুরু করলেন ইউএনও
নিজাম উদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, আমরা এ বিষয়ে ৩ ডিসেম্বর অর্থ উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছি। আশা করছি তিনি এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন।
বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের অন্য অংশের সভাপতি নুরুল ইসলাম বলেন, ‘সর্বশেষ পে-স্কেল ঘোষণা করা হয়েছিল ২০১৫ সালে। সেই হিসেবে ১০ বছরের বেশি সময় পার হয়েছে। কিন্তু কোনো পে-স্কেল ঘোষণা করা হয়নি। অন্যদিকে দেশে বাজারদর প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার খরচসহ সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন।’
তিনি বলেন, ‘এ বাস্তবতা বিবেচনা করে বিগত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আজ সুবিধাবঞ্চিত সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ধীরে ধীরে ফুঁসে উঠছে পে-স্কেলের দাবিতে।’
‘সংযুক্ত পরিষদের পক্ষ থেকে একদম পরিষ্কারভাবে জানাতে চাই, পে-কমিশন গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার কাজও করে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে, অতএব এটার ঘোষণাও চাই এই অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এবং বাস্তবায়নও চাই এ সরকারের আমলে। এর বিকল্প কিছু হতে পারে না।’
আরও পড়ুন জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে রিহ্যাব নেতাদের সাক্ষাৎকেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্ভার ডাউন, ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ে ভোগান্তি
নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে পে-স্কেলের প্রজ্ঞাপন চাই এবং জানুয়ারি থেকে এটা কার্যকর করতে হবে। যদি আমাদের দেওয়া সময়সীমার মধ্যে পে-স্কেল ঘোষণা করা না হয় তবে আমরা সবাই মিলে সারাদেশে একসাথে একযোগে কঠোর কর্মসূচি দিয়ে দাবি আদায় করে ছাড়বো, ইনশাআল্লাহ।’
অন্যদিকে নবম পে-স্কেলের গেজেট জারির এক দফা দাবিতে শুক্রবার রাজধানীর শহীদ মিনারে মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছে বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী সমন্বয় পরিষদ। ৩ ডিসেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন সমন্বয় পরিষদের নেতারা।
সভায় নেতারা বলেন, ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে পে-স্কেলের গেজেট জারি না হলে গণকর্মচারীরা স্থায়ী কর্মবিরতির মতো কর্মসূচির ঘোষণা দিতে পারেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে শ্রম সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রতি পাঁচ বছর অন্তর গণকর্মচারীদের পে-স্কেল দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও ১০ বছর কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পুনর্মূল্যায়ন হয়নি, বিষয়টি অমানবিক। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে বর্তমান বেতন কাঠামো দিয়ে নিম্ন গ্রেডের একজন কর্মচারীর পক্ষে পরিবার চালানো কোনো ক্রমেই সম্ভব নয়। সরকারের উচিত যত দ্রুত সম্ভব কর্মচারীদের পরিবারের ব্যয় বিবেচনায় নিয়ে নবম পে-স্কেল বাস্তবায়ন করা।
আরএমএম/এসএইচএস/এমএফএ/জেআইএম