জাহাঙ্গীর আলম শান্ত নরসিংদীর সন্তান। তিনি এসএসসিতে নরসিংদীর বারৈচা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পান। এরপর তেজগাঁও সরকারি বিজ্ঞান কলেজে ভর্তি হন। এখান থেকে এইচএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ-৫ অর্জন করেন। একসময় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার ইচ্ছে বদলে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। সেই থেকে এইচএসসির পর চলে দিন-রাত মেডিকেল ভর্তি প্রস্তুতি। এরপর দীর্ঘ চেষ্টা ও কঠোর অধ্যাবসায়ের ফলে সাফল্যের দেখা পান। মেডিকেল ও ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে শান্ত ৯১.২৫ নম্বর পেয়ে সারাদেশে প্রথম স্থান অধিকার করেন। তার পথচলার গল্প শুনিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—
জাগো নিউজ: আপনার শৈশব ও বেড়ে ওঠা সম্পর্কে জানতে চাই—জাহাঙ্গীর আলম শান্ত: আমার বেড়ে ওঠা নরসিংদীর বেলাবো উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের খামারের চর গ্রামে। বাবা ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান ও মা গৃহিণী ফেরদৌসী বেগম। তিন ভাই-বোনের মধ্যে আমি সবার বড়। দুই বোন স্থানীয় বিদ্যালয়ে নবম ও দশম শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। শৈশবে তেমন কিছু হওয়ার ইচ্ছে মাথায় কাজ করতো না। তবে এমন পেশা খুঁজছিলাম, যে পেশায় থেকে মানুষের সেবা এবং উপকার করা যায়। এমন একটি পেশা বেছে নেওয়ার ইচ্ছে কাজ করতো। তখন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে এরকম সংকল্প ছিল না। ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় ২০২৩ সালের ডিসেম্বর থেকে মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।
জাগো নিউজ: ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির সময় দৈনিক রুটিন কেমন ছিল?জাহাঙ্গীর আলম শান্ত: অ্যাডমিশনের সময় সকাল ৬টায় ঘুম থেকে উঠে পড়াশোনা শুরু করতাম। এরমধ্যে পড়তে পড়তে নাস্তা করে মাঝেমধ্যে সকাল ১০টায় হালকা ঘুমাতাম। না হয় দুপুরের পর একেবারে ঘুমাতাম। এরপর ঘুম থেকে উঠে বিকেলে আবার পড়তে বসতাম। সন্ধ্যা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত পড়াশোনা করতাম। বলা যায়, সকাল ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত পড়তাম। ভর্তি পরীক্ষার তিনমাস ঢাকায় থেকে প্রস্তুতি নিয়েছি।
জাগো নিউজ: আপনি মূল বই পড়েছেন নাকি সহায়ক বইয়ের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন?জাহাঙ্গীর আলম শান্ত: সব সময় মূল বইয়ের দিকে ফোকাস করেছি। জীববিজ্ঞান বইটি প্রায় ৭-৮ বার পড়েছি। মূল বইয়ের পাশাপাশি অনেক লেখকের বই আছে। সেখান থেকে মূল বইয়ের বাইরের কোনো টপিক বা প্রশ্ন থাকলে পড়তাম। ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, বায়োলজি—মূল বই ফোকাস করে পড়েছি। কারণ মূল বই থেকেই মেডিকেলের প্রশ্ন হয়ে থাকে। পড়ার সময় কিছু বিষয় অনেক সময় আয়ত্তে আসতো না। কোনো বিষয় পড়ে বইটি উল্টিয়ে নিজে নিজে চেষ্টা করতাম। তারপর সেখানে কোনো বিষয় ভুলে গেলে বারবার রিভিশন দিতাম। পড়ার সময় কোনো বিষয় না পারলে নোট করে রাখতাম। তারপর আবার সেসব বিষয় রিভিশন দিতাম। এভাবে কঠিন বিষয়গুলো আয়ত্তে চলে আসে।
জাগো নিউজ: মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছেন জানার পর প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?জাহাঙ্গীর আলম শান্ত: আমাদের পরীক্ষা হয়েছিল শুক্রবার। রেজাল্ট দেওয়ার কথা ছিল রবিবার। পরীক্ষার পর বাসায় এসে বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের উত্তরের সাথে মিলানোর চেষ্টা করি। আমি একশটি প্রশ্নের উত্তর দাগিয়েছি। সেখানে দেখা যায় সবগুলোতেই ৯২ থেকে ৯৩টি সঠিক হয়। আমি প্রথম হবো, এটা কখনোই ভাবিনি। তবে ভালো রেজাল্ট করবো বিশ্বাস ছিল। এ জন্য রেজাল্টের ১ ঘণ্টা আগে চুল কেটে পরিপাটি হয়ে নিই। সেদিন দুপুর ২টায় রেজাল্ট দেওয়ার কথা ছিল। তবে রেজাল্ট দেওয়া হয় বিকেল পাঁচটায়। আমি তখন ফেসবুকে রেজাল্ট প্রকাশের খবর দেখলাম। এরপর তথ্য পূরণ করে ওয়েবসাইটে প্রবেশ করি। সাইটে প্রবেশের পর পজিশন প্রথম দেখতে পাই। তখন উত্তেজিত হয়ে চিৎকার দিতে থাকি! আমার মামা ও বন্ধু সাথে ছিল। আমিসহ সবাই খুশিতে কান্না করে ফেলি। সেদিনের কথা মনে হলে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। সেদিন আমি ঢাকাতেই ছিলাম। মা বললেন, ‘পরীক্ষা দেওয়া শেষ, এখন বাড়িতে চলে আসো।’ সেদিন মাকে বলেছিলাম, ‘মেডিকেলে চান্স না পেয়ে বাড়িতে যাবো না।’
আরও পড়ুনদুইবার ফেল করেও বোর্ডে প্রথম হয়েছিলাম: গৌরাঙ্গ চন্দ্র দেবনাথ নিজেকে সব সময় আত্মবিশ্বাসী রাখার চেষ্টা করেছি: শারমিন
জাগো নিউজ: ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করার জন্য কোচিং সেন্টারের ভূমিকা কতটুকু?জাহাঙ্গীর আলম শান্ত: পড়াশোনার ক্ষেত্রে আগ্রহের বিষয়টা সবচেয়ে জরুরি। পড়াশোনার আগ্রহ না থাকলে যত কোচিং সেন্টারেই ভর্তি হোক, কাজে আসবে না। যদি নিজে পড়াশোনা করে তবে কোচিং সেন্টারগুলো সহায়ক ভূমিকা হিসেবে পালন করে। ৬০-৭০ হাজার শিক্ষার্থী কোচিং করে থাকেন। তবে সর্বসাকুল্যে চান্স পায় মাত্র ৫ হাজার। মেডিকেলের পড়া মুখস্থনির্ভর। এখানে নিজে নিজে পড়াই সবচেয়ে বেশি কাজে দেয়। তবে কীভাবে পড়বো, কোন টপিক পড়বো এবং কোনো টপিক না বোঝা—বিষয়গুলো সম্পর্কে কোচিং সেন্টার সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আমি ইন্টারমিডিয়েট ঢাকাতে দিই। সেই সুবাদে ঢাকাতে বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করতাম। তখন কোচিং সেন্টারে কিছু কোর্স ছিল। সেখান থেকে যে বিষয় ভালো লাগতো। সে বিষয়ে ক্লাস করতাম। অ্যাডমিশনের আগে অনলাইনে ক্লাস করতাম। অ্যাডমিশনের পর অফলাইনে ক্লাস করতাম। এরপর কয়েকটা কোচিং সেন্টারে পরীক্ষা দিতাম।
জাগো নিউজ: নোট করার কোনো বিশেষ পদ্ধতি ছিল; যা অন্যদের চেয়ে এগিয়ে রেখেছে?জাহাঙ্গীর আলম শান্ত: পড়ার টেবিলের সামনে দেওয়াল ছিল। পড়ার সময় যেসব বিষয় পারতাম না; সেসব বিষয় লিখে দেওয়ালে লাগিয়ে রাখতাম। মেডিকেলের প্রশ্নের মধ্যে দেখা প্রায় ৭টা প্রশ্ন এখান থেকে সরাসরি এসেছে।
জাগো নিউজ: আপনার এই সাফল্যের পেছনে বাবা-মা বা অন্যদের অবদান সম্পর্কে কিছু বলুন—জাহাঙ্গীর আলম শান্ত: আমার সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান বাবা-মায়ের। কারণ এইচএসসির প্রথমদিকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে প্রস্তুতির একটা ইচ্ছে ছিল। তাই বাড়ি থেকে বলে গিয়েছিলাম ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষা দেবো। তবে একসময় ইঞ্জিনিয়ারিং বদলে মেডিকেলে পড়ার সিদ্ধান্ত নিই। তখন বাড়ি থেকে সাপোর্ট দেওয়া হয়। তারপর ভর্তি কোচিং থেকে শুরু করে আর্থিকভাবে কোনো কিছুর কমতি ছিল না। আত্মীয়-স্বজন, শিক্ষক, বন্ধু-বান্ধব—সবাই মানসিকভাবে সাপোর্ট দিয়েছেন। তারা নিয়মিত আমার এবং পড়াশোনার খোঁজ-খবর রাখতেন। বাবা-মা বাড়ি থেকে প্রায়ই আমাকে দেখতে আসতেন।
জাগো নিউজ: ভবিষ্যতে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় কোনো বিশেষ পরিবর্তন আনার স্বপ্ন দেখেন?জাহাঙ্গীর আলম শান্ত: অবশ্যই পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখি। নিজের জায়গা থেকে সৎ থেকে এগিয়ে যেতে চাই। দেশের জন্য এবং দেশের মানুষের জন্য যতটুকু সম্ভব করার চেষ্টা করবো। ভবিষ্যতে ক্যানসার বা ক্যানসার বিশেষজ্ঞ হয়ে কাজ করার স্বপ্ন আছে।
জাগো নিউজ: যারা মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা দেবেন; তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?জাহাঙ্গীর আলম শান্ত: আগামীতে যারা মেডিকেল পরীক্ষা দেবেন; তাদের বর্তমানে একাডেমিক পিরিয়ড চলছে। এ সময়টায় একাডেমিক পড়াশোনায় মনোযোগী হতে হবে। একাডেমিক পড়াশোনায় মনোযোগী না হলে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করা কঠিন হয়ে পড়ে। যাদের একাডেমিক ভীত মজবুত; তাদের জন্য মেডিকেলে ভালো করা সম্ভব। এইচএসসি ২৬ এবং ২৭ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা প্রস্তুতি এখন থেকেই শুরু করতে পারেন। একেকটা অধ্যায় শেষ করার পর মেডিকেল প্রশ্নের প্যাটার্ন অ্যানালাইসিস করতে পারেন। একাডেমিক থেকেই উচিত মেডিকেলের পড়াশোনা এগিয়ে রাখা। তাহলে তারা অন্যদের থেকে এগিয়ে থাকবেন।
এসইউ