দেশজুড়ে

কেরু চিনিকলে ১০৪ শ্রমিক নিয়োগে বাণিজ্য, ১০ কর্মকর্তার শাস্তি

দেশের অন্যতম বৃহৎ চিনিকল কেরু অ্যান্ড কোম্পানিতে ১০৪ জন শ্রমিক নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতির দায়ে ১০ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে খাদ্য ও চিনি শিল্প করপোরেশন। ২০২৮ সালের জুন পর্যন্ত তাদের সবার বেতন বৃদ্ধি স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় এই নিয়োগ প্রক্রিয়া ঘিরে আদালতে মামলা থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয় ও করপোরেশনে লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়। অভিযোগের প্রেক্ষিতে গঠিত একাধিক তদন্ত কমিটি সরেজমিন তদন্ত শেষে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

গত ১০ ডিসেম্বর শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও করপোরেশনের চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) রশিদুল হাসান স্বাক্ষরিত পত্রে জানা গেছে, ১০৪ স্থায়ীকরণের (নিয়োগ) ঘটনায় অভিযুক্ত কেরুজ সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোশারফ হোসেন, সাবেক এডিএম ইউসুফ আলী, সদর দপ্তরের তৎকালীন প্রতিনিধি বর্তমানে কুষ্টিয়া চিনিকলের এডিএম সাইফুল আলম, বর্তমানে কেরুজ চিনিকলের মহাব্যবস্থাপক (অর্থ) আব্দুছ ছাত্তার, মহাব্যবস্থাপক (কারখানা) সুমন সাহা, মহাব্যবস্থাপক (কৃষি) আশরাফুল আলম ভূইয়া, মহাব্যবস্থাপক (ডিস্টিলারী) রাজিবুল হাসান, পরিবহন বিভাগের প্রকৌশলী আবু সাঈদ, খামার ব্যবস্থাপক সুমন কুমার সাহা ও প্রশাসন বিভাগের আল আমিনকে বিভাগীয় শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে।

প্রত্যেকের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ, তার জবাব, তদন্ত প্রতিবেদন, কারণ দর্শানোর জবাব ও বিভাগীয় মামলাদ্বয়ের সংশ্লিষ্ট নথি পর্যালোচনায় তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের কর্মচারী চাকরি প্রবিধানমালা ১৯৮৯ সালের প্রবিধি ৩৮ এর ক ও খ অনুযায়ী যথাক্রমে দায়িত্ব পালনে অবহেলা ও অসদারচণের অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় আগামী ২০২৮ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বেতন বর্ধন স্থগিত রাখা হয়েছে। এছাড়া মোশারফ হোসেন, সাইফুল আলম, ইউসুফ আলী ও আল আমিনের বেতন বর্ধন স্থগিতের পাশাপাশি প্রত্যেককে নিয়োগকালীন বেতনের আওতায় নেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, দর্শনা কেরু চিনিকলে এক যুগ পর ২০২৩ সালের ১৫ মে ১০৪ জন মৌসুমি শ্রমিক-কর্মচারীকে স্থায়ীভাবে নিয়োগ করা হয়। ওই প্রক্রিয়া নিয়ে শুরু থেকেই বিভিন্ন অভিযোগ উঠে। ওই মাসেরই ১৩ ও ১৪ তারিখে পরীক্ষা নেওয়া হয় প্রার্থীদের। ১৪০ জন প্রার্থী পরীক্ষায় অংশ নিলেও ১০৪ জনকে স্থায়ীকরণ করা হয়। পরীক্ষা নেওয়ার ৪৮ ঘণ্টা পর বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন থেকে জনবল স্থায়ীকরণের সব কার্যক্রম স্থগিত রাখার একটি নির্দেশনা জারি করা হলেও কর্তৃপক্ষ তা না মেনে নিজ নিজ পদে জনবল স্থায়ী করার জন্য চিঠি ইস্যু করে। অভিযোগ ওঠে, ঘুষ-বাণিজ্যের কারণে কেরু চিনিকলে তড়িঘড়ি করে ওই সকল পদে স্থায়ীকরণের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে।

স্থায়ীকরণে মুক্তিযোদ্ধা কোটা না মানায় কোম্পানির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালকে মোশারফ হোসেনকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছিলেন কারখানার মৌসুমি ফিল্টার হেলপার বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বাবুল আকতার। নিয়োগের ব্যাপারে লিখিতভাবে শিল্প মন্ত্রণালয় ও চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন মিলের মৌসুমি সিনিয়র ক্রয় করণিক মহিদুল ইসলাম।

সূত্র থেকে জানা গেছে, স্থায়ী লোকবলের সংকট থাকায় ২০২৩ সালের ১৪ মার্চ লোকবল চেয়ে নীতিমালা প্রস্তুত করে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনে পাঠানো হয় কেরুজ চিনিকল কর্তৃপক্ষ থেকে। এরপর সদর দপ্তর ২৫ মার্চ শূন্য পদ পূরণে নিয়োগের আহ্বান জানায়। তারই পরিপ্রেক্ষিতে কেরু অ্যান্ড কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেন ২ এপ্রিল স্থায়ীকরণ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন। তবে বিজ্ঞপ্তিটি সংবাদপত্রে না দিয়ে শুধু নোটিশ বোর্ডে দেওয়া হয়। ২৪ এপ্রিল আবেদনকারীদের কাগজপত্র যাচাইবাছাই করেন সদর দপ্তরের প্রতিনিধি সাইফুল আলম। ১৩ ও ১৪ মে নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেন ১৪০ জন শ্রমিক-কর্মচারী। ১৫ মে ১০৪ জনকে স্থায়ী নিয়োগ দেয়া হয়। ঠিক ওই দিনই কেরুসহ সব চিনিকলে জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত করার নির্দেশনা দেন বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের তৎকালীন সচিব চৌধুরী রুহুল আমিন কায়ছার। তবে কেরুজ এমডির স্বাক্ষরিত চিঠি স্থায়ী করা শ্রমিক-কর্মচারীদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ওই দিনই তাঁদের যোগদান করানো হয় কৌশলে।

অভিযোগ ছিল, শ্রমিকদের কাছ থেকে জন প্রতি ৫ থেকে ৯ লাখ টাকা করে অর্থবাণিজ্য করা হয়। এতে জড়িত ছিল চিনিকলের কর্মকর্তারা।

হুসাইন মালিক/এমএন/এমএস