বিশ্বনবি ও শ্রেষ্ঠনবি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষকে বিভক্তির বেড়াজাল থেকে মুক্ত করার জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। তিনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি মানুষকে ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী হিসেবে নয় বরং মানুষকে তিনি মানুষ হিসেবেই সম্মান করতেন।
মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশ্ববাসীর নেতা ছিলেন, তথাপি তিনি নিজ স্বার্থে কোনো প্রতিশোধ নিতেন না বরং শত্রুদের সাথে এবং বিধর্মীদের সাথেও উত্তম ব্যবহার করেছেন।
হজরত নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার উম্মতকেও এই নির্দেশই দিয়েছেন, তারাও যেন জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী নির্বিশেষে সবার সাথে উত্তম আচরণ করে। মহানবির (সা.) অতুলনীয় জীবনাদর্শ থেকে কয়েকটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরার চেষ্টা করব, যাতে আমরা সহজেই বুঝতে পারি ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সাথে তার ব্যবহার কেমন ছিল।
হজরত আবুবকর (রা.)এর কন্যা হজরত আসমা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে আমার অমুসলিম মা আমার কাছে এলেন। আমি মহানবিকে (সা.) জিজ্ঞেস করলাম-আমি কি তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করব? তিনি (সা.) বললেন, হ্যাঁ।’ (সহিহ বুখারি)
হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘একদা এক বেদুইন মসজিদে প্রস্রাব করলো। লোকেরা উঠে (তাকে মারার জন্য) তার দিকে গেল। মহানবী (সা.) বললেন, তার প্রস্রাব বন্ধ করো না। তারপর তিনি (সা.) এক বালাতি পানি আনলেন এবং পানি প্রস্রাবের ওপর ঢেলে দেওয়া হলো।’ (বুখারি)
হজরত নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ এতটাই অতুলনীয় ছিল যে, তিনি ইহুদির লাশকেও সম্মান দেখিয়েছেন।
হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, একবার এক ইহুদির লাশ মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, আর এতে মহানবি (সা.) সেই লাশের সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে ছিলেন ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না লাশটি তার সামনে থেকে চলে যায়। পাশ থেকে হজরত জাবের (রা.) বলেছিলেন, হে আল্লাহর রসুল! এটি তো ইহুদির লাশ। এতে আল্লাহর রসুল উত্তর দিয়েছিলেন, সে কি মানুষ ছিল না? (সহিহ বুখারি, হাদিস নং ১৩১১)
যে নবি এক ইহুদির লাশকে সম্মান জানানোর জন্য তার সাথিদেরকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন, সেই নবির উম্মতের পক্ষে কীভাবে সম্ভব শুধু ধর্মীয় মতপার্থক্যের কারণে কারো ওপর অন্যায় অত্যাচার করা?
অমুসলিমদের অন্যায়ভাবে হত্যা করা নিষেধ। যারা নবিজির আদেশকে অমান্য করে সমাজের বিভিন্ন গর্হিত কাজ করে, তাদের সাথে প্রকৃত ইসলামের সম্পর্ক নেই। তাদের জন্য জান্নাতের দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। নবিজি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করল, সে জান্নাতের সুগন্ধি পাবে না। অথচ তার সুগন্ধি ৪০ বছরের রাস্তার দূরত্ব থেকেও পাওয়া যায়।’ (বুখারি)
যুদ্ধের ময়দানেও তিনি অমুসলিমদের সম্মান দেখাতেন। শান্তির দূত হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার জীবদ্দশায় অনেকগুলো যুদ্ধ পরিচালনা করার পরও তিনি কাউকে নিজ হাতে কতল করেননি।
শুধু তাই নয়, যুদ্ধের ময়দানেও অমুসলিমদের মধ্যে যারা নিরপরাধ ও ধর্মীয় পণ্ডিত, তাদের সম্মানে নিজ সৈনিকদের নির্দেশ দিতেন, ‘শিশু, বৃদ্ধ, নারী, ধর্মীয় পণ্ডিত এবং যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি, তাদের বিরুদ্ধে যেন মুসলিম বাহিনী কোনো অস্ত্র না ধরে’। একইভাবে অমুসলিমদের প্রার্থনালয় ও সম্পদ যেন নষ্ট না হয় সে ব্যাপারেও ছিল কঠোর নির্দেশ।
হজরত সুফিয়ান ইবনে সালিম (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘মনে রেখো, যদি কোনো মুসলমান অমুসলিম নাগরিকের ওপর নিপীড়ন চালায়, তার অধিকার খর্ব করে, তার কোনো বস্তু জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয়, তাহলে কেয়ামতের দিন আমি আল্লাহর আদালতে তার বিরুদ্ধে অমুসলিম নাগরিকদের পক্ষাবলম্বন করব।’ (আবু দাউদ)
হজরত রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কোনো অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন।’ (মুসনাদে আহমদ)
এছাড়া মহানবি (সা.) এটিও বলেছেন, ‘তোমরা মজলুমের বদদোয়া থেকে বেঁচে থেকো, যদিও সে কাফের হয়, তার মাঝখানে আর আল্লাহর মাঝখানে কোনো পর্দা নেই (অর্থাৎ তার বদদোয়া দ্রুত কবুল হয়ে যায়)।’ (মুসনাদে আহমদ)
আমরা লক্ষ্য করি, মানব সেবায় আত্মনিয়োগকারী ব্যক্তির প্রতিও মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন ও তাদের খেয়াল রাখতেন।
একবার তাঈ গোত্রের লোকেরা মহানবির (সা.) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। এতে তাদের কিছুসংখ্যক লোক বন্দী হয়ে এসেছিল। তাদের মধ্যে আরবের প্রসিদ্ধ দাতা হাতেমের এক মেয়েও ছিল। যখন সে মহানবির (সা.) কাছে বললো, সে হাতেম-তাঈর মেয়ে, এ কথা শুনে মহানবি (সা.) তার সঙ্গে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে ব্যবহার করলেন এবং তার সুপারিশক্রমে তার গোত্রের শাস্তি ক্ষমা করে দিলেন।’ (সিরাত হালবিয়া, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা : ২২৭)
আমরা যদি সেই সময়ের ঘটনা লক্ষ্য করি, যখন মক্কার লোকেরা মহানবির (সা.) কোনো কথাই যখন শুনতে চাচ্ছিল না, তখন তিনি (সা.) তায়েফের দিকে দৃষ্টি দিলেন। যখন তিনি (সা.) তায়েফ পৌঁছলেন, তখন সেখানকার নেতৃবৃন্দ তার সাথে দেখা করার জন্য আসতে লাগলো। কিন্তু কেউই সত্য গ্রহণ করতে রাজি হলো না। সাধারণ লোকেরাও তাদের নেতাদেরই অনুসরণ করল এবং আল্লাহর বাণীর প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করতে লাগলো আর পরিশেষে তারা সব ভবঘুরে ছেলে ছোকরাদেরকে একত্রিত করলো। তারা প্রত্যেকেই ঝোলা ভর্তি পাথরের টুকরা নিল। তারা নির্মমভাবে মহানবির (সা.) ওপর পাথর ছুঁড়তে থাকে। অবিশ্রান্তভাবে পাথর মারতে মারতে মহানবিকে (সা.) শহর থেকে বাইরে নিয়ে গেল। শ্রেষ্ঠ রসুলের দুটি পা রক্তাক্ত হয়ে উঠলো। তারপরও তারা ঠান্ডা হলো না, যতক্ষণ না তিনি (সা.) শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে একটি পাহাড়ে এসে পৌঁছলেন। এই লোকগুলো যখন তার পিছু পিছু ধাওয়া করছিল, তখন তিনি এই ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছিলেন যে, আল্লাহর গজব না আবার তাদের ওপর পড়ে।
তিনি (সা.) আকাশের দিকে মুখ তুলে দেখছিলেন এবং কাতর প্রাণে প্রার্থনা করছিলেন, “হে আল্লাহ! তুমি এদেরকে ক্ষমা করে দাও! কেননা এরা জানে না, এরা কি করছে।’
দেখুন নবিজির রক্তে রঞ্জিত হয়েছে তায়েফের জমিন। ওহুদের ময়দানে হারাতে হয়েছে পবিত্র দাঁত। তারপরও তিনি তাদের জন্য বদদোয়া করেননি। বরং মহানবির পবিত্র সাহাবিরা (রা.) যখন হজরত রসুল (সা.) এর কাছে আবেদন জানাতেন, ‘হে আল্লাহর রসুল! মুশরিকদের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে দোয়া করুন।’ তখন নবিজি রক্তাক্ত চেহারা মুছতে মুছতে বলতেন, ‘আমি অভিশাপ দেওয়ার জন্য আসিনি, বরং আমি এসেছি ক্ষমা প্রার্থনার জন্য।’ এরপর তিনি দোয়া করতেন, ‘হে আমার মালিক! আমার লোকদের ক্ষমা করুন। তারা জানে না যে, তারা কী করছে।’ (মুসলিম)
তাই তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, ‘যে মানুষের প্রতি দয়া করে না, আল্লাহও তার প্রতি দয়া করেন না।’ (মুসলিম)
এমনিই ছিলেন আমাদের প্রিয়নবি, মানব দরদি রসুল, শ্রেষ্ঠ রসুলের (সা.) আদর্শ। আমরা যদি মহানবির (সা.) জীবনাদর্শ পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখতে পাই, তিনি অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সাথে কতই না উত্তম আচরণ করেছেন।
জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী সকলকে সম্প্রীতির বাঁধনে আবদ্ধ করেছেন। এই সম্প্রীতির শিক্ষাই তিনি তার উম্মতকে দিয়ে গেছেন। মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্প্রীতির যে দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, এরূপ দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণ থেকে তা সুস্পষ্ট। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কণ্ঠে ঘোষিত হয়েছে-‘হে মানবমণ্ডলী! তোমাদের আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় এবং তোমাদের আদিপিতাও এক। একজন আরব একজন অনারব থেকে কোনো মতেই শ্রেষ্ঠ নয়। তেমনি একজন আরবের ওপরে একজন অনারবেরও কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। একজন সাদা চামড়ার মানুষ একজন কালো চামড়ার মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়, আবার কালোও সাদার চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়। শ্রেষ্ঠত্বের মূল্যায়ন করতে বিচার্য বিষয় হবে, কে তাকওয়া তথা আল্লাহ ও বান্দার হক কতদূর আদায় করল। এর মাধ্যমেই আল্লাহর কাছে তোমাদের সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী সেই ব্যক্তি, যিনি সর্বাপেক্ষা বেশি ধর্মপরায়ণ।’ (বায়হাকি)
আল্লাহপাক আমাদেরকে শ্রেষ্ঠনবির অতুলনীয় আদর্শ অনুসরণ করে চলার তৌফিক দান করুন, আমিন।
লেখক: প্রাবন্ধিক, ইসলামি চিন্তাবিদ।masumon83@yahoo.com
এইচআর/জেআইএম