বয়সের ভারে ন্যুব্জ শরীর। ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী। এরপরও বেঁচে থাকতে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন স্বাধীনতা যুদ্ধে নিজের সর্বস্ব খোয়ানো শরীয়তপুরের ৮৬ বছর বয়সী বীরাঙ্গনা যোগমায়া মালো। অন্যের জমিতে টিনের দোচালা ঘর তুলে ভাড়ায় কোনোমতে দিনযাপন করছিলেন তিনি। অভিযোগ, একাধিকবার সরকারি দপ্তরে ধরনা দিয়েও মেলেনি নিজের একটি কাঙ্ক্ষিত ঠিকানা। মৃত্যুর আগে অন্তত নিজের ঘর দেখার ইচ্ছে ছিলো তার। অবশেষে জাগো নিউজে সংবাদ প্রকাশের পর নতুন ঘর পেলেন যোগমায়া মালো।
বিজয় দিবস উপলক্ষে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঘর দেওয়া হয় তাকে। পাশাপাশি তার পরিবারের হাতে খাদ্যসামগ্রী ও শীত বস্ত্র তুলে দেওয়া হয়।
যোগমায়া মালো, তার পরিবার ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের ২২ মে শরীয়তপুর সদরের মনোহর বাজারের দক্ষিণ মধ্যপাড়ার হিন্দু এলাকায় তাণ্ডব চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। প্রতিটি ঘর থেকে তুলে আনা হয় হিন্দু তরুণ-তরুণী আর গৃহবধুদের। সেদিন সবার সঙ্গে তুলে আনা হয় নেপাল চন্দ্র মালোর স্ত্রী যোগমায়া মালোকে। তখন ১৫ বছরের কিশোরী গৃহবধূ ছিলেন তিনি। বেশ কয়েকজনকে মধ্যপাড়া এলাকায় গুলি করে হত্যার পর অন্তত ১০০ জন নারী-পুরুষকে ধরে লঞ্চে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় মাদারীপুরের এআর হাওলাদার জুট মিলে। সেখানে পুরুষদের অনেককেই গুলি করে হত্যা করা হয়। আর নারীদের ৩ দিন ৩ রাত আটকে রেখে চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন। সেই নির্যাতন শেষে ছাড়া পেয়ে যোগমায়া মালো ফিরে আসেন স্বামীর কাছে।
স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর ২০১৮ সালে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলেছে তার। তবে মনের ক্ষত বয়ে বেড়ানো এই বীরাঙ্গনা নারীর ছিলো না থাকার ঘর। বিষয়টি নিয়ে গতবছর ১৯ ডিসেম্বর ,‘আজও নিজের একটা ঠিকানা হলো না বীরাঙ্গনা যোগমায়া মালোর,’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে জাগো নিউজ টুয়েন্টি ফোর ডটকম।
বিষয়টি মাথায় রেখে এবার বিজয় দিবস উপলক্ষে সোমবার (১৫ ডিসেম্বর) একদিন আগেই তাকে সরকারিভাবে পাঁকা ঘর করে দিলেন জেলা প্রশাসন।
এসময় উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক তাহসিনা বেগম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মাসুদুল আলম, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইলোরা ইয়াসমিন ও অন্যান্যরা। তাদের এমন উদ্যোগে খুশি এলাকাবাসী। তবে শেষ বয়সে মাথা গোঁজার ঠাঁই মিললেও বর্তমানে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী বীরাঙ্গনা যোগমায়া মালো। সরকারিভাবে চিকিৎসার দাবি জানিয়েছে পরিবারের স্বজনরা।
স্থানীয় বাসিন্দা হাজী মোতালেব মাদবর বলেন, যোগমায়া মালোর সুযোগ সুবিধা আরও আগেই পাওয়া উচিত ছিলো। এই শেষ বয়সে এসে তিনি একটি ঘর পেলেন। এটাই তার জীবনের সার্থকতা। তবে তিনি এখন অনেক অসুস্থ। আমরা এলাকাবাসী সরকার থেকে তার জন্য চিকিৎসা করানোর দাবি জানাই।
যোগমায়া মালোর ছেলে অশোক মালো বলেন, আমার মা একজন বীরাঙ্গনা। আমরা অনেক কষ্টে দিন পার করেছি। ঘর না থাকায় অন্যের আশ্রয়ে দিন কেটেছে। দীর্ঘদিন ধরে একটি ঘরের জন্য বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছি। সংবাদ প্রচারের পর আজ সরকারিভাবে একটি থাকার ঘর পেয়েছি। আমরা অনেক খুশি। তবে আমার মা এখন ক্যান্সারে আক্রান্ত। তার চিকিৎসা করানোর মতো টাকা আমাদের নেই। সরকার যদি তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিতো তাহলে মা আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতে পারতেন।
যোগমায়া মালোর পুত্রবধূ ডলি মালো বলেন, আমরা ঘর পেয়ে অনেক খুশি হয়েছি। তবে আমার শাশুড়ি অনেক অসুস্থ। তার জন্য সরকার যদি আর্থিক সহযোগিতা করতো তাহলে আরও ভালো চিকিৎসা করা যেতো।
যোগমায়া মালোর জন্য ঘরের ব্যবস্থা করে দিতে পেরে খুশি জেলা প্রশাসক। আর তার চিকিৎসার জন্য ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন জেলা প্রশাসনের এই কর্মকর্তা।
জেলা প্রশাসক তাহসিনা বেগম বলেন, গণমাধ্যমে নিউজ প্রচারের পর আমরা বিষয়টি অবগত হয়েছিলাম। অবশেষে তার জন্য বিজয় দিবস উপলক্ষে একটি নতুন ঘর করে দিতে পেরেছি, এজন্য আমরা খুশি। আমরা সব সময় মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনাদের পাশে আছি। বর্তমানে বীরাঙ্গনা যোগমায়া মালো ক্যান্সার আক্রান্ত। তার বাড়িতে গিয়ে বিষয়টি জানতে পেরেছি। আমরা তার জন্য সরকারিভাবে চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
বিধান মজুমদার অনি/এনএইচআর/জেআইএম