একুশে বইমেলা

ওঙ্কার: একটি দেশের জন্মকথা

রবিউল আওয়াল পারভেজ

‌‘এই গ্রন্থটি পাঠ করলে যে-কোন সহৃদয় পাঠকই মোহিত হবেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রচণ্ড আবেগ এবং অনুভূতি নিয়ে এর চাইতে উৎকৃষ্ট কিছু কোথাও লিখিত হয়েছে এমন আমার জানা নেই।’—আহমদ ছফার ‘ওঙ্কার’ উপন্যাস নিয়ে এমনই মূল্যায়ন পেশ করেছেন আবুল ফজল। গল্পের ভেতর গল্প থাকে, কথার মধ্যে থাকে কথা। উৎকৃষ্ট কোনো সাহিত্যের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো তার গভীরতা। উৎকৃষ্ট লেখা মানুষকে শুধু আবেগতাড়িতই করে না, টেনে নিয়ে যায় চিন্তার অতল গহীনে। ‘ওঙ্কার’ ঠিক এমনই একটি প্রতীকী ও বহুস্তরবিশিষ্ট উপন্যাস।

প্রথম দফায় সংক্ষিপ্তাকারে কাহিনিটি বলে নেওয়া যাক, তারপর না হয় আমরা প্রবেশ করবো এর গহীনে। উপন্যাসের নায়ক জমিদার বংশের সন্তান। তার পিতা একজন প্রাচীনপন্থী, অহংকারী, ক্ষয়িষ্ণু জমিদার। যিনি পূর্বপুরুষ ও বংশগৌরব নিয়ে অহংকারে অন্ধ। তিনি তার পূর্বপুরুষের সামন্ত প্রতাপ বজায় রেখে চলতে চান। কিন্তু বাস্তবতা তার সেই আকাঙ্ক্ষাকে হাতুড়িঘাত করে ভেঙে চুরমার করে দেয়। তার চরিত্র উপন্যাসের নায়কের এই জবানীতে স্পষ্ট করে—‘আমার বাবা যেভাবে দিনাতিপাত করতেন, তাকে কিছুতেই একজন সুস্থ মানুষের স্বাভাবিক জীবনধারণ বলা যাবে না। তাঁর স্বপ্ন, কল্পনা-চিন্তা বাসনার বাগানে পিতৃপুরুষদের প্রেতাত্মারা দলে দলে হানা দিত। এই প্রেতাত্মাই তাঁকে জাগরণে নেশাগ্রস্ত করত। তিনি একজন নেশাগ্রস্ত মানুষের মতই জীবন যাপন করতেন।’

ক্ষয়িষ্ণু জমিদার সামন্তযুগীয় প্রতাপের সিলসিলা বজায় রাখতে চান, ফলে কথায় কথায় প্রজাদের হত্যার হুমকি দেন। কিন্তু সে ক্ষমতা না থাকায় মানুষের ওপরে মামলা করে নিজের ক্রোধের আগুন প্রশমিত করেন। এক মামলায় তার আপন সাক্ষী অন্য পক্ষের কাছ থেকে টাকা খেয়ে তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলে অবশিষ্ট জমিজমা বিক্রি করে তাকে মোটা অঙ্কের জরিমানা দিতে হয়। রাগে-ক্রোধে তিনি তার উকিল আবু নসরের সাথে মামলায় জড়িয়ে পড়েন। এই মামলায় হেরে তার সর্বস্ব খোয়াবার জোগাড় হয়। আদালত অবশিষ্ট সম্পত্তি নিলামে তোলেন। এই সংকটময় মুহূর্তে খোদ উকিল আবু নসর একটি শর্তে উদ্ধারকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন—নায়ককে তার বোবা কন্যাকে বিয়ে করতে হবে। সে হয়তো অসুস্থ বাবার কথা চিন্তা করে এবং সমস্ত পরিবারের কথা ভেবে সেই প্রস্তাবে সম্মতি দেয়।

এতে শুধু সম্পত্তি রক্ষা পায় না; তার বাবার চিকিৎসা হয়, সরকারি অফিসে চাকরি, বাড়ি সবকিছু পায়। কিন্তু সবকিছু পেয়েও যা পায় না, তা হলো মানসিক শান্তি। সুখ যেন তার কাছে চির অধরা বস্তুতে পরিণত হয়। অফিসের কেরানি নৃপেন তার সদ্য বিবাহিত বউয়ের খুনসুটির কথা বলে, তার বউ কীভাবে কথা বলে তা অভিনয় করেও দেখায়। এতে উপন্যাসে নায়কের মনে হয় তার বউ বোবা বলেই বুঝি তাকে খোঁটা দিতে এমন কায়দা করে নৃপেন। বোবা বউটি যত্ন-আত্তির কোনো ত্রুটি করে না। কিন্তু নায়কের মনোবাসনা, সে শুধু কথা বলতে চায়। মন ভরে কথা বলতে চায়। নায়কের কথা বলার এই আকুতির কারণ হলো তার জীবনে আপন বলতে কেউ নেই—বউ আছে যে কি না কথা বলতে পারে না, আর একটি ছোট বোন যার সাথে তার মানসিক দূরত্ব বিস্তর।

ধীরে ধীরে তার বোনের সাথে দূরত্ব কমে আসে, তারা টুকিটাকি বিষয় নিয়েও কথা বলতে শুরু করে। তার বিক্ষিপ্ত মন খানিকটা প্রশান্ত হয়। সে তার বোনের জন্য গানের মাস্টার ঠিক করে। একদিন অফিস থেকে ফিরে এসে দেখে, তার বোন যখন গানের রেওয়াজ করছে সেই মুহূর্তে বোবা বউটি প্রাণপণে তার বোনকে অনুসরণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এই ঘটনার পর স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের যে টানাপোড়েন তা দূর হয়ে যায়। সে অভিভূত হয় তার স্ত্রী বাকশক্তিহীন দশাটিকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়নি বলে। সে খেয়াল করে, ‘তার শরীরের প্রতিটি কণা, প্রতিটি অণু-পরমাণু এই বোবাত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বিক্ষোভে ফেটে পড়তে চায়।’ এরপরেই এ গল্প মোড় নেয় ভিন্ন দিকে। গল্প আর সীমাবদ্ধ থাকে না জমিদারের জমিদারি হারানোয় কিংবা সাংসারিক টানাপোড়েনের মধ্যে। উপন্যাসে রূপায়িত হয় ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের বাস্তব চিত্র।

পরিস্থিতি বর্ণনায় লেখককে উদ্ধৃত করা হলো—‘হঠাৎ করে শহরে একটা তুলকালাম কাণ্ড হয়ে গেল। কোথায় পুলিশ নাকি আসাদ নামের কোন একজন ছাত্রকে গুলি করে মেরেছে। তার পরদিন থেকে গোটা শহরে অলক্ষুণে ব্যাপার একের পর এক ঘটে যেতে থাকে। যেদিকেই যাই, যেদিকেই তাকাই, দেখি মানুষের মিছিল। পুলিশ আসে, ক্ষিপ্ত মানুষের ওপর লাঠি চার্জ করে, কাঁদুনে গ্যাস ছুঁড়ে মারে। ঘর থেকে বেরিয়ে আসা মানুষ আর ঘরে ফিরে যায় না। শেষ পর্যন্ত ঘরের মানুষদের জোর করে ঘরে ঢুকিয়ে দেয়ার জন্য রাস্তায় গোমড়ামুখো বাঘমার্কা মিলিটারি নামে। রাস্তার ধারে ধারে উদ্যত সঙ্গিন হাতে জীবন্ত ল্যাম্পপোস্টের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। সূর্যালোকে সঙ্গিনের ফলা চকচক করে। ক্ষিপ্ত মানুষ আচমকা বাধা পেয়ে থমকে দাঁড়ায়। মিলিটারিরা রাস্তা-ঘাটে টহল দেয়। বুট জুতোর একটানা আওয়াজ পিচের রাস্তার বুকে গেঁথে থাকে। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসা মানুষ আর ঘরে ফিরে না। তারা সেনাবাহিনীর বেষ্টনী ভেদ করে রাজপথ দখল করে। সৈন্যরা রাইফেলের বেল্টে টান দেয়, ঝাঁকে-ঝাঁকে গুলি বেরিয়ে আসে। মানুষের বুকে গুলি লাগে। রাজপথে লাল টাটকা খুনের প্লাবন ছোটে। রাজপথে আবার মেঘনা পদ্মার স্রোতের মত মিছিল নামে। গর্জনে আকাশ-বাতাস কাঁপে। মিলিটারি উঠে যেতে বাধ্য হয়। এই ছিল সত্যিকারের অবস্থা।’

আরও পড়ুনকাঁদো নদী কাঁদো: জীবনের শৈল্পিক উপস্থাপন মীরার গ্রামের বাড়ি: অনন্য পারিবারিক উপন্যাস 

দেশের এমন উত্তপ্ত অবস্থায় বোবা বউটি কিছুতেই ঘরে স্থির থাকতে পারে না। মিছিল এসেছে বুঝলেই সে দরজা হাট করে খুলে রাখে। ‘মিছিলের ধ্বনি তার অন্তর্লোকে চুম্বকের মত ক্রিয়া করে। আপনা থেকেই চোখজোড়া ঝিকিয়ে উঠে দুহাতে শক্ত করে জানালার শিকগুলো আঁকড়ে ধরে সমস্ত চেতনা জনারণ্যে আর শব্দারণ্যে কামানের গোলার মতো ছুঁড়ে মারে। আর গলা থেকে আপনা থেকেই গোঁ গোঁ শব্দ নির্গত হতে থাকে।’ এভাবে একদিন বোবা বউটি ‘বাংলা’ শব্দটি পরিষ্কারভাবে উচ্চারণ করে ফেলে। তার মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসে। যেন ‘ভেতরে কী একটা বোধহয় ছিঁড়ে গেছে’।

উপন্যাসটিতে প্রতীকের আশ্রয়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মের কথা অঙ্কিত হয়েছে। বাংলাদেশকে রূপায়িত করা হয়েছে বোবা বউটির মধ্য দিয়ে। বোবা বউটি মূলত বাংলাদেশেরই প্রতীক। বোবা বউটি যেমন বোবাত্ব মেনে নেয়নি, তার সমস্তটা দিয়ে বোবাত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ-বিপ্লবে বলীয়ান হয়েছে, ঠিক সেই মতো পুরো বাংলাদেশও প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও প্রচেষ্টায় আবদ্ধতা ভেদ করার প্রয়াস নিয়েছিল। বোবা বউটির মনের গহীনে যেমন ফুলের স্তবকের মতো কথা স্তরে স্তরে সজ্জিত, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের অন্তরে ছিল স্বাধীনভাবে বাঁচার আকুতি। বোবা বউটি যেমনি বাকপ্রয়াসী ছিল, তার মধ্যে থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইতো অর্থবোধক একটি শব্দ, ঠিক তেমনি বাংলাদেশও সংগ্রাম করছিল পাকিস্তান নামক বন্দিদশা থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীন বাংলাদেশে পরিণত হওয়ার। ছিল বাগযন্ত্রের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করার আকাঙ্ক্ষা।

উপন্যাসের আরও একটি দিক হচ্ছে, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান যেসব শ্রেণি, পেশা, প্রকারের মানুষকে উদ্বেলিত করেছিল তা আহমদ ছফা অতি নিপুণভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। বোবা বউটি যে কি না কানে খাটো, এক প্রকার বাইরের জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, তার চেতনায় যেমন গণঅভ্যুত্থান রেখাপাত করেছিল, মিছিলের ঘ্রাণ পেলেই এক অদ্ভুত চেতনায় উন্মাদ হয়ে উঠতো; তেমনি এক ব্যক্তিত্বহীন যুবক যে শ্বশুরের আশ্রয়ে থেকে আত্মগ্লানিতে ভুগত, মিছিল দেখে ভেতরে ভেতরে ভবিষ্যতের চিন্তায় ভীত হতো; সে-ও বলতে বাধ্য হয়—‘সেদিন তাকিয়ে দেখলাম মিছিলেরও দেখবার মত একটি নয়ন ভুলানো সৌন্দর্য আছে। আছে তাতে গতির দোলা, ছন্দের দ্যোতনা। ...মনে হল মিছিল ভয়ংকর, আবার মিছিল সুন্দর। মিছিলে ধ্বনিত হয় ভাঙনের ধ্বংসনাদ, মিছিলে জাগে নবসৃষ্টির মহীয়ান সঙ্গীত। ভীষণে কোমলে কেমন আপোষ করেছে।’

উপন্যাসের মূল উপজীব্য ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্ব মুহূর্তের প্রেক্ষাপট থাকলেও এখানে উঠে এসেছে শ্রেণিচরিত্র এবং সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের আখ্যান। সামন্তব্যবস্থায় জমিদারদের চরিত্রের ফিরিস্তি উঠে আসে নায়কের (গল্পকথক) এই বর্ণনায়—‘আর তাঁর পূর্ব-পুরুষেরা ছিলেন যথার্থ পশু। এক সময়ে মদে, মেয়েমানুষে আমাদের সে তল্লাট উজাগর রেখেছিলেন।’ আর নায়কের পিতা, যিনি কি না বংশগৌরবে অহংকারী, তিনি পূর্বপুরুষের কাছ থেকে কিছুটা বিত্ত আর মেজাজ পেয়েছিলেন বটে কিন্তু সেই সামন্তসমাজ ব্যবস্থা পাননি, যাতে তিনি মানুষকে গবাদিপশু জ্ঞান করে চারণ করতে পারেন। তাতে কী? তার স্বভাবের মধ্যে ছিল তার শ্রেণিচরিত্র, ফলে তিনি সবাইকে ডাকতেন ছোটলোক। যদিও তার কথিত ছোটলোকরা তার থেকে জ্ঞানে-গুণে, অর্থ-বিত্তে বড়। ফলে তার তালুকের প্রজাগণ ছিল না তার অনুগত, ফলে মনের কষ্টে, রাগে তিনি তাদের হত্যার হুমকি দিতেন, মামলা করতেন। এভাবেই তিনি তার শ্রেণিচরিত্রের সাধারণ মানুষকে উৎপাতের বৈশিষ্ট্য জারি রাখেন।

এই রচনার ভাষার দিকে লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে—আহমদ ছফার ভাষা বড় তীক্ষ্ণ, যা তীরের মতো হৃদয়ে আঘাত হানে। এই তীর সুখানুভূতি আর দুঃখবোধ যাই দিক, তা পাঠকের কাছে বড় তীব্র ঠেকে। উপন্যাসটি সংলাপধর্মী নয়, লেখক কথকের মুখ দিয়ে ঘটনা অত্যন্ত সরসভাবে বর্ণনা করে গেছেন। তার বর্ণনাতেই পুরো ঘটনাটি পাঠকের কাছে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। উপন্যাসটিজুড়ে মাত্র দুটি চরিত্রের নাম বলা হয়েছে। আহমদ ছফা কাজটি কেন করেছেন তা বলা যায় না। তবে এতে কথকের ভাষায় পুরো উপন্যাসটি বর্ণনা করা লেখকের জন্য সুবিধাই হয়েছে।

আহমদ ছফা এ উপন্যাসে অনন্য প্রতিভা ও সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। এ অসাধারণ সাহিত্যকীর্তিটি পাঠ করার সময় পাঠক ভিন্ন ভিন্ন রূপ, রস, গন্ধ অনুভব করবেন। যদিও সব লেখার ক্ষেত্রেই এ কথা খাটে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস যথার্থই বলেছেন—‘লেখকের মতো পাঠকও তো সৃজনশীল মানুষ। এক একটি বই প্রত্যেক পাঠক পড়ে আর উপভোগ করে সম্পূর্ণ নিজের মতো করে, তার আনন্দ ও বেদনা এবং তৃপ্তি ও অস্বস্তি তার নিজের।’ পরিশেষে কামনা করি, যে বোবাত্বের দশা থেকে মুক্ত হয়ে বাঙালির অন্তরের গহীন থেকে ওঙ্কার উচ্চারিত হয়েছে—সেই উচ্চারিত ওঙ্কার যেন কালের গর্ভে বিলীন না হয়ে যায়।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

এসইউ