আন্তর্জাতিক

এশিয়ায় এবারের বন্যা এত ভয়ংকর হয়ে উঠলো কেন, কীসের ইঙ্গিত?

এশিয়া এ বছর একের পর এক ঝড় ও অস্বাভাবিক আবহাওয়ার জেরে যে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে, তা কিছু দেশের জন্য কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে রূপ নিয়েছে। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আবহাওয়া মানচিত্রে একসঙ্গে তিনটি ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়েছিল। সেগুলো খুব বেশি শক্তিশালী না হলেও ‘অস্বাভাবিক’ ছিল বলে জানান মালয়েশিয়ার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস অধ্যাপক ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ফ্রেডোলিন তাঙ্গাং।

তার মতে, একটি ঝড় নিরক্ষীয় অঞ্চলের কাছে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা উপকূলে সৃষ্টি হয়, যেখানে সাধারণত ঘূর্ণিঝড় তৈরি হওয়ার মতো ঘূর্ণনশক্তি থাকে না। আরেকটি ছিল ঋতুর শেষ প্রান্তের ঝড়, যা ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইনের আগে থেকেই সিক্ত ভূমিতে আরও বৃষ্টিপাত তৈরি করে। তৃতীয়টি গিয়ে আঘাত হানে এমন এলাকায়, যেখানে সাধারণত ঘূর্ণিঝড় দেখাই যায় না।

সেনিয়ার, কোতো ও দিতওয়া নামে এই তিন ঝড় পরে রূপ নেয় প্রবল বর্ষণ আর বিপর্যয়কর বন্যায়। সিএনএনের হিসাব অনুযায়ী, সাম্প্রতিক এসব দুর্যোগে এশিয়ার দেশগুলোতে এরই মধ্যে ১ হাজার ৭০০র বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। বহু দেশে এখনো নিখোঁজ মানুষের খোঁজ চলছে; কেউ স্রোতে ভেসে গেছেন, কেউ বা কাদামাটির নিচে চাপা পড়েছেন।

আরও পড়ুন>>এশিয়ায় হঠাৎ দুর্যোগের ঘনঘটা, দেশে দেশে বাড়ছে প্রাণহানিএশিয়ায় এক সপ্তাহেই হাজার মানুষের প্রাণ নিলো বিধ্বংসী বন্যাএশিয়ার একদিকে বৃষ্টি-বন্যা অন্যদিকে খরা, দুর্যোগে ওষ্ঠাগত প্রাণ

অস্বাভাবিক স্থানে ‘বিরল’ ঝড়

বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ বন্যার পেছনে রয়েছে অভূতপূর্ব কিছু আবহাওয়াগত ঘটনা। সেগুলো মানুষসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আরও তীব্রতর হয়েছে।

ট্রপিক্যাল ঘূর্ণিঝড় সেনিয়ার গঠিত হয় মালাক্কা প্রণালীর নিরক্ষীয় অংশে, যেখানে ঘূর্ণিঝড় হওয়া প্রায় অসম্ভব। আরও বিরল ঘটনা হিসেবে এটি আবার দিক বদলে দক্ষিণ ও পূর্বমুখী হয়েছে, যা এই অঞ্চলের নিয়মিত ঘূর্ণিঝড়ের গতিপথের সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক।

অন্যদিকে, শ্রীলঙ্কার উত্তর ও পূর্ব উপকূলে দিতওয়ার আঘাত সেখানে অজানা এক ঝড়ের অভিজ্ঞতা এনে দেয়। আর টাইফুন কোতো ফিলিপাইনে তীব্র বৃষ্টি ও ভূমিধসের পর আগে থেকেই জলসিক্ত ভিয়েতনামের দিকে ধেয়ে যায়।

ভেজা ভূমিতে আরও বৃষ্টি

নভেম্বরের শুরু থেকেই পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে থাকে। এক সপ্তাহে দুটি টাইফুন ফিলিপাইনজুড়ে বিপর্যয় ঘটায়। ভিয়েতনামে তীব্র বন্যা ও ভূমিধসে অন্তত ৯০ জন মারা যান। দেশটির মধ্যাঞ্চলে ২৪ ঘণ্টায় ১ হাজার ৭৩৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়, যা বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।

এমনিতেই পানি-বোঝাই মাটিতে যখন তিনটি ঘূর্ণিঝড় পরপর আঘাত হানে, তখন আকস্মিক বন্যা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বিষয়টিকে অনেকটা পানিতে ভেজা স্পঞ্জের সঙ্গে তুলনা করা যায়। স্পঞ্জ পুরোপুরি ভেজা থাকলে সেটি আর পানি শোষণ করতে পারে না।

ফিলিপাইনের আবহাওয়া বিভাগের বিশেষজ্ঞ জোসেফ বাসকনসিলোর কথায়, ‘ভূপৃষ্ঠ যখন ভেজা থাকে, তখন অতিরিক্ত বৃষ্টি পড়তেই তা ভয়াবহ বন্যায় রূপ নেয়।’

আরও পড়ুন>>শ্রীলঙ্কায় বন্যা পরিস্থিতি অবনতির শঙ্কা, মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৬১১‘কেউ সাহায্য করেনি’/ কাদামাটিতে চাপা শ্রীলঙ্কার গাম্পোলায় ক্ষোভ-হতাশাবন্যার পানিতে জেগে উঠেছে মানবতা

মানবিক বিপর্যয়

বন্যায় ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রায় সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সেখানে মারা গেছেন অন্তত ৮৮৩ জন। বহু গ্রাম এখনো বিচ্ছিন্ন, রাস্তা ও সেতু ভেসে গেছে। এক ব্যক্তি টানা কয়েকদিন ধরে নিখোঁজ স্ত্রীর খোঁজ করেছেন। তার কথায়, ‘শুধু দেহ খুঁজে পেলেই শান্তি পাবো, অন্তত একটি হাত হলেও যেন খুঁজে পাই।’

শ্রীলঙ্কার ক্যান্ডি জেলার আলাওয়াতুগোদার এক বাসিন্দা বলেন, ‘একটা বজ্রপাতের মতো শব্দ পেলাম। চোখের সামনে পাশের বাড়িটা ধসে গেলো।’

থাইল্যান্ডের হাত ইয়াই শহরে আট ফুট পর্যন্ত পানি উঠে গেছে। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইনজুড়ে হাজারও পরিবার গৃহহীন হয়েছে।

জলবায়ু সংকটের নির্মম বার্তা

এশিয়া অঞ্চলটি পৃথিবীর দ্রুততম উষ্ণায়নশীল অঞ্চলের একটি। উষ্ণতা সামুদ্রিক ঝড়কে আরও বেশি শক্তি দেয়, আবার বেশি গরম বাতাস আরও আর্দ্রতা ধরে রাখে, ফলে বৃষ্টির পরিমাণ বেড়ে যায় ব্যাপকভাবে।

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, এ ধরনের ‘ক্রমাগত বিপর্যয়’ আগামী দিনগুলোতে আরও ঘন ঘন ঘটবে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও অভিযোজনের জন্য তহবিল বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন তারা।

সম্প্রতি ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত কপ-৩০ সম্মেলনে অভিযোজনের জন্য অর্থ তিনগুণ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হলেও জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে স্পষ্ট রোডম্যাপে একমত হতে পারেনি দেশগুলো।

তাঙ্গাং বলেন, ‘এটি স্পষ্ট যে, পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। এখনই সময়, দেশগুলোকে তাদের ঘরবাড়ি ও অবকাঠামোকে জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় প্রস্তুত করতে হবে।’

সূত্র: সিএনএনকেএএ/