রাজধানীর কারওয়ান বাজারে দৈনিক প্রথম আলো কার্যালয়ে হামলার ঘটনায় গ্রেফতার ১৫ আসামির জামিন আবেদন শুনানি শেষে তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন।
সোমবার (২২ ডিসেম্বর) মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. জুয়েল রানা তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, ‘আসামি পক্ষের আইনজীবীদের ধন্যবাদ জানাই। তারা পত্রিকায় আগুন লাগানোর ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছেন। তবে কেউ মব সৃষ্টি করে নাশকতা করতে পারে না। মামলায় অভিযোগগুলো এমন ধারা অন্তর্ভুক্ত, যা জামিনযোগ্য নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘দেশের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য গণমাধ্যম প্রথম আলো পত্রিকায় আগুন লাগানো, লুটপাট চালানো সম্পূর্ণভাবে অন্যায়। দেশের একটি শোকের মুহূর্তে এমন ঘটনা অগ্রহণযোগ্য। হামলার ফলে পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট, জুলাই আন্দোলনের আর্কাইভসহ প্রায় ৩২ কোটি টাকার সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গ্রেফতার আসামিরা বিভিন্নভাবে প্রমাণিত হয়েছে, সামাজিক মাধ্যমে লাইভ ভিডিওসহ তাদের অংশগ্রহণ শনাক্ত করা হয়েছে। কাউকে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করা হয়নি।’
অন্যদিকে আসামি পক্ষের আইনজীবীরা আদালতে তাদের যুক্তি উপস্থাপন করেন। তারা বলেন, সামনে যাদের পাওয়া গেছে, তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ নেই। এটি মিথ্যা মামলা। যে কোনো শর্তে জামিন চাই। আমরা হামলার প্রতিবাদ জানাই এবং আমাদের মক্কেলদের বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে মামলা দায়ের করা হয়েছে।’
আসামি প্রান্ত সিকদারের আইনজীবী বলেন, ‘আমার মক্কেল একজন শ্রমিক। তাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ফাঁসানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তার সঙ্গে যে অভিযোগ করা হয়েছে, তা সঠিক নয়।’
মামলার এজাহার ও তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১৮ ডিসেম্বর রাত আনুমানিক ১১টা ১৫ মিনিটে ২০–৩০ জন অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতকারী দেশীয় অস্ত্র, লাঠিসোঁটা ও দাহ্য পদার্থসহ মিছিল নিয়ে প্রথম আলো কার্যালয়ের সামনে আসে। দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা বাধা দিলে তারা বেআইনিভাবে সেখানে অবস্থান নেয় এবং প্রথম আলোর বিরুদ্ধে উত্তেজনামূলক স্লোগান দিতে থাকে।
পরবর্তীতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উসকানিমূলক পোস্ট ও নির্দেশনার মাধ্যমে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে আরও লোক জড়ো করা হয়। রাত আনুমানিক ১১টা ৫০ মিনিটে প্রায় ৩৫০ থেকে ৪৫০ জন দুষ্কৃতকারী পরস্পরের যোগসাজশে প্রথম আলো কার্যালয়ের গেটের শাটার ও কাঁচ ভেঙে ভবনের ভেতরে প্রবেশ করে এবং ব্যাপক ভাঙচুর চালায়।
হামলাকারীরা কার্যালয়ের ভেতরে কর্মরত সাংবাদিক ও কর্মচারীদের মারধরের চেষ্টা করে, জীবননাশের হুমকি দেয় এবং বিভিন্ন তলায় থাকা আসবাবপত্র, নথিপত্র ও সরঞ্জাম নিচে ফেলে ভাঙচুর করে। ভবনের সামনে জড়ো করা সোফা, টেবিল, চেয়ার ও অন্যান্য সামগ্রীতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
এজাহারে উল্লেখ করা হয়, সন্ত্রাসীরা প্রায় দেড় শতাধিক কম্পিউটার ও ল্যাপটপসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইস ধ্বংস করে, যার আনুমানিক মূল্য এক কোটি ৭৫ লাখ টাকা। পাশাপাশি একাধিক লকার ভেঙে প্রায় ৭৫ লাখ টাকা নগদ অর্থ লুট করে নেয়। এছাড়া প্রথমা প্রকাশনের বিক্রয়কেন্দ্র থেকে বইপত্র লুট করা হয়।
অগ্নিসংযোগের ফলে সার্ভার রুম, হিসাব বিভাগ, কর সংক্রান্ত নথিপত্র, চুক্তিপত্র, আর্কাইভস, চেক ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দলিলাদি পুড়ে যায়। এতে প্রাথমিকভাবে প্রথম আলো ভবনের মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩২ কোটি টাকা বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা যাচাই শেষে আরও বাড়তে পারে।
রাত আনুমানিক দেড়টার দিকে আগুন তীব্র আকার ধারণ করলে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। তবে আসামিরা ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশে বাধা দেয় এবং কর্মীদের হুমকি দেয়, ফলে আগুন নিয়ন্ত্রণে বিলম্ব ঘটে এবং পাশের ভবনগুলোতে আগুন ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
হামলার ঘটনায় প্রথম আলো কার্যালয়ে কর্মরত সাংবাদিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চরম প্রাণনাশের আতঙ্কে পড়েন। এ ঘটনার কারণে ১৯ ডিসেম্বর দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার ছাপা সংস্করণ প্রকাশিত হয়নি এবং অনলাইন সংস্করণের কার্যক্রমও প্রায় ১৭ ঘণ্টা বন্ধ ছিল, যা পত্রিকাটির ২৭ বছরের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা।
তদন্তকালে সিসিটিভি ফুটেজ, বিভিন্ন মিডিয়ার ভিডিও এবং গোপন সূত্রের তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১৫ জনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতার আসামিদের মধ্যে মো. নাইম ইসলামের কাছ থেকে লুণ্ঠিত ৫০ হাজার টাকা এবং লুণ্ঠিত অর্থ দিয়ে কেনা একটি ফ্রিজ ও একটি এলইডি টিভি উদ্ধার করা হয়েছে।
গ্রেফতার আসামিরা হলেন, মো. নাইম ইসলাম, মো. সাগর ইসলাম, মো. আহাদ শেখ, মো. বিপ্লব, মো. নজরুল ইসলাম মিনহাজ, মো. জাহাঙ্গীর, মো. সোহেল মিয়া, মো. হাসান, মোহাম্মদ রাসেল, মো. আব্দুল বারেক শেখ ওরফে আলামিন, মো. রাশেদুল ইসলাম, মো. সাইদুর রহমান, আবুল কাশেম, মো. প্রান্ত সিকদার ও মো. রাজু আহম্মেদ।
এমডিএএ/আরএইচ