রাজধানীর গুলশান অ্যাভিনিউ। গাড়ির হর্ন, পথচারীর ব্যস্ততা, শহরের সব রকম শব্দ—সব মিলিয়ে দিনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রাজধানীর ছন্দ চলছেই। তবু এই ব্যস্ততার মধ্যেও চোখে পড়ে একটি বাড়ি, যা নীরবে আলাদা হয়ে আছে। ১৯৬ নম্বর। বাহ্যিকভাবে সাধারণ, কিন্তু চারপাশের নিরাপত্তা, অস্থায়ী ছাউনি ও সিসিটিভি ক্যামেরা দেখাচ্ছে—এখানেই প্রতীক্ষা জমে আছে।
দীর্ঘ ১৭ বছরের প্রবাস জীবনের পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ফিরে আসছেন এই ঠিকানায়।
দলীয় সূত্র জানায়, তারেক রহমানকে বহনকারী বিমান বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। তার সঙ্গে দেশে ফিরেছেন স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান ও মেয়ে ব্যারিস্টার জাইমা রহমান।
তারেক রহমানকে বহনকারী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট বাংলাদেশ সময় বুধবার রাত সোয়া ১২টায় লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দর ত্যাগ করে।
সংবর্ধনার প্রস্তুতি
তারেক রহমানকে বরণ করতে ব্যাপক উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনা বিরাজ করছে বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে।
দলীয় নেতাদের ভাষায়, এটি কেবল একজন নেতার দেশে ফেরা নয়, এটি একটি সময়ের অবসান। বিমানবন্দর থেকে ৩০০ ফিট এলাকায় সংবর্ধনা মঞ্চে পৌঁছে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেবেন তারেক রহমান। এরপর এভারকেয়ার হাসপাতালে ছুটে যাবেন তার মা, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে দেখতে। এরপর যাবেন গুলশানের ১৯৬ নম্বর বাড়িতে।
ইতিহাসের সাক্ষী১৯৬ নম্বর বাড়িটি কেবল একটি আবাস নয়, এটি জিয়া পরিবারের রাজনৈতিক ইতিহাসের অংশ। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শহীদ হওয়ার পর তৎকালীন সরকার এই বাড়িটি খালেদা জিয়াকে বরাদ্দ দেয়।
বছরের পর বছর বহু উত্থান-পতনের সাক্ষী হয়েছে এই বাড়ি। রাতের বৈঠক, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত—সবই যেন দেওয়ালের ভেতরে জমে আছে। কয়েক মাস আগে আনুষ্ঠানিকভাবে বাড়িটির মালিকানা দলিল হস্তান্তর করা হয় বিএনপি চেয়ারপারসনের কাছে।
আরও পড়ুনতারেক রহমানের জন্য প্রস্তুত গুলশানের ১৯৬ নম্বর বাড়িগুলশানের ১৯৬ নম্বর বাড়িতে উঠবেন তারেক রহমান
পাশের বাড়ি ‘ফিরোজা’, খালেদা জিয়ার দীর্ঘদিনের বাসভবন। বর্তমানে তিনি হাসপাতালে, আর পাশের বাড়িটি প্রস্তুত হয়েছে আরেক প্রত্যাবর্তনের জন্য। সামান্য ভৌগোলিক দূরত্ব, কিন্তু রাজনৈতিক তাৎপর্য প্রবল।
নিরাপত্তার প্রহরাবুধবার রাতে ১৯৬ নম্বর বাড়ির পাশে গিয়ে দেখা যায়, সংস্কার কাজ শেষ। দেওয়ালে নতুন রং, নির্মাণসামগ্রী সরানো হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা টহল দিচ্ছেন, বসানো হয়েছে একাধিক চেকপোস্ট।
রাত থেকেই সামনের সড়কে সাধারণ মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রিত। আশপাশের গলিতে চোখে পড়ে তারেক রহমানের ছবি সংবলিত ব্যানার ও ফেস্টুন। শহরের এই অংশ যেন অপেক্ষার পোস্টারে ভরে উঠেছে।
দলীয় সূত্র জানায়, সরকারি নিরাপত্তার পাশাপাশি বিএনপির নিজস্ব ব্যবস্থাপনাতেও আলাদা নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়েছে।
রাজনৈতিক কার্যালয়ে প্রস্তুতি
শুধু বাসভবন নয়, গুলশানের বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়েও তারেক রহমানের জন্য আলাদা কক্ষ প্রস্তুত। নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও একই ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
এছাড়া, গুলশানের ৯০ নম্বর সড়কের ১০/সি বাড়িতে নতুন চারতলা কার্যালয়ে কার্যক্রম শুরু করেছে। এখান থেকেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালিত হবে বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে।
নতুন কার্যালয়ের দোতলায় আধুনিক ব্রিফিং কক্ষ, আর বিভিন্ন তলায় গবেষণা সেল ও বিভাগভিত্তিক দপ্তর গড়ে তোলা হয়েছে। এখানে চলছে নির্বাচন, নীতি ও রাষ্ট্রীয় সংস্কার সংক্রান্ত প্রস্তুতি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে বিএনপির রাজনীতিতে নতুন অধ্যায় শুরু হচ্ছে। সব প্রস্তুতি সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই নেওয়া হয়েছে।
১৯৬—একটি অপেক্ষা
গুলশানের ১৯৬ নম্বর বাড়িটি এখন আর শুধু ইট-কাঠের কাঠামো নয়। এটি হয়ে উঠেছে অপেক্ষা, স্মৃতি এবং সম্ভাবনার ঠিকানা। দীর্ঘ প্রবাসের পর রাজনৈতিক নেতার ফেরা যেমন দলীয় কর্মীদের আবেগে ভাসাচ্ছে, তেমনি দেশের রাজনীতিতেও তৈরি করছে নতুন হিসাব-নিকাশ।
শহরের কোলাহলের মধ্যে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা এই বাড়িটি যেন সময় গুনছে—একটি ফেরার মুহূর্তের জন্য।
কেএইচ/এমএমএআর/এমএস