হঠাৎ কোনো দুর্ঘটনা, স্ট্রোক বা মারাত্মক মাথার আঘাতের পর চিকিৎসকের মুখে শোনা যায়-রোগী ব্রেন ডেথ। শব্দটি শুনলেই পরিবার ও স্বজনদের মধ্যে বিভ্রান্তি, শোক আর নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। রোগী তো শ্বাস নিচ্ছে, বুক উঠানামা করছে। তাই বাইরে থেকে ‘জীবিত’ মনে হলেও বাস্তবে তিনি আর বেঁচে নেই।
আসলে ব্রেন ডেথ মানে কী, আর সাধারণ মৃত্যুর সঙ্গে এর পার্থক্যই বা কোথায়-এই বিষয়গুলো পরিষ্কারভাবে জানা জরুরি।
ব্রেন ডেথ কেন হয়মস্তিষ্ক স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে হলে নিয়মিত রক্ত ও অক্সিজেনের সরবরাহ অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু কোনো গুরুতর দুর্ঘটনা, আঘাত বা জটিল রোগের কারণে যদি হঠাৎ করে মস্তিষ্কে রক্ত ও অক্সিজেনের প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা দ্রুত নষ্ট হতে শুরু করে। এই অবস্থাই অনেক সময় ব্রেন ডেথের দিকে নিয়ে যায়।
এছাড়া মস্তিষ্কের রক্তনালি ফেটে যাওয়া বা মারাত্মক রক্তক্ষরণ হলেও একই ধরনের সংকট তৈরি হতে পারে। রক্তক্ষরণের ফলে মস্তিষ্কের ভেতরে চাপ বেড়ে যায় এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মস্তিষ্কের কোষ একবার স্থায়ীভাবে নষ্ট হয়ে গেলে সেগুলো আর নতুন করে তৈরি হয় না। তাই ক্ষতির মাত্রা যদি খুব বেশি হয়, তাহলে মস্তিষ্ক আর আগের অবস্থায় ফিরে আসতে পারে না। এই স্থায়ী ক্ষতিই ব্রেন ডেথের মূল কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
ব্রেন ডেথের কারণব্রেন ডেথের পেছনে বেশ কিছু গুরুতর শারীরিক জটিলতা দায়ী হতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-১. গুরুতর মাথায় আঘাত বা ট্রমাটিক ব্রেন ইনজুরি, যেখানে দুর্ঘটনা বা পতনের কারণে মস্তিষ্ক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
২.মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বা ইন্ট্রাসেরিব্রাল হেমোরেজ, যা হঠাৎ করে মস্তিষ্কের ভেতরে চাপ বাড়িয়ে দেয়।
৩. সাবঅ্যারাকনয়েড হেমোরেজ, যেখানে মস্তিষ্কের আবরণীর ভেতরে রক্তক্ষরণ ঘটে।
৪. ইস্কেমিক স্ট্রোক, যখন মস্তিষ্কের কোনো অংশে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
৫. হার্ট অ্যাটাক, যার ফলে পুরো শরীরের সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কেও অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হতে পারে।
৬. অক্সিজেনের অভাবে মস্তিষ্কের ক্ষতি বা হাইপক্সিক ইস্কেমিক ব্রেন ইনজুরি, যা শ্বাসরোধ বা দীর্ঘ সময় শ্বাস বন্ধ থাকার কারণে হতে পারে।
৭. মেনিনজাইটিস বা এনসেফালাইটিসের মতো মস্তিষ্কের সংক্রমণ, যা মারাত্মক প্রদাহ সৃষ্টি করে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা নষ্ট করে দেয়।
কীভাবে চিকিৎসকরা ব্রেন ডেথ ঘোষণা করেনব্রেন ডেথ ঘোষণা করা কোনো সাধারণ সিদ্ধান্ত নয়। এটি অত্যন্ত সংবেদনশীল ও জটিল একটি প্রক্রিয়া। সাধারণত এই সিদ্ধান্ত নেন অভিজ্ঞ নিউরোলজিস্টরা।
নির্দিষ্ট আন্তর্জাতিক গাইডলাইন অনুসরণ করে তারা একাধিক ধাপে পরীক্ষা করেন। রোগীর কোনো ধরনের রিফ্লেক্স কাজ করছে কি না, মস্তিষ্কের স্টেমের কার্যক্ষমতা আছে কি না, নিজে থেকে শ্বাস নেওয়ার ক্ষমতা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়েছে কি না-সবকিছুই পর্যবেক্ষণ করা হয়। প্রতিটি ধাপ লিখিতভাবে নথিভুক্ত করা হয় এবং প্রয়োজন হলে একাধিক চিকিৎসকের মতামত নেওয়া হয়।
একবার যখন সব পরীক্ষায় নিশ্চিত হওয়া যায় যে মস্তিষ্ক স্থায়ীভাবে কাজ করা বন্ধ করেছে, তখনই ব্রেন ডেথ ঘোষণা করা হয়। আইন অনুযায়ী, এই ঘোষণার তারিখ ও সময়ই ব্যক্তির মৃত্যুর সময় হিসেবে গণ্য হয়, এমনকি যদি যন্ত্রের সাহায্যে হৃদস্পন্দন কিছু সময় চলমান রাখা হয় তবুও। ব্রেন ডেথ ঘোষণার আগে যে বিষয়গুলো নিশ্চিত করা হয়।
চিকিৎসকেরা ব্রেন ডেথ নিশ্চিত করার আগে মূলত তিনটি বিষয় পরীক্ষা করেন-১. আলো, শব্দ বা স্পর্শ-কোনো কিছুর প্রতিই রোগীর কোনো সাড়া পাওয়া যায় না।
২. চোখে আলো ফেললে পিউপিলের নড়াচড়া হয় না, গলার গ্যাগ রিফ্লেক্সসহ মস্তিষ্ক-নিয়ন্ত্রিত সব প্রতিক্রিয়া অনুপস্থিত থাকে।
৩.ভেন্টিলেটর ছাড়া রোগীর শরীর শ্বাস নেওয়ার কোনো চেষ্টা করে না।এই তিনটি শর্ত পূরণ হলে এবং অন্যান্য চিকিৎসা পরীক্ষায় একই ফল পাওয়া গেলে ব্রেন ডেথ ঘোষণা করা হয়।
কোমা ও ব্রেন ডেথের পার্থক্য কীঅনেকের মধ্যেই এই বিভ্রান্তি রয়েছে, কিন্তু বাস্তবে দুটা এক নয়। কোমা হলো এমন একটি অবস্থা, যেখানে রোগী গভীর অচেতনতায় থাকলেও তার মস্তিষ্ক পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় না। অনেক ক্ষেত্রে তারা জ্ঞান ফিরে পেতে পারেন। অন্যদিকে ব্রেন ডেথ সম্পূর্ণ ভিন্ন ও চূড়ান্ত একটি অবস্থা। এতে মস্তিষ্কের সব কার্যক্রম স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়। চিন্তা, অনুভূতি, প্রতিক্রিয়া এমনকি নিজে থেকে শ্বাস নেওয়ার ক্ষমতাও থাকে না- মানে ফেরার কোনো সম্ভাবনা থাকে না।
ব্রেন ডেথ থেকে কি কেউ কখনো সেরে উঠেছে?এই প্রশ্নটি অনেকই করে থাকেন। কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞানের স্পষ্ট উত্তর হলো-না। এখন পর্যন্ত চিকিৎসা বিজ্ঞানে ব্রেন ডেথ থেকে ফিরে আসার কোনো উদাহরণ নেই। কঠোর নিয়ম মেনে একাধিক পরীক্ষার পরই ব্রেন ডেথ ঘোষণা করা হয়। একবার এটি নিশ্চিত হলে সেই ব্যক্তি চিকিৎসাগতভাবে মৃত বলে বিবেচিত হন।
ব্রেন ডেথ কি প্রতিরোধ করা সম্ভব?ব্রেন ডেথ পুরোপুরি প্রতিরোধ করা সব সময় সম্ভব নয়। কারণ যেসব গুরুতর অসুস্থতা বা দুর্ঘটনা ব্রেন ডেথের দিকে নিয়ে যায়-যেমন বড় ধরনের মাথায় আঘাত, স্ট্রোক বা অক্সিজেনের ঘাটতি-সেগুলো অনেক সময় মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ঘটে। তবে কিছু ক্ষেত্রে দ্রুত ও সঠিক চিকিৎসা পাওয়া গেলে পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ হয়ে ওঠা থেকে রক্ষা করা যেতে পারে।
সূত্র: ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক ও ভেরিওয়েল হেলথ
আরও পড়ুন: মাথায় আঘাত লাগলে জরুরি করণীয় ঘুম আসছে না মাথায় আঘাতের পর? জানুন সমাধান
এসএকেওয়াই/