-আহসান হাবিব বরুন
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় সমুদ্রবন্দর অবিচ্ছেদ্য একটি চালিকাশক্তি। আমদানি-রপ্তানি নির্ভর এই অর্থনীতিতে চট্টগ্রাম বন্দর শুধু একটি অবকাঠামো নয় বরঞ্চ এটি রাষ্ট্রীয় রাজস্ব, বৈদেশিক বাণিজ্য ও আন্তর্জাতিক সুনামের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। অথচ দীর্ঘদিন ধরে এই বন্দরকে ঘিরে যে অভিযোগটি সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়ে আসছে, তা হলো দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি। সাম্প্রতিক সময়ে ড্যানিশ একটি আন্তর্জাতিক কোম্পানির সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি বন্দর পরিচালনা চুক্তিকে কেন্দ্র করে যে বিতর্ক ও বিরোধিতা দেখা দিয়েছে, সেটির পেছনে প্রকৃত কারণ কী? জাতীয় স্বার্থ, না কি বিপুল অঙ্কের অবৈধ আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা! এই প্রশ্ন এখন আর এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না।
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে প্রায় প্রতিটি সরকারই দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে মুখে কঠোর অবস্থানের কথা বলেছে। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা গেছে, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি ও সংগঠিত চাঁদাবাজি বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মতো সমুদ্রবন্দরও এর বাইরে নয়। বরং অভিযোগ রয়েছে, দেশের প্রধান বন্দরগুলোতে চাঁদাবাজি যেন একটি ‘স্বাভাবিক ব্যবস্থায়’ পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন সূত্র ও ব্যবসায়ী মহলের দাবি অনুযায়ী, শুধু চট্টগ্রাম বন্দরেই বছরে প্রায় হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ অবৈধ লেনদেন হয়। এই অর্থ কোনো সরকারি কোষাগারে যায় না; যায় একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের পকেটে।
এই বাস্তবতা সম্প্রতি খোলামেলা ভাষায় স্বীকার করেছেন নৌ-পরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতিদিন অবৈধভাবে দুই থেকে আড়াই কোটি টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় হয়। তাঁর ভাষায়, বন্দরের প্রায় প্রতিটি জায়গাতেই চাঁদাবাজি চলছে। ট্রাক ঢুকলে চাঁদা, বের হলেও চাঁদা এবং কাজে ইচ্ছাকৃতভাবে দেরি করে হয়রানি। এই বক্তব্য শুধু একটি প্রশাসনিক মন্তব্য নয়; এটি দীর্ঘদিনের গোপন সত্যের প্রকাশ্য স্বীকারোক্তি। এজন্য আমি উপদেষ্টাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই।
ঠিক এই প্রেক্ষাপটেই চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনায় ড্যানিশ কোম্পানির সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের চুক্তি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, এই চুক্তি কার্যকর হলে বন্দরের কার্যক্রমে গতি আসবে, স্বচ্ছতা বাড়বে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো চাঁদাবাজির সুযোগ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে। সুতরাং যাঁরা বছরের পর বছর এই অনিয়ম থেকে লাভবান হচ্ছেন তাঁদের মধ্যে অস্বস্তি তৈরি হওয়াটাই অস্বাভাবিক কিছু নয়।
ড্যানিশ কোম্পানি এপিএম টার্মিনালস (APM Terminals), যা বিশ্বখ্যাত মায়ার্স্ক গ্রুপের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান, বিশ্বের বহু গুরুত্বপূর্ণ বন্দরের ব্যবস্থাপনায় যুক্ত। যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস ও নিউ জার্সি, ইউরোপের রটারডাম ও বার্সেলোনা, আফ্রিকার ঘানা ও মরক্কো, এশিয়ার ভারতের মুন্দ্রা ও শ্রীলঙ্কার কলম্বো সহ এমন বহু দেশে এই কোম্পানি বন্দর পরিচালনায় দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব বন্দরে আধুনিক ব্যবস্থাপনা, ডিজিটাল ট্র্যাকিং, সময়নিষ্ঠ সেবা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এপিএম টার্মিনালসের সুনাম রয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক বন্দর ও লজিস্টিকস বিশেষজ্ঞ জনাথন লি এক গবেষণায় উল্লেখ করেছেন, “যেসব দেশে আন্তর্জাতিক মানের অপারেটরদের মাধ্যমে বন্দর পরিচালিত হয়, সেখানে গড়পড়তা জাহাজ জট কমে ৩০–৪০ শতাংশ এবং অনানুষ্ঠানিক খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়।” তাঁর মতে, বন্দর ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা বাড়লে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় অবৈধ সিন্ডিকেটগুলো।
এই বাস্তবতার আলোকে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ড্যানিশ কোম্পানির ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তিকে অনেক অর্থনীতিবিদ ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন। তাঁদের যুক্তি, দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি হলে অপারেটররা অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রযুক্তি বিনিয়োগ ও মানবসম্পদ উন্নয়নে আগ্রহী হয়। এতে বন্দরের সক্ষমতা বাড়ে, পণ্য খালাসের সময় কমে এবং ব্যবসায়ীদের হয়রানি হ্রাস পায়। এর ফলে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে দেশের রপ্তানি প্রতিযোগিতায় এবং বিদেশি বিনিয়োগ পরিবেশে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)-এর এক জ্যেষ্ঠ গবেষকের মতে, “বন্দর ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা না এলে উন্নত দেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন কঠিন হবে। আন্তর্জাতিক অপারেটরদের যুক্ত করা মানে জাতীয় স্বার্থ বিকিয়ে দেওয়া নয়; বরং জাতীয় সক্ষমতা বাড়ানোর একটি কৌশল।”
তবু এই চুক্তি নিয়ে রাজনৈতিক ও আইনি বিতর্ক তৈরি হয়েছে। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে এবং গত ৪ ডিসেম্বর হাইকোর্টে একটি বিভক্ত রায় এসেছে।এক বিচারপতি চুক্তির প্রক্রিয়াকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন, অন্য বিচারপতি রিট খারিজ করেছেন। এই বিভক্ত রায় স্বাভাবিকভাবেই অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। তবে নৌ উপদেষ্টা নিজেই বলেছেন, রায় নিয়ে তিনি মন্তব্য করবেন না; বরং আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই বিষয়টির নিষ্পত্তি হওয়া উচিত।
তবে সঙ্গত কারণেই এখানে একটি প্রশ্ন উঠে যে, চুক্তিটি যদি এতটাই ক্ষতিকর হতো, তবে ব্যবসায়ী মহলের একটি বড় অংশ কেন এটিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে? বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, আমদানি-রপ্তানিকারক ও লজিস্টিকস সংশ্লিষ্ট অনেক ব্যবসায়ীই বলছেন, সাম্প্রতিক ব্যবস্থাপনায় কাজের গতি বেড়েছে, সময় কম লাগছে এবং অনানুষ্ঠানিক খরচ কমেছে
বাস্তব প্রেক্ষাপটে আমি এই প্রশ্নো তুলতে চাই যে,বন্দর চুক্তির বিরোধিতার পেছনে কি জাতীয় স্বার্থ নাকি বিপুল পরিমাণ চাঁদাবাজির টাকা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয় কাজ করছে? এই প্রশ্নটি খুবই প্রাসঙ্গিক এ কারণে যে,যখন একটি খাত থেকে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে আদায় হয়, তখন সেই ব্যবস্থায় সংস্কার আনার যে কোনো উদ্যোগই শক্ত প্রতিরোধের মুখে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। বাস্তবতা হচ্ছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রকৃত সংস্কার কখনোই সহজ পথে এগোয় না।
চট্টগ্রাম বন্দরকে নৌ উপদেষ্টা যে ‘সোনার ডিম পাড়া হাঁস’-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন, তার এই মন্তব্যটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করি। কারণ অতিরিক্ত লোভে সেই হাঁস জবাই করলে যেমন শেষ পর্যন্ত সবই হারাতে হয়, তেমনি বন্দরকে অনিয়মের শিকার করে দীর্ঘমেয়াদে রাষ্ট্রই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।। ফলে এখন যদি স্বচ্ছ ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার সুযোগ হাতছাড়া করা হয়, তবে তার মূল্য দিতে হবে আগামী প্রজন্মকে। এতে আমার কোন সন্দেহ নেই।
দেশের উন্নয়ন, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং সর্বোপরি জাতীয় স্বার্থের কথা বিবেচনা করলে বন্দর চুক্তি নিয়ে আবেগ নয়, প্রয়োজন যুক্তিনির্ভর ও তথ্যভিত্তিক আলোচনা। আদালতের কাছ থেকেও একটি সুষ্ঠু ও দূরদর্শী সমাধান প্রত্যাশা করে দেশের মানুষ। যে সমাধান দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে, চাঁদাবাজির শেকড় দুর্বল করবে এবং বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মানচিত্রে আরও বিশ্বাসযোগ্য অংশীদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে।
শেষ কথা:আমরা কি সংস্কারের পথে এগোব, নাকি চাঁদাবাজির সুবিধাভোগীদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করব? বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে জনগণের মাথায় বন্দুক রেখে ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলের যে রাজনীতি তা থেকে আমাদের বেরোতেই হবে। তা না হলে আমরা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অবধারিতভাবে পিছিয়ে যাব। আমি সমুদ্র বন্দর চুক্তির সফল বাস্তবায়ন কামনা করছি।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, ঢাকা। ahabibhme@gmail.com
এইচআর/এমএস