আন্তর্জাতিক

আগে ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্ন করা উচিত: ট্রাম্পের মিত্র র‍্যান্ডি ফাইন

ফিলিস্তিনি জনগণকে ‘নিশ্চিহ্ন করা উচিত’ বলে প্রকাশ্যে মন্তব্য করে বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন মার্কিন কংগ্রেসম্যান ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মিত্র র‍্যান্ডি ফাইন। তিনি এও দাবি করেছেন, এই মন্তব্যের জন্য তাকে যদি ইসলামোফোবিক বলা হয়, তাতে তার কোনো ভয় নেই।

ফাইনের বিরুদ্ধে অনেক আগে থেকেই ইসলামবিদ্বেষী ও ফিলিস্তিনবিরোধী বক্তব্যের অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর) কংগ্রেসের একটি শুনানিতে তিনি বলেন, অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা কিছু এলাকায় যেতে পারে না। এমন ‘বৈষম্যমূলক’ বাস্তবতা সত্ত্বেও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়।

অথচ বাস্তবচিত্র হলো, ‘নিরাপত্তাজনিত কারণে’ ইসরায়েলি সামরিক কর্তৃপক্ষই পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি শহরগুলোতে বসতি স্থাপনকারীদের প্রবেশ না করার বিষয়ে সতর্কবানীসংবলিত সাইনবোর্ড লাগিয়ে রেখেছে। তবে সশস্ত্র ও ইসরায়েলি বাহিনীর সুরক্ষা পাওয়া বসতি স্থাপনকারীরা নিয়মিত ফিলিস্তিনি গ্রামগুলোতে হামলা চালান। চলতি বছর অন্তত দুজন মার্কিন নাগরিক বসতি স্থাপনকারীদের এমন হামলায় নিহত হয়েছেন।

শুনানিতে ফাইন জায়োনিস্ট অর্গানাইজেশন অব আমেরিকার প্রেসিডেন্ট মর্টন ক্লেইনকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করেন, যে জনগোষ্ঠী বারবার ইসরায়েল রাষ্ট্র ধ্বংসের ডাক দেয়, যারা এমন সাইনবোর্ডে স্বচ্ছন্দ যে যেখানে লেখা থাকে- ‘ইহুদিরা এই এলাকায় প্রবেশ করতে পারবে না’, আমরা ইহুদিমুক্ত অঞ্চল চাই। এম মানুষদের সঙ্গে কীভাবে শান্তি স্থাপন করা যায়?

তিনি আরও বলেন, দীর্ঘমেয়াদি সমাধান কীভাবে সম্ভব? নাকি অন্য কোনো পথ আছে? উত্তরে ক্লেইন দাবি করেন, ইসলামকে ‘সংস্কারের’ মধ্য দিয়ে যেতে হবে ও ‘ইসরায়েলকে একটি ইহুদি রাষ্ট্র’ হিসেবে স্বীকার করতে হবে। ক্লেইন এর আগেও মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানদের‘ফিল্থি আরব’ বা নোংরা আরব বলে গালি দিয়েছেন ও যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমানদের প্রোফাইলিংয়ের পক্ষে মত দিয়েছেন।

ক্লেইনের দাবি, কেউ এসব ব্যাপারে কথা বলতে চায় না। কারণ আশঙ্কা আছে যে তাদের ইসলামোফোবিক বলা হবে।

এরপরই রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান ফাইন আরও এক ধাপ এগিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, যারা আপনার ধ্বংস চায়, তাদের সঙ্গে কীভাবে শান্তি করবেন? আমি মনে করি, আগে আপনাকেই তাদের ধ্বংস করতে হবে।

জাতিসংঘের এক কনভেনশনের ভাষ্যমতে, জাতিগত, বর্ণগত, ধর্মীয় বা জাতীয় কোনো জনগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিক ধ্বংসের উদ্দেশ্যে হত্যাকাণ্ড, ক্ষতি করা, জন্মনিয়ন্ত্রণ বা জীবনযাপনের অনুপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা- এসবই গণহত্যার সংজ্ঞায় পড়ে।

ইসরায়েলের গাজায় চলমান যুদ্ধ, যা প্রায় ৭০ হাজার ৪০০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ও পুরো উপত্যকাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। এই যুদ্ধ ফিলিস্তিনিদের ধ্বংস করার লক্ষ্যেই পরিচালিত হয়েছে বলে বহু অধিকার সংস্থা ও জাতিসংঘ তদন্তকারীরা মত দিয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের আরব-বিরোধী বৈষম্যবিরোধী সংগঠনের (এডিসি) নির্বাহী পরিচালক আবেদ আয়ুব ফাইনের মন্তব্যের তীব্র সমালোচনা করে তাকে ব্যঙ্গ করে বলেন, তিনি হলেন বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর টেমু ভার্সন। তিনি আরও বলেন, রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট- উভয় দলের মধ্যেই তিনি অজনপ্রিয়, কারণ তার নীতি হলো ইসরায়েল প্রথম, ইসরায়েল দ্বিতীয়, ইসরায়েল তৃতীয়; আমেরিকানদের কোনো জায়গা নেই। তিনি এখন আসলে একটি বিদেশি সরকারের মুখপাত্র, তাও খুব একটা দক্ষ নন।

আয়ুব আরও দাবি করেন, ফাইনের ‘উন্মাদ, গণহত্যামূলক’ বক্তব্য প্রমাণ করে তিনি তেল-আবিবের মনিবদের সন্তুষ্ট করতেই এসব বলছেন। এটাই প্রথম নয়। চলতি বছর ট্রাম্প ও প্রভাবশালী লবি গ্রুপ এইপ্যাকের সমর্থনে প্রথমবার কংগ্রেসে নির্বাচিত হওয়া ফাইন অতীতেও বহু বার ফিলিস্তিনবিরোধী আগ্রাসী বক্তব্য দিয়েছেন।

২০২১ সালে এক পোস্টে মৃত ফিলিস্তিনি শিশুদের ছবির নিচে কেউ তাকে জিজ্ঞেস করেন, এমন দৃশ্য দেখার পরও তিনি কীভাবে ঘুমান? উত্তরে ফাইন লেখেন, খুব ভালোভাবে! ছবির জন্য ধন্যবাদ! এছাড়া এ বছরের শুরুতে গাজার দুর্ভিক্ষসংক্রান্ত এক প্রতিবেদনের নিচে তিনি মন্তব্য করেন, ক্ষুধায় মরে যাক।

গত বছর পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে নিহত মার্কিন কর্মী আইসেনুর এজগি আইগির মৃত্যুকে তিনি প্রকাশ্যে প্রশংসা করেন। লিখেন,পাথর ছুঁড়লে গুলি খেতেই হবে। আইগি একজন কম মুসলিম সন্ত্রাসী। গুলি করে মারো।

তিনি এর আগেও দাবি করেছেন যে মুসলমানদের ভয় পাওয়া ‘যৌক্তিক’। ২০২৩ সালে এক পোস্টে তিনি লেখেন, অনেক মুসলমান সন্ত্রাসী নয়, কিন্তু তারাই ‘উগ্র’, মূলধারা নয়। এখন সত্য বলার সময়, রাজনৈতিক শুদ্ধতার ভয়ে মরে যাওয়ার নয়।

এমন মন্তব্যের পরও ফাইন নিজেকে ‘হিব্রু হ্যামার’ বলে পরিচয় দেন ও সিএনএনসহ বেশ কিছু মূলধারার গণমাধ্যমে নিয়মিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত হন।

যুক্তরাষ্ট্রে ফিলিস্তিনি কমিউনিটি নেটওয়ার্কের (ইউএসপিসিএন) জাতীয় চেয়ারম্যান হাতেম আবুদাইয়্যেহ অভিযোগ করেন, রিপাবলিকান কংগ্রেস ও ট্রাম্প কেউই ফাইনের বক্তব্যের নিন্দা করেননি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘৃণা, বর্ণবৈষম্য, ফিলিস্তিনবিরোধী ও কৃষ্ণাঙ্গবিরোধী ঘৃণ্য কথা প্রতিনিয়ত শোনা যায়, কিন্তু দেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির মুখে এসব কথা শোনার মতো নয়।

আবুদাইয়্যেহ আরও বলেন, এমন মন্তব্যের প্রবণতা ট্রাম্প যুগের রাজনীতি নিয়ে এসেছে। র‍্যান্ডি ফাইনের মতো ঘৃণাপূর্ণ মানুষদের মুখে প্রকাশ্য ঘৃণামূলক বক্তব্যের জন্য তার দল বা প্রেসিডেন্ট কেউই তাকে থামায় না।

সূত্র: আল-জাজিরা

এসএএইচ