ফিচার

তরুণ প্রজন্মের ভাবনায় সেচ্ছাসেবক দিবস

মানব কল্যানের উদ্দেশ্যে ব্যক্তি সেচ্ছায় যে শ্রম দিয়ে থাকেন তাই সেচ্ছাসেবা। পরিবেশ রক্ষা, দুর্যোগ মোকাবেলা এবং জরুরি মুহূর্তে দ্রুত সাড়া প্রদানের জন্য সক্রিয়তার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন সেচ্ছাসেবকরা। সেচ্ছাসেবা নিছক কোনো শ্রম নয়, এর মাধ্যমে আমাদের ঝুঁকি গ্রহণের সক্ষমতা তৈরি হয় এবং নেতৃত্ব প্রদানের গুণাবলি বিকশিত হয়। তাই ৫ ডিসেম্বর সেচ্ছাসেবক দিবস নিয়ে শিক্ষার্থীদের অভিমত তুলে ধরেছেন চট্টগ্রাম কলেজ শিক্ষার্থী তৈয়বা খানম।

অজ্ঞতা দূরীকরণে কাজ করছেন সেচ্ছাসেবকরানাইমা খাতুনশিক্ষার্থী, উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগ, মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজ

প্রতিটি শিশুর মধ্যে আছে মহাবিশ্ব জয় করার স্বপ্ন ও স্পৃহা। শিশুরা ফুল হলেও সব ফুল যত্নে বেড়ে ওঠে না। অনাদরে অবহেলায় কিছু ফুল ঝরে যায় অকালে। সেইসব ঝরে যাওয়া ফুল কে পুনর্বাসনের জন্য এগিয়ে এসেছে একঝাঁক অদম্য স্বেচ্ছাসেবী নিয়ে গড়ে ওঠা সংগঠন ‘পথশিশু পুনর্বাসন ও সহায়তা ফাউন্ডেশন (পিপিএসএফ)’। অবহেলিত শিশুদের শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছে এই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি। ‘হাঁসবে শিশু ঘুচবে আঁধার, মুছবে ক্ষুধার দ্বার, পথের ধারে কেউ রবে না রাজ্য হবে তার’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছে ‘পথশিশু পুনর্বাসন ও সহায়তা ফাউন্ডেশন’। এই সংগঠনটি পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত বেশিরভাগ সদস্যই শিক্ষার্থী এবং সমাজসেবক। অস্বচ্ছল শিশুদের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দিয়ে সহায়তা করা হয় । প্রতি শুক্রবার ও শনিবার পাঠদান কর্যক্রম চলে। শুধু পাঠ্যবই এ সীমাবদ্ধ না থেকে সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশের জন্য বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এর আয়োজন করা হয়। নৈতিক শিক্ষা ও খেলাধুলায় শিশুদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়। একঝাঁক উদ্যমী স্বেচ্ছাসেবী তরুণ-তরুণী সমাজের অবহেলায় বেড়ে ওঠা শিশুদের চোখে স্বপ্ন দেখে নতুন দিগন্ত ছোঁয়ার।

সবুজ পৃথিবী গড়তে স্বেচ্ছাসেবকদের সচেতন প্রচেষ্টাবরকত আলীশিক্ষার্থী, দিনাজপুর সরকারি কলেজ।

বর্তমান আধুনিকায়নের এই যুগে বহুল আলোচিত একটি বিষয় পরিবেশ সুরক্ষা। স্বেচ্ছাসেবকরা শুধু গাছ লাগানো বা ময়লা পরিষ্কারের কাজ নয়, সামাজিক ও মানসিক সচেতনতাও ছড়াচ্ছেন। তারা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি অনেক সময় গ্রাম পর্যায়ে গিয়ে পরিবেশবান্ধব কাজ করতে উদ্ভুদ্ধ করে এবং বিভিন্ন সচেতনতামূলক কাজ করে থাকে। যেমন প্লাস্টিক কেন বর্জন করতে হবে, শুধু গাছ লাগানো নয় বরং পরবর্তীতে গাছের যত্ন নেওয়া, সচেতনভাবে পরিবেশ দূষণ না করা এবং পরিবেশের জন্য হুমকি এমন কাজ যথাসম্ভব এড়িয়ে চলা প্রভৃতি যা সমাজে স্থায়ী প্রভাব ফেলে। আর পরিবেশ কোনো আলাদা বিষয় নয়; এটা আমাদের নিত্যদিনের প্রতিটি সিদ্ধান্ত বা কাজের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। স্বেচ্ছাসেবকদের সচেতনতামূলক কার্যক্রম বা দৃষ্টিভঙ্গি সমাজে স্থাপন করতে পারলে, এটার প্রভাব নীতিনির্ধারণ পর্যন্ত পৌছাবে। বর্তমানে তাদের প্রচেষ্টায় প্রতিটি ক্যাম্পাস থেকে প্রায় সব জায়গায় পরিবেশ নিয়ে অনেকটা সচেতন। এখন এটা শুধু অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। আর চিন্তার এই পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিচ্ছে সেচ্ছাসেবকরাই।

পিছিয়ে পড়া মানুষদের সেবায় রত সেচ্ছাসেবকখন্দকার বদিউজ্জামান বুলবুলশিক্ষার্থী, আনন্দ মোহন কলেজ।

যে বয়সে বই হাতে বিদ্যালয়ে যাবে। সে বয়সেই বেচে নিতে হচ্ছে রুটি রোজগার এর পথ। থাকার জন্য নেই কোন নিরাপদ আশ্রয়স্থল, পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার তাদের কাছে এক স্বপ্ন। গায়ে জড়ানোর মতো ভালো কোনো পোশাক তারা পায় না। শীতকালে এই দুর্ভোগ প্রবল বেগে বেড়ে যায়। শত কষ্টের মাঝে তারা বিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষা অর্জন করবে এটাও তাদের কাছে এক স্বপ্ন। তাদের মূলধারায় ফেরাতে সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের তেমন ভ্রক্ষেপ নেই। নিয়তির বেড়াজালে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ আর নিদারুণ কষ্টে তাদের দিন অতিবাহিত হয়। পিছিয়ে পড়া এই সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষার আলোয় উদ্ভাসিত করতে না পারলে দেশের প্রকৃত উন্নয়ন কখনোই সাধিত হবে না। তবে আশার কথা হলো, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মাঝে শীত বস্তু বিতরণ, খাদ্য বিতরণসহ আরও নানা ক্ষেত্রে সহযোগিতার জন্য বর্তমানে অনেক কলেজ পড়ুয়া তরুণ-তরুণীরা অগ্রসর হচ্ছে। মানবিক মূ্ল্যবোধ থেকে অবহেলিত শিশুদের নিকট সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে এগিয়ে আসছেন অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। তাদের নিরলস প্রচেষ্টায় সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা শিক্ষা লাভের সুযোগ পাচ্ছে। যদিও এ প্রচেষ্টা যথেস্ট নয়। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিতে সরকারকে নিতে হবে ইতিবাচক পদক্ষেপ।

রক্তদানের মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখে প্রাণমুহাম্মদ শাফায়াত হুসাইনশিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ।

রক্ত শুধু শরীরের জীবনীশক্তি নয়, এটি একে অপরের সঙ্গে সংযোগের এক গভীর মানবিক সেতুবন্ধন। প্রতিদিন হাজারো মানুষ দুর্ঘটনা, জটিল রোগ বা প্রসবকালীন জটিলতার কারণে রক্তের জন্য হাহাকার করে। স্বেচ্ছায় রক্তদান সেসময় হতে পারে এক অনন্য আত্মতৃপ্তি। চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, একজন সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নির্দ্বিধায় তিন-চার মাস পরপর রক্ত দিতে পারেন এবং এটি ক্ষতিকর নয়। বরং নিয়মিত রক্তদানে হৃদরোগ ও ক্যানসারের ঝুঁকি কমে, উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং সংক্রামক ব্যাধি আছে কি না, তা বিনা খরচে জানা যায়। মূলত সেচ্ছাসেবকরা নিজেরা যেমন রক্তদান করেন তেমনি অন্যদেরও রক্তদানে উৎসাহিত করেন। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের বাঁচিয়ে রাখার একমাত্র অবলম্বন অন্যের রক্ত। ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সী সুস্থ ব্যক্তি, যার ওজন ৪৫ কেজির বেশি, তিনিই রক্ত দিতে পারেন। দেশের বিশাল জনসংখ্যার মাত্র ১.৫ ভাগ লোক নিয়মিত রক্তদান করলে রক্তের অভাবে একজন রোগীও মারা যাবে না। সেচ্ছাসেবকদের এই মানবিক কর্মসূচির মাধ্যমে বহু মানুষ নতুনভাবে বাঁচার একটি সুযোগ খুজেঁ পাচ্ছে সেই সঙ্গে মানবতা বেঁচে আছে পৃথিবীতে।

মানবিকতার অপর নাম সেচ্ছাসেবাফাতেমা সুলতানাশিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, নোয়াখালী সরকারি কলেজ।

স্বেচ্ছাসেবা শুধু দাতব্য কাজ নয়, এটি একটি মানবিক মূল্যবোধ এবং নাগরিক দায়িত্ববোধের প্রকাশ। ব্যক্তি যখন বিনিময়ের প্রত্যাশা না রেখেই সমাজের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করেন, তখন তা শুধু একটি কাজ নয়, হয়ে ওঠে উন্নয়নের শক্তিশালী চালিকা শক্তি। বাংলাদেশের তরুণ সমাজের একাংশ আজ নানা স্বেচ্ছাসেবী কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে জড়িত। দুর্যোগকালীন সহায়তা, রক্তদান, পথশিশুদের শিক্ষা, পরিবেশ রক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে তারা নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এখনো অনেকেই এই কার্যক্রমকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখে। ‘বেকারদের কাজ’, ‘সময় নষ্ট’ এমন মতামত শুধু অজ্ঞতার পরিচায়কই নয়, বরং তা সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তনের পথে বাধা তৈরি করে। জাতিসংঘের মতে, স্বেচ্ছাসেবকরা বৈশ্বিক উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। স্বেচ্ছাসেবী কাজ একজন মানুষকে দায়িত্বশীল, নেতৃত্বদক্ষ ও সহানুভূতিশীল করে গড়ে তোলে, যা শুধু ব্যক্তির নয়, পুরো সমাজের জন্য উপকারী স্বেচ্ছাসেবকতাকে হালকাভাবে না দেখে, বরং একে গুরুত্ব ও মর্যাদার সঙ্গে মূল্যায়ন করা উচিত। তাহলেই সমাজে গড়ে উঠবে মানবিকতা ও সচেতনতার শক্ত ভিত, যা আগামী প্রজন্মের জন্য একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথ দেখাবে।

পড়ুয়া শ্রেণি তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছেন জি. সি. দেবনাথশিক্ষার্থী, আলমগীর মনসুর (মিন্টু) মেমোরিয়াল কলেজ।

মানব উন্নয়নের নেপথ্যে কাজ করছেন একদল নীরব যোদ্ধা। তারা শিক্ষার আলো ছড়ান, বই হাতে ছুটে যান একেবারে দুর্গম অঞ্চলে। তারা ছুটে যান স্কুল‚ কলেজ‚ পাহাড় সবখানে‚ ছড়িয়ে দেন আলোর বার্তা বুঝিয়ে দেন বইপড়ার যথার্থতা। ‘বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে’র বইপড়া কর্মসূচী সেইসব স্বেচ্ছাসেবকদের হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে এবং জাগিয়ে রাখছে পড়ার আগ্রহ। এই কর্মসূচীর মাধ্যমে দেশের হাজারো তরুণ-তরুণী বইয়ের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে‚ গড়ে তুলছে পাঠাভ্যাস ও চিন্তার স্বাধীনতা। এতে করে দেশের তরুণ-তরুণীরা বিপথে না গিয়ে‚ মাদকাসক্ত না হয়ে বইপড়ে মানবিক মানুষ হওয়ার চেষ্টা করছে এবং দেশের নানা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ‘বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে’র বইপড়া কর্মসূচীর স্বেচ্ছাসেবকরা পাঠকদের হৃদয়ে পাঠের মাধ্যমে আলোর সঞ্চার করছেন। তারা পাঠাভ্যাসের মধ্য দিয়ে দেশের অধিকাংশ তরুণ-তরুণীদের ভবিষ্যতের পথ সুগম ও মসৃণ করে দিচ্ছেন। অর্থ্যাৎ বলা যায়, স্বেচ্ছাসেবকদের স্বেচ্ছাসেবী কাজের ফলেই গোটা জাতি আলোকিত হওয়ার পথ সুগম হচ্ছে।

সচেতনতা সৃষ্টিতে স্বেচ্ছাসেবকদের ভূমিকাতাসনিয়া তাবাচ্ছুমশিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম কলেজ।

সমাজে সচেতনতা সৃষ্টি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া, যেখানে স্বেচ্ছাসেবকদের ভূমিকা অপরিসীম। তারা সমাজের বিভিন্ন সমস্যা যেমন-স্বাস্থ্য সচেতনতা, নারী ও শিশু অধিকার, পরিবেশ রক্ষা, মাদকবিরোধী আন্দোলন, সড়ক নিরাপত্তা বা শিক্ষার প্রসার এসব ক্ষেত্রে সরাসরি কাজ করেন। বিশেষত, স্বেচ্ছাসেবকরা গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে গিয়ে সাধারণ মানুষদের মধ্যে এসব সমস্যার নেতিবাচক দিক, প্রতিরোধ ও প্রতিকার নিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেন। এছাড়াও তারা বিভিন্ন স্কুল, কলেজে গিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার বাস্তব চিত্র তুলে ধরেন এবং সহজভাবে সমাধানের পথ বোঝান। সর্বোপরি, বিভিন্ন ধরনের কর্মশালা, আলোচনা সভা, প্রচারপত্র বিতরণ ও মাঠ পর্যায়ের কার্যক্রমের মাধ্যমে তারা জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেন। বিশেষ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি বা সামাজিক সংকটে স্বেচ্ছাসেবকরা জীবনঝুঁকি নিয়েও কাজ করে যান। তাদের পরিশ্রম ও মানবিক উদ্যোগ সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনে এবং মানুষকে দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে। এক কথায়, স্বেচ্ছাসেবকরাই সমাজে পরিবর্তনের নীরব শক্তি, যারা মানুষকে জানার, ভাবার ও বদলানোর পথে নিয়ে যান।

আরও পড়ুনঅনলাইন জুয়া সময়ের নীরব ঘাতকমালয়েশিয়ায় শ্রমিক থেকে শিল্পপতি

কেএসকে/এমএস