আরিফুল ইসলাম (২৩)। গত ১১ নভেম্বর বিড়ালের আঁচড়ে বেশ গভীর ক্ষত হয়েছে তার। দৌড়ে রাজধানীর মালিবাগ থেকে মহাখালীতে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে যান। সেখানে তাকে রেবিস ভিসি টিকা দেওয়া হয়। তবে রেবিস আইজি (২৭২০ আইইউ) বাইরে থেকে কিনে দিতে বলা হয়। কারণ হাসপাতালে ওই টিকা নেই। বাইরের ফার্মেসিতে এর মূল্য দুই হাজার ৮০০ থেকে তিন হাজার টাকা।
হাসপাতালের সামনেই এই তরুণ আক্ষেপ করে জাগো নিউজকে বলেন, ‘এই ভ্যাকসিন কেনা আমাদের জন্য কষ্টকর। কই পাবো এত টাকা? সরকারি হাসপাতালে আসছি। আশা করেছিলাম বিনামূল্যে পাবো। কিন্তু তারা তাড়িয়ে দিলো।’
একই অবস্থা হয় ২০২৪ সালের ২১ অক্টোবরে সাতক্ষীরার সন্তান প্রিয়তির (১৩) ক্ষেত্রেও। ঢাকার উত্তরার বাসায় বিড়াল আঁচড় দেয় তাকে। সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে গেলে তাকেও বাইরে থেকে রেবিস আইজি (২৬৪০ আইইউ) কিনে দিতে বলা হয়। সে হাসপাতালের পাশের ফার্মেসি থেকে দুই হাজার ৬৫০ টাকায় টিকা কিনে এনে দিয়েছে।
শুধু আরিফ ও প্রিয়তিই নয় প্রতিদিন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রোগীরা হাসপাতালে গিয়ে এই পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন।
আরও পড়ুনজলাতঙ্কের ভ্যাকসিন নেই, দুশ্চিন্তায় রোগীরাদিবস পালনে তিন বছর পর দেখা মিললো জলাতঙ্ক ভ্যাকসিনেরটাঙ্গাইলে সরকারি হাসপাতালে মিলছে না জলাতঙ্কের টিকা
সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালসহ কিছু জেলা সদর হাসপাতালে রেবিস ভিসি টিকার সরবরাহ থাকলেও রেবিস আইজি নেই। আর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে এর কোনোটিরই সরবরাহ নেই। এতে অতিরিক্ত টাকা খরচ করে টিকা নিতে হচ্ছে আক্রান্ত রোগীদের।
কুকুর, বিড়াল, বানর, বাদুর, বেজি, শিয়ালসহ অন্যান্য হিংস্র প্রাণী কামড়/আঁচড় দিলে জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। প্রাণীটি যদি জলাতঙ্কের জীবাণু বহন করে, কেবল সে ক্ষেত্রেই জলাতঙ্ক ছড়াতে পারে। কিন্তু প্রাণীটিকে যদি জলাতঙ্কের টিকা দেওয়া থাকে, তাহলে সেটির আঁচড় বা কামড়ে জলাতঙ্কের টিকা নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
চিকিৎসকদের তথ্যমতে, জলাতঙ্ক রোগের টিকা দুই ধরনের, রেবিস ভিসি ও রেবিস আইজি। টিকার সংখ্যা নির্ভর করে ঝুঁকির ওপর। তবে সাধারণত কামড়ানোর/আঁচড়ের পর চারটি ডোজ (০, ৩, ৭ ও ১৪ দিন) অথবা আধুনিক প্রোটোকল অনুযায়ী দুইটি বা তিনটি ডোজ (০, ৭ এবং ২১/২৮ দিন) দেওয়া হয়, যা আক্রান্ত স্থানের তীব্রতা এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। আগে টিকা না নেওয়া থাকলে সাধারণত চারটি ডোজ প্রয়োজন হয়। কামড়/আঁচড়ে ক্ষত বেশি না হলে বা ক্ষত না হলে রেবিস ভিসি দেওয়া হয়। ক্ষত হলে রেবিস আইজি দিতে হয়। কার কোনটা কী পরিমাণ প্রয়োজন তা চিকিৎসক দেখে ঠিক করেন।
সম্প্রতি সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের টিকেট কাউন্টার ও চিকিৎসকদের কক্ষের সামনে রোগী ও স্বজনদের ভিড়। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর চিকিৎসক দেখানোর সুযোগ পান তারা। রোগীদের দেখার পর রেবিস আইজি টিকার প্রয়োজন পড়লে তা বাইরে থেকে কিনে আনার পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা।
আরও পড়ুনমাদারীপুরে সরকারি হাসপাতালে নেই টিকা, ভোগান্তিতে রোগীরাকুকুর আতঙ্কে এলাকাবাসী, হাসপাতালে নেই জলাতঙ্কের টিকাচাঁদপুরে বেওয়ারিশ কুকুরকে দেওয়া হচ্ছে জলাতঙ্কের টিকা
রেবিস আইজি টিকা বাইরে থেকে কেনার ব্যাপারে চিকিৎসকদের বক্তব্য জানতে চাইলে তারা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের সঙ্গে কথা বলার অনুরোধ করেন।
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আরিফুল বাশারের দপ্তরে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি। তিনি মুঠোফোনে জাগো নিউজকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে রেবিস আইজির সরবরাহ নেই, যার কারণে দেওয়া যাচ্ছে না।’
সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের দেওয়ালেও এ সংক্রান্ত নোটিশ আছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘অত্র সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল, মহাখালী, ঢাকা-১২১২ এর ওপিডি/জরুরি বিভাগে আগত কুকুর, বিড়াল, শৃগালসহ অন্যান্য হিংস্র প্রাণীর কামড়/আঁচড়ে আক্রান্ত রোগী ও আত্মীয়-স্বজনদের জানানো যাচ্ছে যে, সিডিসি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মহাখালী ঢাকা কর্তৃক ভ্যাকসিন রেবিস ইমোনোগ্লোব্লিন- (1000 Unit per vial) সরবরাহ/বরাদ্দ না থাকার কারণে অত্র হাসপাতালে জাতীয় জলাতঙ্ক নির্মূল সেন্টারে উক্ত ভ্যাকসিনটি পুশ করা সম্ভব হচ্ছে না। উক্ত ঔষধটি নিজ দায়িত্বে ক্রয়/সংগ্রহ করার জন্য বিনীত অনুরোধ করা হলো। কিনে এনে জমা দিলে পুশ করে দেওয়া হবে। এ বিষয়ে আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত এবং সকলের সার্বিক সহযোগিতা কামনা করা যাচ্ছে।’
সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে রেবিস ভিসি টিকার সরবরাহ থাকলেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে জলাতঙ্কের কোনো টিকারই যথাযথ সরবরাহ নেই।
হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. ইকবাল হুসাইন জাগো নিউজকে বলেন, ‘রেবিস ভিসি বা আইজি কোনোটারই সরবরাহ নেই। আমরা চাহিদা পাঠিয়েছি। এলে দিতে পারবো।’
তবে হবিগঞ্জ জেলা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আমিনুল হক সরকার জাগো নিউজকে বলেন, ‘জলাতঙ্কের টিকা রেবিস ভিসি আছে। রেবিস আইজির সরবরাহ নেই।’
চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শারমীন আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের এখানে দীর্ঘদিনই জলাতঙ্কের টিকার সরবরাহ নেই। সামনে আসবে এমনটা জেনেছি। তবে, আমাদের কাছে কোনো রোগী এলে জেলা সদরে পাঠাই, সেখানে আছে।’
আরও পড়ুনবিশ্বে ১৫০ দেশে জলাতঙ্ক, আর্থিক ক্ষতি ৮.৬ বিলিয়ন ডলাররাঙ্গামাটিতে জলাতঙ্কের গণটিকাদান কর্মসূচিহাসপাতালে দুই মাস ধরে নেই জলাতঙ্কের টিকা
কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শাহ মো. মুহিবুল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের উপজেলায় জলাতঙ্কের টিকার সরবরাহ নেই। কেউ কিনে এনে দিলে পুশ করে দেই। জেলা হাসপাতালে ফ্রি পাওয়া যায়।’
এদিকে জলাতঙ্কের টিকার সরবরাহ সংকট প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সেই আওয়ামী লীগ আমল থেকেই অনেকগুলো অপারেশনাল প্ল্যান (ওপি) বন্ধের অজুহাত দিয়ে আসছে। সর্বশেষে এ বছরের অক্টোবর মাসেও ওপি বন্ধ থাকায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (সিএমএসডি) টিকা কেনার কথা জানিয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরবরাহ স্বাভাবিক হয়নি।
জলাতঙ্কের টিকার সরবরাহ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত প্রাক্তন লাইন ডিরেক্টর ও বর্তমানে একই শাখায় কর্মরত অধ্যাপক ডা. হালিমুর রশীদ জাগো নিউজের কাছে দাবি করেন, ‘এখন পর্যন্ত ভ্যাকসিন আছে। পরবর্তী ক্রয়ের প্রক্রিয়াও চলমান।’
সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালেই কেউ রেবিস আইজির টিকা পাচ্ছে না জানালে তিনি বলেন, ‘যে কোম্পানির সরবরাহ করার কথা তারা সরবরাহ করতে পারছে না।’
এসইউজে/এমএমএআর/এএসএম