খেলাধুলা

‘বড় শট খেলতে পারি, এটাই আমার শক্তির জায়গা’

মাত্র ৪ ম্যাচ আর ৭ ইনিংস, তাতেই এবার জাতীয় ক্রিকেট লিগে ব্যাট হাতে হইচই ফেলে দিয়েছেন আবু হায়দার রনি। মূল পরিচয় বোলার হলেও ব্যাট হাতে সাম্প্রতিক সময়ে নজর কেড়েছেন আলাদা করে। এবারই প্রথম জাতীয় লিগে অংশ নিয়েছে ময়মনসিংহ। দলটির হয়ে ৪ ম্যাচের ৭ ইনিংসে ৩২টি ছক্কা মেরেছেন রনি। চার মেরেছেন ৩১টি।

এই ৭ ইনিংসে ১০৫.২৫ গড়, ১১৬.৯৪ স্ট্রাইক রেটে ৪২১ রান করেছেন রনি। শুধু বাউন্ডারি থেকে করেছেন ৩১৬ রান। এবারের জাতীয় লিগে আর কোনো ব্যাটার ১৫টি ছক্কাও মারতে পারেননি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৩ ছক্কা হাঁকিয়েছেন খুলনা অধিনায়ক জিয়াউর রহমান। জাতীয় দলের হয়ে ২ ওয়ানডে ও ১৩টি টি-টোয়েন্টি খেলেছেন রনি। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার হুট করে থমকে যাওয়া এই পেসার সাম্প্রতিক সময়ে ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করছেন। জাতীয় দলে ফেরা, ব্যাটিংয়ে রান করা ছাড়াও ক্যারিয়ার নিয়ে জাগোর নিউজের সঙ্গে খোলামেলা আলাপ করেছেন রনি।

জাগো নিউজ: জাতীয় ক্রিকেট লিগ কেমন গেল?রনি: আলহামদুলিল্লাহ ভালোই গেছে, নিজের ডিভিশনে খেলতে পারছি প্রথম বছর। সবমিলিয়ে আলহামদুলিল্লাহ খুবই ভালো টুর্নামেন্ট গেছে। সবাই চেষ্টা করছে। আনফরচুনেটলি লাস্টের ম্যাচটা আমরা একটু বাজে খেলে ফেলছি আরকি! নাহলে তো চ্যাম্পিয়ন হওয়ার চান্স ছিলো। প্রথমবার সুযোগ মানে প্রথমবার ময়মনসিংহ নামে খেলে চ্যাম্পিয়ন হইলে পরে এটা একটা বাড়তি ইয়ে হইতো। হিস্ট্রিতে থাকতো যে প্রথমবার ময়মনসিংহ হয়ে চ্যাম্পিয়ন। আমরা এই চান্সটা মিস করে ফেলছি আরকি। তবে ওভারঅল আমরা সবগুলা ম্যাচই ভালো খেলছি। শুধু লাস্ট ম্যাচটা একটা ইনিংস একটু খারাপ ব্যাটিং করে ফেলছি। বোলিংও ভালো হইছে তবে ব্যাটিংটা একটু ফার্স্ট ইনিংসে কলাপস করে গেছে।

জাগো নিউজ: কোনো পরিকল্পনা ছিলো আপনার টুর্নামেন্ট শুরুর আগে ব্যক্তিগতভাবে? সেটা কি পূরণ হয়েছে?রনি: পরিকল্পনা ছিলো। ভালো করার তো অবশ্যই ইচ্ছা ছিলো। মূল লক্ষ্য ছিলো আমার প্লেয়ার অব দ্য টুর্নামেন্ট হওয়ার। হয়তো সবগুলা ম্যাচ খেললে সেটার কাছাকাছি চলে যেতাম। হয়তো যে প্ল্যান বা যে টার্গেট নিয়ে শুরু করেছিলাম, এটা হয়তো হয়ে যেতো। তবে আলহামদুলিল্লাহ, যা হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ।

জাগো নিউজ: হংকং সিক্সেস বা ইমার্জিং এশিয়া কাপ থেকে এই জাতীয় লিগ। সব জায়গায়ই দুর্দান্ত ব্যাটিং করছেন। ব্যাটিংয়ে এই ধারাবাহিকতার রহস্যটা কী আসলে?রনি: রহস্য নাই ভাই কোনো। আমি আসলে ব্যাটিংটা এনজয় করি। মানে ব্যাটিং আমি কখনোই চাপ হিসেবে নেই না। এটাই হয়তো ব্যাটিংয়ে ভালো করার পেছনে মূল কারণ। কারণ আমি যখন ব্যাটিংয়ে যাই, তখন আমি একটা সিম্পল একটা প্ল্যান রাখি যে, যে জায়গায় আমার স্ট্রেন্থ ওইখানে বল আসলে আই উইল গো ফর ইট। এইজন্য হয়তো আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ দিচ্ছে, ভালো করতেছি।

জাগো নিউজ: যে ইনিংসটা খেলেছেন ১৪১ রানের, যেকোনো মেইন ব্যাটারও এই ইনিংস নিয়ে গর্বিত হবে। সব মিলিয়ে এই ইনিংসের অনুভূতি...রনি: ইনিংসটা খুবই স্পেশাল আমার জন্য। খুবই খুবই স্পেশাল। কারণ আপনি দেখেন, এই মৌসুমে এনসিএলে আমি দুইটা ১০০ করেছি, একটা ৯৭। একটা ১০০ মিস করে ফেলেছি তিন রানের জন্য। আমি যে ১০০ গুলো করেছি, সব সবগুলাই কিন্তু শেষের দুই ব্যাটারকে নিয়ে। মানে ১০ নাম্বার ১১ নাম্বার ব্যাটারকে নিয়ে ১০০ করেছি। অবশ্যই চ্যালেঞ্জিং ছিলো আমার জন্য। আগের বছরগুলাতেও রান করেছি।

গত তিন-চার বছর ধরে আমি তিনশ প্লাস রান করতেছি আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু ১০০ কখনো হয় নাই। কারণ আমার সাথে কোনো ব্যাটার থাকতো না। আমি যেদিন বড় ইনিংস খেলতাম বা আমি যখন ৫০ করে ফেলতাম, তখন আসলে ওই যোগ্য সঙ্গীটা সাথে থাকতো না। এইবার একটা প্ল্যান করেছিলাম যে, যখন এমন উইকেট পড়ে যাবে; লাস্টে এক উইকেট বা দুই উইকেট থাকবে তখন পজিটিভ খেলবো। একটু অ্যাটাকিং ক্রিকেট খেলবো। আমার কাছে মনে হয় এইবার রানটা বড় হওয়ার পেছনে এটা একটা ভালো প্ল্যান ছিলো আমার।

জাগো নিউজ: এবার আপনি সাত ইনিংস ব্যাটিং করেই ৩২টি ছক্কা মেরেছেন। দ্বিতীয় যে আছে সে ১৫টিও মারতে পারে নাই। পুরো টুর্নামেন্টটা খেলতে পারলে হয়তো সংখ্যাটা আরও বাড়তো। বিগ হিটিং নিয়ে কি কারো সঙ্গে বা কারো পরামর্শে আলাদা কোনো কাজ করেছেন?রনি: আলাদা করে আসলে ওইভাবে কাজ করা হয়নি। আমার ছোট থেকেই ব্যাট সুইং ভালো ছিলো আলহামদুলিল্লাহ। ছোট থেকে বড় বড় ছয় মারতে পারতাম। আসলে মেইন প্রবলেমটা হচ্ছে, মাঝে মাঝে আমার শেপটা ঠিক থাকতো না। যখন আমি বড় শট মারতে যাই বা আগে যখন বড় হিট করতে যেতাম তখন হয়তো বডির ব্যালেন্সটা বা যে শেপ নিয়ে মারা দরকার ওই শেপটা আমার থাকতো না। এখন এটা আগের থেকে অনেক ভালো আছে। এইজন্যই হয়তো বড় বড় ছয় মারতে পারছি বা ছয় বেশি মারতে পারছি। মনে হয় যে এই বেসিকগুলো একটু ঠিক হওয়াতে এখন আগের থেকে ভালো হিট করতে পারছি।

জাগো নিউজ: নির্দিষ্ট করে বলা যায় যে, ঠিক কোন বেসিকটা আপনি ঠিক করেছেন?রনি: আমাদের বল চুজ করাটাও ইম্পর্টেন্ট। মানে বেসিকটা অবশ্যই আছে। আপনি যখন বড় শট খেলবেন, তখন যেন আপনার বডিটা একটা সুন্দর শেপে থাকে। যাতে আপনি আগে উঠে না যান বা একটু পরে না মারেন। মানে টাইমিংটাও ইম্পর্টেন্ট, সাথে হচ্ছে বডির ব্যালেন্সটাও। আর হচ্ছে বল চুজ করাটা ইম্পর্টেন্ট যে প্রত্যেকটা ব্যাটারের কিন্তু এক একটা জোন থাকে বা একটা পারফেক্ট একটা লেন্থ থাকে, যে লেন্থে আসলে এই বল আমি ছয় মারতে পারি যেকোনো সময়। এই লেন্থটা পিক করা ইম্পর্টেন্ট। আমি আসলে চেষ্টা করেছি এবার আমার জোনে যে বলটা আসবে, এইটা ইনিংসের ফার্স্ট বল হোক আর লাস্ট বল হোক আই উইল গো ফর ইট। আমি আসলে এভাবেই খেলেছি এবার। আমার আমার জোনে যে বলটা এসেছে, মিস করি নাই।

জাগো নিউজ: ১৪১ রানের ইনিংসে আপনি ছক্কা মেরেছেন ১৩টা। এই জিনিসটা আপনাকে কতটা কনফিডেন্স দিচ্ছে নেক্সট সিরিজগুলোর জন্য? রনি: আমার ব্যাটিংয়ের শক্তিই হচ্ছে, আমি বড় শট খেলতে পারি। আর ব্যাটিং যেহেতু ভালো হয়েছে, অবশ্যই এটা ব্যাক অব দ্য মাইন্ড একটা পজিটিভ ফিডব্যাক দিবে। বোলিংয়ের পাশাপাশি যদি আমি এভাবে ব্যাটিংটা কন্টিনিউ করতে পারি, তাহলে আমি যে টিমে খেলবো ওই টিমের জন্য পারফর্ম করা খুব ইজি হবে। আশা করি যে এই পজিটিভ মেমোরিজগুলো নিয়ে ইনশাল্লাহ সামনের টুর্নামেন্টে ঢুকতে পারবো।

জাগো নিউজ: আপনি যখন ফোকাসে আসলেন, জাতীয় দলে অভিষেক হলো বা বিপিএল দিয়ে আপনাকে যখন সবাই চিনলো; সবাই জানতো যে একজন লেফট আর্ম পেসার যে ব্যাট হাতে হচ্ছে কিছুটা রান করতে পারে। এরপর লাস্ট কয়েকটা সিরিজ বা কয়েকটা বছর আপনি ধারাবাহিকভাবে রান করে যাচ্ছেন। ব্যাটিং নিয়ে একদম এভাবে সিরিয়াস হওয়ার চিন্তাটা ঠিক কখন আর কীভাবে আসলো?রনি: আসলে ব্যাটিং নিয়ে আমি কখনোই ওইভাবে আমি সিরিয়াস না। ব্যাটিংটা আমি অনেক এনজয় করি। আমার ব্যাটিংয়ে যখন যাই, আমি চেষ্টা করি। কারণ আমার ব্যাটিং করতে ভালো লাগে। বোলিংয়ের পাশাপাশি ছোট থেকেই আমার ব্যাটিং করতে ভালো লাগতো। যখন দেখলাম যে আলহামদুলিল্লাহ বড় বড় রান হচ্ছে বা ৫০ করতে পারছি ৪০ করতেছি। তখন আসলে আমি আমার রোলটাও বুঝতে পারছি যে, আমি যদি একটু চেষ্টা করি তাহলে আমার দ্বারা আরেকটু ভালো ব্যাটিং করা পসিবল।

তখন ব্যাটিংটাকে একটু সিরিয়াসলি নেই। আমার ব্যাটিংয়ের একটা স্টাইল আছে। এটা আমি বের করার চেষ্টা করেছি। ওই জোনগুলা দিয়ে আমি কাজ করার চেষ্টা করেছি। মিজানুর রহমান বাবুল স্যারের সাথে ব্যাটিং নিয়ে কাজ করেছি। তারপরে আমাদের টাইগার্সে জেমস সিডনস একবার এসেছিলো, তার সাথেও আমি ব্যাটিং নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করেছি। আমার কাছে মনে হয় যে ছোট ছোট যে কাজগুলো করেছি, তাতে আমার ব্যাটিংটা এখন আগের থেকে আরেকটু সুন্দর হয়েছে। এখন ম্যাচের যে সিচুয়েশনগুলো আছে, এগুলাও আগের থেকে ভালো রিড করতে পারি। সবকিছু মিলিয়ে এখন আলহামদুলিল্লাহ আগের থেকে ভালো একটা টাচে আছি ব্যাটিংয়ে।

জাগো নিউজ: আপনি যে জায়গাতে ব্যাটিং করেন বেশিরভাগ সময় টেইল এন্ডারদের নিয়েই ব্যাটিং করতে হয়। এই সময় মানসিক চাপটা কীভাবে সামলান বা আপনার যে পার্টনার থাকে, তাকে কীভাবে কী ডিরেকশন দেন...রনি: আসলেই তখন মানসিক একটা প্রেসার থাকে। একদম লাস্টে যারা ব্যাটিং করতে আসে, ওদেরকে তো আসলে আপনি ওইভাবে বলেকয়ে খেলানোটা ভেরি টাফ। কারণ ওদের বেসিকটা হয়তো স্ট্রং থাকে না। আরেকটু ভালো বল হলে ওদের আউট হয়ে যাওয়ার চান্স বেশি থাকে। যখন নিচের দিকের ব্যাটারররা আসে, আমি ওদের সাহস দেই যে ভয় পাওয়ার কিছু নাই। তুমি ডিফেন্স করো। মারতে যেয়ে আউট হইয়ো না। তুমি যদি ডিফেন্স করে আউট হয়ে যাও আই হ্যাভ নো প্রবলেম। বাট তুমি যদি মারতে গিয়ে আউট হও, তাহলে কিন্তু প্রবলেম। এরকমভাবে আমি ওদের সাথে একটু কমিউনিকেট করার চেষ্টা করি। আর যখন শেষের দুই ব্যাটার থাকে, আমি চেষ্টা করি বেশিরভাগ বল যেন নিজে খেলতে পারি। সবসময় চিন্তা থাকে ও যেন কম বল ফেস করতে পারে। আর সবসময় মোটিভেট করার চেষ্টা করি যে, তুমি পারবা তুমি ভালো ব্যাটার। মানে তুমি ব্যাট সোজা রাখলে তোমাকে আউট করতে পারবে না। এরকম করে আরকি চেষ্টা করি যেন ওরা আমাকে একটু সাপোর্ট দিতে পারে।

জাগো নিউজ: বোলিং তো আপনার আছে, ব্যাটিংয়েও রান করছেন। মানে এখন মোটামুটি আপনি একটা সেটেল জায়গায় আছেন পেস বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে। জাতীয় দলে তো এই জায়গাটা গ্যাপ আছে। পেস বোলিং অলরাউন্ডার সেভাবে নেই। আপনি নিয়মিত পারফর্ম করেও সুযোগ হচ্ছে না। হতাশা কাজ করে কিনা?

রনি: হতাশার কিছু নেই, আক্ষেপেরও কিছু নেই। সুযোগ পাওয়া তো আমার হাতে না ভাই। এগুলো যখন আসবে, তখন লুফে নিতে হবে। এবার যেমন ইমার্জিং রাইজিং স্টারে গিয়েছিলাম, সেখানে আমি বেশি ভালো করতে পারিনি। সুযোগ এসেছিলো, নিতে পারিনি। এটা সম্পূর্ণ আমার ব্যর্থতা। ওখানে যদি আমি ভালো করতাম, তাহলে হয়তো আমার জন্য সামনের সুযোগগুলো আরও বেশি আসতো। পারিনি। তবে এটাই ক্রিকেট। আমি এসব নিয়ে একটুও বিচলিত না। কারণ আমি জানি আমি কেমন খেলোয়াড়, আমি কী করতে পারি।

একটা টুর্নামেন্ট গিয়ে বা সিরিজ দিয়ে আসলে কোনো খেলোয়াড়কে যাচাই করা উচিত না। আমি আমাকে তা করি না। কারণ আমি জানি আমি কী করতে পারি। একটা টুর্নামেন্ট খারাপ গিয়েছে, এটা কোনো সমস্যা না। এটা আমি ভুলে গেছি। এখন চেষ্টা করছি যে টুর্নামেন্টগুলো সামনে আসবে, সেগুলোতে ভালো খেলার। আর ভালো করলে সুযোগ আসবেই। সেটাই চেষ্টা করছি।

জাগো নিউজ: বিপিএল তো সামনে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপও আছে সামনে। হয়তো বিপিএলে ভালো করলে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে একটা সুযোগ আসতে পারে। এটা নিয়ে কোনো পরিকল্পনা ঠিক করেছেন কিনা?রনি: কোনো প্ল্যান সেট করা নাই ভাই। সামনে বিপিএল আসবে, চেষ্টা করবো বিপিএলে খেলার। বিপিএলেই দল পাচ্ছিলাম না, আপনি বিশ্বকাপের চিন্তা করতেছেন। বিপিএলে কেউ নিতে চায় না। সারাবছর পারফর্ম করেও বিপিএলে দল পেতে কষ্ট হয়ে যায়। দল পেয়েছি আলহামদুলিল্লাহ। এখন চেষ্টা করবো ভালো করতে।

এসকেডি/এমএমআর/এএসএম