বই আলোচনা
মীরার গ্রামের বাড়ি: অনন্য পারিবারিক উপন্যাস
ফারজানা ইয়াছমিন শ্রাবণী
যে লেখককে পড়লে মনে হয়, জীবনের একেকটি মুহূর্ত যেন নিখাদ আনন্দে রূপ নেয়। তিনি নিঃসন্দেহে হুমায়ূন আহমেদ (১৩ নভেম্বর ১৯৪৮–১৯ জুলাই ২০১২)। বাংলা কথাসাহিত্যে সংলাপনির্ভর লেখার একটি নতুন ধারা সৃষ্টি করেছেন তিনি। একই সঙ্গে ছিলেন আধুনিক বাংলা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির পথিকৃৎ। নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও সমাদৃত তিনি। ৩ শতাধিক বইয়ের লেখকের দুটি চরিত্র—মিসির আলি ও হিমু; আজও পাঠকের মনের গভীরে অমর হয়ে আছে।
সম্প্রতি পড়েছি হুমায়ূন আহমেদের লেখা একটি অনন্য পারিবারিক উপন্যাস ‘মীরার গ্রামের বাড়ি’। এটি আবেগঘন পারিবারিক উপন্যাস। যেখানে শহুরে জীবনের বাস্তবতা ও গ্রামের নিস্তব্ধ প্রশান্তির মধ্যে চলমান মানসিক টানাপোড়েনকে সূক্ষ্মভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। লেখকের সহজ-সরল ভাষা, হাস্যরস ও জীবনঘনিষ্ঠ বর্ণনা উপন্যাসটিকে করে তুলেছে গভীর অথচ সাবলীল।
মীরা উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া, বুদ্ধিমতী, কিছুটা রাগী এবং নিজের চিন্তা-ভাবনা নিয়ে খুব সোজা-সাপ্টা। যা মনে আসে, মুখের ওপরই বলে দেয়। শেফা মীরার ছোট বোন। শান্ত, সরল ও পর্যবেক্ষণশীল। পরিবারের প্রতিটি ঘটনার দিকে তার নিবিড় নজর। আজহার সাহেব মীরার বাবা। গ্রামের প্রতি এক অদ্ভুত টান তার। সন্তানদের গ্রামের সৌন্দর্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত করাতে চান। মনোয়ারা বেগম একজন আদর্শ স্ত্রী ও মমতাময়ী মা। স্বামী ও সন্তানদের সুখ-দুঃখের সঙ্গী। দেলোয়ার গ্রামের বাড়ির কেয়ারটেকার। সরলপ্রাণ মানুষ, আজহার সাহেবের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল তিনি।
আরও পড়ুন
চেয়ারের মুখোমুখি: আত্মঘাতী বিমূর্ত উদযাপন
শেষের কবিতা: কাব্যধর্মী রোমান্টিক উপন্যাস
আজহার সাহেব একদিন পরিবারসহ গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যান। সেখানে নৌকা ভ্রমণ, মাছ ধরা, পিকনিক—সবকিছুর আয়োজন করা হয়। গ্রাম নিয়ে সবারই উচ্ছ্বাস থাকলেও মীরা কোনোভাবেই গ্রামের পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারে না। বাবা যেখানে গ্রামের মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত, সেখানে মীরা নিজের মধ্যে এক অজানা অস্থিরতা টের পায়।
হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে মীরা। অসুস্থতার আসল কারণ জানালে মা নির্বাক হয়ে যান। সহজ-সরল মনোয়ারা বেগম মেয়ের সমস্যার সমাধানে নানা উপায় খোঁজেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব জানিয়ে দেন আজহার সাহেবকে। তখনই উন্মোচিত হয় পারিবারিক কিছু গোপন সত্য—যা মীরার বাবার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হয় না। আর সেখান থেকেই সুখী পরিবারের আবেগময় অধ্যায়টি মোড় নেয় এক অন্ধকার পরিণতির দিকে।
‘মীরার গ্রামের বাড়ি’ একদিকে যেমন নিখুঁতভাবে এক মধ্যবিত্ত পরিবারের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছে; অন্যদিকে তেমনই দেখিয়েছে—নিজের আবেগকে অযথা প্রশ্রয় দিলে কেমন করে ভেঙে যেতে পারে এক সুন্দর সংসার, এক ভালোবাসাময় সম্পর্ক। উপন্যাসটি শেষ হয় এক গভীর বেদনা নিয়ে, যা পাঠককে ভাবায়—কত সামান্য ভুল, কত ছোট একটি সিদ্ধান্ত কখনো কখনো পুরো জীবনকেই পাল্টে দিতে পারে।
লেখক: শিক্ষার্থী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল।
এসইউ/জেআইএম