মানুষ হিসেবে আমরা কী চাই, এই প্রশ্নটার উত্তর আসলে খুব জটিল হওয়ার কথা নয়। খুব সাধারণ কিছু চাওয়া আমাদের। একটু শান্তি চাই, একটু স্বস্তি চাই, নিরাপত্তা চাই। চাই এমন একটা ঘর, যেখানে রাতের বেলা নিশ্চিন্তে ঘুমানো যায়, সকালে উঠে ভবিষ্যৎ নিয়ে আতঙ্কে কাঁপতে না হয়। ভাত কাপড়ের সংস্থান চাই, সন্তানকে স্কুলে পাঠানোর সামর্থ্য চাই, অসুস্থ হলে চিকিৎসার নিশ্চয়তা চাই। এর সঙ্গে চাই সম্মান, চাই মর্যাদা, চাই এমন একটি সমাজ যেখানে একে অপরকে মানুষ হিসেবে দেখবে। এই চাওয়াগুলো কোনো বিলাসিতা নয়। এগুলো মানবিক জীবনের ন্যূনতম শর্ত। অথচ আজকের বাস্তবতায় এই সাধারণ চাওয়াগুলোই যেন পাহাড়সম ভারী হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে, এসব পাওয়ার অধিকারটুকুও বুঝি আমাদের কাছ থেকে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে।
দেশটা এখন কেমন যেন বিভিন্ন মতের মানুষে গভীরভাবে বিভক্ত। মতের বিভাজন ছিল আগেও, মতাদর্শের দ্বন্দ্বও নতুন নয়। কিন্তু এখন সেই বিভাজন যেন মানুষের ভেতরের মানবিক অংশটুকু গিলে খাচ্ছে। একজনের সঙ্গে আরেকজনের মত না মিললেই যেন তাকে শত্রু ভেবে নেওয়া হচ্ছে। যুক্তির জায়গায় ঢুকে পড়ছে গালি, সহমতের জায়গায় দখল নিচ্ছে হুমকি। কথার লড়াই মুহূর্তেই রূপ নিচ্ছে হাতাহাতিতে, আর হাতাহাতি গড়াচ্ছে প্রাণনাশের প্রতিশ্রুতিতে। সমাজের ভেতরে যেন এক ধরনের আদিম প্রবৃত্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। যেন কেউ অপেক্ষা করছে কখন সুযোগ পাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার, লাশ ফেলে দেওয়ার, নিজের ক্ষোভকে রক্তে ধুয়ে দেওয়ার।
এই প্রবণতা ভয়ংকর, কারণ এটি কোনো একক গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটি ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। রাজনীতি, আন্দোলন, সামাজিক মাধ্যম, চায়ের দোকান, টক শো সবখানেই একই ভাষা, একই উত্তেজনা, একই প্রতিশোধস্পৃহা। লাশের বদলে লাশ, চোখের বদলে চোখ, রক্তের বদলে রক্ত। এই ভাষা শুনতে শুনতে মনে হয়, দেশজুড়ে যেন একটি নিষ্ঠুর আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের মহড়া চলছে। যেন সবাই প্রস্তুত, কেবল একটা স্ফুলিঙ্গের অপেক্ষা।
কিন্তু আমরা খুব কমই ভাবছি, এই পথে গেলে শেষটা কোথায়? লাশের বদলে লাশ যদি নীতি হয়, তাহলে একসময় লাশের অভাব হয়তো হবে না, তবে মানুষই আর থাকবে না। চোখের বদলে চোখ চাইলে একসময় সবাই অন্ধ হয়ে যাবে। প্রতিশোধের রাজনীতি কখনো নিরাপত্তা দেয় না, দেয় কেবল অনন্ত শোক আর অনিশ্চয়তা। ইতিহাস বারবার দেখিয়েছে, হিংসার মধ্য দিয়ে কোনো সমাজ মানবিক হয়নি, বরং আরও ভেঙে পড়েছে। অথচ আমরা সেই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে চাইছি না। আমরা যেন ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেদের অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছি।
এই প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক সময়ে দেওয়া কিছু বক্তব্য দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করেছে। ‘জুলাই আন্দোলনকারীদের ওপর কোনো আক্রমণ হলে পাল্টা আক্রমণের হুঁশিয়ারি’ দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদির ওপর হামলার প্রতিবাদে আয়োজিত এক সমাবেশে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের গায়ে হাত দেওয়া যাবে না, একটা লাশ পড়লে আমরা লাশ নেব।’ এই কথাগুলো শুনে শিউরে ওঠা ছাড়া উপায় থাকে না। কারণ এই বক্তব্য কেবল ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ নয়, এটি সরাসরি হিংসাকে বৈধতা দেওয়ার ঘোষণা।
মাহফুজ আলমকে অনেকেই একজন চিন্তাশীল, প্রজ্ঞাবান মানুষ হিসেবে দেখেছেন। জুলাই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে তাকে অনেকের চোখে সবচেয়ে অগ্রসর চিন্তার মানুষ বলেই মনে হয়েছে। তার বক্তৃতায়, লেখায় একটি সংযত বোধ, একটি বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ করা গিয়েছিল। প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহম্মদ ইউনূসও নিউইয়র্কের এক সমাবেশে তাকে জুলাই আন্দোলনের ‘মাস্টার মাইন্ড’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। এই পরিচয়, এই প্রত্যাশার জায়গা থেকেই তার বক্তব্য আরও বেশি হতাশাজনক হয়ে ওঠে। কারণ যে মানুষটিকে অন্যদের তুলনায় ধীরস্থির এবং দূরদর্শী বলে মনে হয়েছিল, সেই মানুষটির মুখ থেকেই যখন লাশের বদলে লাশ নেওয়ার কথা শোনা যায়, তখন উদ্বেগ দ্বিগুণ হয়।
এই বক্তব্যের পর আর দশজন ‘রক্তগরম’ তরুণ নেতার সঙ্গে তার পার্থক্য খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তখন প্রশ্ন জাগে, আমরা আসলে কাদের দিকে তাকিয়ে আছি নেতৃত্বের জন্য? যদি চিন্তাশীল বলে পরিচিত মানুষরাও শেষ পর্যন্ত একই হিংস্র ভাষায় কথা বলেন, তাহলে সমাজকে সংযমের পথে ডাকবে কে? এই ধরনের বক্তব্য শুধু মুহূর্তের উত্তেজনা বাড়ায় না, এটি সাধারণ মানুষের মনে ভয়ও ঢুকিয়ে দেয়। মানুষ ভাবতে শুরু করে, রাষ্ট্র কি তবে প্রতিশোধের নীতিতেই চলবে? মতের অমিল হলেই কি প্রাণের নিরাপত্তা হারাতে হবে?
হ্যাঁ, যারা লাশ ফেলার রাজনীতি করছে, তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। তাদের বিচ্ছিন্ন ও নিষ্ক্রীয় করে দিতে হবে। আইনের আওতায়ও আনতে হবে। কিন্তু লাশের বদলে লাশ ফেলার কথা বলা যাবে না। তাহলে লাশের মিছিল কখনও শেষ হবে না।
২০২৪ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশ এক গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই সংকট শুধু রাজনৈতিক নয়, এটি সামাজিক এবং নৈতিক সংকটও। দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা ও দলীয়করণের ফলে দুর্বল হয়ে পড়েছে। বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এমনকি সামাজিক সম্পর্কগুলোও ভাঙনের মুখে। রাজনীতি ও অর্থনীতিতে এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়েছে। নেতৃত্বে দূরদর্শিতার অভাব, নীতিতে অস্থিরতা, সিদ্ধান্তে স্বল্পদৃষ্টি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এই পরিস্থিতিতে দেশের মানুষের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল স্থিরতা, সংলাপ এবং পারস্পরিক আস্থা।
এই সময়টাতে দরকার ছিল সংযম। দরকার ছিল ভিন্নমতের মানুষের সঙ্গে বসে কথা বলার মানসিকতা। দরকার ছিল সবাই মিলে ভাবা, কীভাবে দেশটাকে এই সংকট থেকে বের করে আনা যায়। কীভাবে একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক উত্তরণ সম্ভব করা যায়। কীভাবে ভেঙে পড়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে মেরামত করা যায়, কীভাবে অর্থনীতিকে আবার গতিশীল করা যায়। এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার বদলে যদি আমরা হিংসা আর হুমকিকেই প্রধান হাতিয়ার বানাই, তাহলে সেই উত্তরণ কেবল আরও দূরে সরে যাবে।
একটি সমাজ তখনই এগোয়, যখন সেখানে মতের ভিন্নতা থাকলেও পারস্পরিক সম্মান থাকে। দ্বন্দ্ব থাকলেও তার সমাধান খোঁজার চেষ্টা থাকে। কিন্তু এখন যেন আমরা সমাধানের পথটাই পরিত্যাগ করেছি। আমরা যেন সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কথা বলব না, বুঝব না, কেবল শক্তি দেখাব। লাশ ফেলে দিব। এই মনোভাব রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করে না, বরং আরও দুর্বল করে। কারণ রাষ্ট্রের শক্তি আসে তার নাগরিকদের আস্থায়, নাগরিকদের নিরাপত্তায়, নাগরিকদের অংশগ্রহণে।
যদি আজ আমরা বিভেদ, বৈরিতা এবং হিংসাকেই মূল মন্ত্র হিসেবে বেছে নিই, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা কী রেখে যাচ্ছি? একটি ভয়ভীতির সমাজ, যেখানে সবাই সবাইকে সন্দেহ করবে? যেখানে মত প্রকাশ মানেই ঝুঁকি? যেখানে রাজনীতি মানেই প্রতিশোধের খেলা? সেই সমাজে শান্তি, স্বস্তি, নিরাপত্তার যে সাধারণ চাওয়াটুকু দিয়ে এই লেখা শুরু হয়েছিল, তা তখন আরও অধরা হয়ে উঠবে।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, এই দেশটা কোনো একক মতাদর্শের একচ্ছত্র মালিকানা নয়। এই দেশ কারও ব্যক্তিগত রাগ, ক্ষোভ কিংবা প্রতিশোধের পরীক্ষাগারও হতে পারে না। এই দেশটা গড়ে উঠেছে নানা মত, নানা বিশ্বাস, নানা স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকা মানুষের সম্মিলিত প্রয়াসে। এখানে কেউ ভুল করবে, কেউ ভিন্ন কথা বলবে, কেউ বিরোধিতা করবে, সেটাই স্বাভাবিক। গণতন্ত্রের সৌন্দর্য এখানেই। কিন্তু সেই ভিন্নতার জবাব যদি হয় লাশের বদলে লাশ ফেলে দেওয়ার হুমকি, তাহলে আমরা আর গণতন্ত্রের কথা বলতে পারি না, তখন আমরা কেবল শক্তির শাসনের দিকে এগোই।
আমাদের বুঝতে হবে, হিংসা কখনো শক্তির পরিচয় নয়। হিংসা আসলে দুর্বলতার প্রকাশ। যুক্তি দিয়ে, নৈতিকতা দিয়ে, সহমর্মিতা দিয়ে যিনি নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে পারেন না, তিনিই হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেন ভয় আর রক্ত। ইতিহাসে যারা সত্যিকারের নেতা হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন, তারা কখনো মানুষকে লাশের প্রতিশ্রুতি দেননি, দিয়েছেন আশা, দিয়েছেন নিরাপত্তা, দিয়েছেন পথনির্দেশনা। আজকের সংকটময় সময়ে আমাদের দরকার সেই ধরনের নেতৃত্ব, যারা উত্তেজনা কমাবে, আগুনে পানি ঢালবে, আগুনে ঘি ঢালবে না।
শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটা খুব সোজা। আমরা কোন দেশে থাকতে চাই? এমন একটি দেশে, যেখানে মতের অমিল হলেই লাশ পড়ে, না কি এমন একটি দেশে, যেখানে মতের অমিল সত্ত্বেও মানুষ নিরাপদ থাকে? যদি প্রথমটাকেই আমরা অনিবার্য বলে মেনে নিই, তাহলে একদিন আশ্রয় খোঁজার মতো কোনো জায়গাই আর থাকবে না। তখন আমরা বুঝব, হিংসার আগুনে আমরা কেবল অন্যকে নয়, নিজেদের ঘরকেও পুড়িয়ে দিয়েছি!
এইচআর/এএসএম