প্রবাস

স্মার্টফোন আমদানি শুল্ক থেকে শুরু করে লাগেজ ভাঙচুর, কার দায়?

বিদেশে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। প্রতি বছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়ে তারা শুধু পরিবার নয়, পুরো রাষ্ট্রকেই সচল রাখছেন। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে সেই প্রবাসীরাই এখন ক্ষোভ, অপমান এবং অনিশ্চয়তার মুখে দাঁড়িয়ে।

সম্প্রতি বিদেশফেরত যাত্রীদের ব্যক্তিগত ব্যবহারের স্মার্টফোন ও ইলেকট্রনিক সামগ্রীর ওপর উচ্চ হারে কর আরোপকে কেন্দ্র করে প্রবাসীদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। বহু প্রবাসীর অভিযোগ, ব্যক্তিগত ব্যবহার বা পরিবারের সদস্যদের জন্য আনা মোবাইল ফোনকেও বাণিজ্যিক পণ্যের মতো গণ্য করে শুল্ক আদায় করা হচ্ছে, যার হার বাস্তবতার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।

এই করনীতিকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একের পর এক প্রতিবাদী বক্তব্য ছড়িয়ে পড়েছে। কেউ কেউ আবেগের বশে রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ করার হুমকিও দিয়েছেন। যদিও বাস্তবে রেমিট্যান্স বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা সীমিত, তবু এই ক্ষোভের গভীরতা রাষ্ট্রের জন্য একটি স্পষ্ট সতর্ক সংকেত হয়ে উঠেছে।

কর সংক্রান্ত এই বিতর্কের মধ্যেই আরও ভয়াবহ অভিযোগ সামনে এসেছে-ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবাসীদের লাগেজ ভাঙচুর এবং মালামাল চুরির ঘটনা। একাধিক যাত্রী জানিয়েছেন, বিমানবন্দরে লাগেজ গ্রহণের পর তালা ভাঙা, জিনিসপত্র উধাও হওয়া এবং কখনো কখনো লাগেজই ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় পাওয়ার অভিজ্ঞতা এখন নিয়মিত হয়ে উঠছে।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ অনুযায়ী, এসব ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানালেও তারা কার্যকর সহায়তা পান না। অনেক ক্ষেত্রে দায় এড়াতে এক সংস্থা আরেক সংস্থার ওপর দোষ চাপিয়ে দেয়। এর ফলে প্রবাসীরা এক ধরনের বিচারহীনতার সংস্কৃতির মুখোমুখি হচ্ছেন।

ঢাকা বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় একাধিক সংস্থা জড়িত-এভিয়েশন সিকিউরিটি, কাস্টমস, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং এবং বেসরকারি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এই বহুমাত্রিক ব্যবস্থার ভেতরে একটি সুস্পষ্ট জবাবদিহির কাঠামো অনুপস্থিত বলেই অভিযোগ ক্রমেই জোরালো হচ্ছে।

সরকারের পক্ষ থেকে মাঝে মাঝে বলা হচ্ছে যে বিষয়টি নজরে আছে এবং তদন্ত চলছে। কিন্তু ভুক্তভোগী প্রবাসীদের কাছে এসব বক্তব্য বাস্তব সমাধান হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে না। কারণ অভিযোগের পুনরাবৃত্তি থামছে না এবং দোষীদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান শাস্তির কোনো নজিরও সামনে আসছে না।

এই পরিস্থিতি শুধু কিছু ব্যক্তিগত ভোগান্তির গল্প নয়। এটি রাষ্ট্র ও প্রবাসীদের মধ্যকার আস্থার সম্পর্কের একটি গভীর সংকট। প্রবাসীরা যদি মনে করেন দেশে ফিরলেই তাদের হয়রানির শিকার হতে হবে, তাহলে সেই মানসিক দূরত্ব দীর্ঘমেয়াদে রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যক্তিগত ব্যবহারের পণ্যের ওপর করনীতিতে স্বচ্ছতা ও মানবিকতা না আনলে এই অসন্তোষ আরও তীব্র হবে। একই সঙ্গে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় একটি স্বাধীন অভিযোগ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া এবং সিসিটিভি নির্ভর পূর্ণাঙ্গ জবাবদিহি কাঠামো গড়ে তোলা জরুরি।

রাষ্ট্র যদি সত্যিই প্রবাসীদের দেশের অগ্রগতির অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করে, তবে কর আরোপের ক্ষেত্রে যুক্তিসঙ্গত নীতি গ্রহণ এবং বিমানবন্দরে চুরি ও হয়রানির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা দেখানো ছাড়া বিকল্প নেই।

প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স কেবল অর্থের হিসাব নয়-এটি আস্থার প্রতিফলন। সেই আস্থা ভেঙে গেলে তার ক্ষতি শুধু অর্থনীতির সংখ্যায় নয়, রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তিতেই গিয়ে আঘাত করবে।

নীতিগত দ্বন্দ্ব ও সম্ভাব্য সমাধানএই সংকটের ভেতরে একটি বাস্তব ও জটিল অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব লুকিয়ে আছে, যা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। একদিকে প্রবাসীরা বিদেশ থেকে স্মার্টফোন কিনে দেশে আনছেন ব্যক্তিগত বা পারিবারিক ব্যবহারের জন্য। অন্যদিকে দেশে স্মার্টফোন আমদানিকারক ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারকে বড় অংকের কর ও ফি প্রদান করে বৈধভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছে। ফলে সরকার স্বাভাবিকভাবেই দুইপক্ষের চাপের মুখে পড়েছে।

দেশীয় বাজারে স্মার্টফোন বিক্রেতারা যদি বিদেশ থেকে কম দামে আনা ফোনের সঙ্গে কার্যকরভাবে প্রতিযোগিতা করতে না পারেন, তাহলে তারা পুরো বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছেন না। আবার এই প্রতিষ্ঠানগুলোই সরকারকে রাজস্ব দেয়, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে এবং আনুষ্ঠানিক অর্থনীতির অংশ হিসেবে কাজ করে। এই বাস্তবতা সরকারের সামনে একটি দ্বিমুখী চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে-একদিকে প্রবাসীদের অসন্তোষ, অন্যদিকে দেশীয় ব্যবসায়িক স্বার্থ।

কিন্তু এই দ্বন্দ্বের সমাধান কেবল কর বাড়িয়ে বা হয়রানিমূলক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে সম্ভব নয়। এখানে প্রয়োজন একটি কাঠামোগত, বাস্তবসম্মত এবং দীর্ঘমেয়াদি নীতিগত সমাধান।

সমাধানের একটি কার্যকর পথ হতে পারে-দেশের ভেতরে স্মার্টফোনের মূল্যকে আন্তর্জাতিক বাজারের কাছাকাছি নিয়ে আসা। যদি বাংলাদেশে সব স্মার্টফোন কোম্পানি বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো তুলনামূলক কম মূল্যে ফোন বিক্রি করে, তাহলে বিদেশ থেকে ফোন কেনার প্রবণতা স্বাভাবিকভাবেই কমে আসবে। মানুষ তখন দেশের বাজার থেকেই ফোন কিনবে, অর্থ দেশের ভেতরেই ঘুরবে এবং আনুষ্ঠানিক বিক্রির মাধ্যমে রাজস্ব আদায় নিশ্চিত হবে।

এক্ষেত্রে সরকার হয়তো প্রতি ইউনিটে তুলনামূলক কম কর পাবে, কিন্তু বিক্রির পরিমাণ যদি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়, তাহলে মোট রাজস্বের দিক থেকে সরকার শেষ পর্যন্ত লাভবানই হতে পারে। একই সঙ্গে কালোবাজার, লাগেজ নির্ভর আমদানি এবং কর ফাঁকির সুযোগও উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসবে।

এর পাশাপাশি কর কাঠামোকে আরও যুক্তিসঙ্গত ও স্বচ্ছ করা অপরিহার্য। ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য আনা একটি বা দুটি স্মার্টফোনকে বাণিজ্যিক আমদানির সঙ্গে এক কাতারে ফেলা বাস্তবসম্মত নয়। একটি স্পষ্ট, সহজ এবং মানবিক নীতিমালা থাকলে বিমানবন্দরে হয়রানি কমবে এবং দুর্নীতির সুযোগও সংকুচিত হবে।

এই পুরো প্রক্রিয়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো দুর্নীতি ও ভেজাল নিয়ন্ত্রণ। যদি সরকার আমদানি পর্যায় থেকে খুচরা বিক্রি পর্যন্ত কার্যকর নজরদারি নিশ্চিত করতে পারে, অতিরিক্ত মুনাফা ও ভেজাল রোধ করতে পারে, তাহলে বাজারে মূল্য স্থিতিশীল রাখা সম্ভব। এতে ভোক্তার আস্থা বাড়বে এবং প্রবাসীদের ওপর অপ্রয়োজনীয় চাপও হ্রাস পাবে।

সংক্ষেপে বলা যায়, এই সংকটের সমাধান কেবল শুল্কহার বৃদ্ধি বা প্রশাসনিক কড়াকড়ির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সমাধান নিহিত আছে বাজারকে প্রতিযোগিতামূলক করা, কর ব্যবস্থাকে যুক্তিসঙ্গত করা এবং প্রশাসনিক দুর্নীতিকে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার মধ্যে। সরকার যদি এই তিনটি জায়গায় একসঙ্গে ও আন্তরিকভাবে কাজ করতে পারে, তাহলে প্রবাসীদের ক্ষোভ প্রশমিত হবে, দেশীয় বাজার শক্তিশালী হবে এবং সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সম্ভব হবে।

রহমান মৃধা, গবেষক এবং লেখক, প্রাক্তন পরিচালক, ফাইজার, সুইডেনrahman.mridha@gmail.com

এমআরএম/এএসএম