লাদাখের লে শহর থেকে চীনের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ সীমান্তের কাছের গ্রাম তাংৎসে। এক সময় এই পথ পাড়ি দিতে লাগতো প্রায় এক সপ্তাহ। পাঁচ বছর আগেও পুরো একটি দিন লেগে যেতো। কিন্তু ২০২৫ সালের নভেম্বরে সেই পথ অতিক্রম করতে সময় লেগেছে মাত্র চার ঘণ্টা। প্রায় ১৭ হাজার ৬০০ ফুট উচ্চতার চাং লা গিরিপথ পেরিয়ে নতুন পাকা সড়ক ভারত-চীন সীমান্তকে এখন অনেকটাই ‘কাছে’ এনে দিয়েছে।
এই দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থার পেছনে রয়েছে ২০২০ সালে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় ভারত ও চীনের মধ্যে হওয়া রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। পাঁচ দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ওই সংঘর্ষের পর দুই দেশের সম্পর্ক নেমে যায় সর্বনিম্ন পর্যায়ে। উভয় পক্ষই বিপুল সংখ্যক সেনা মোতায়েন করে এবং সীমান্ত এলাকায় অবকাঠামো নির্মাণে জোর দেয়। পাঁচ বছর পর পরিস্থিতি কতটা বদলেছে, তা দেখতে সম্প্রতি দ্য ইকোনমিস্টকে পূর্ব লাদাখে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কয়েকটি স্থাপনা পরিদর্শনের বিরল সুযোগ দেওয়া হয়।
গালওয়ান সংঘর্ষের পর ভারত-চীন সম্পর্ক কার্যত স্থবির হয়ে পড়ে। সরাসরি ফ্লাইট বন্ধ থাকে, পর্যটন থেমে যায়, ভারত চীনা বিনিয়োগে কড়াকড়ি আরোপ করে। সাবেক ভারতীয় রাষ্ট্রদূত বিজয় গোখলে বলেন, ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পর এটিই ছিল দুই দেশের সম্পর্কের সবচেয়ে খারাপ সময়।
আরও পড়ুন>>অরুণাচলকে নিজেদের সঙ্গে যুক্ত করতে চায় চীনসম্পূর্ণ গালোয়ান উপত্যকা নিজেদের ভূখণ্ড বলে দাবি চীনেরচীনের কাছে জমি হারাচ্ছে ভারত, ২৬টি পেট্রোলিং পয়েন্ট হাতছাড়া
তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আংশিক উষ্ণতা ফিরছে। ২০২৫ সালের আগস্টে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চীন সফর করেছেন, অক্টোবরে সরাসরি ফ্লাইট আবার চালু হয়েছে, চীনও বিরল খনিজ ও ম্যাগনেট রপ্তানি ফের শুরু করেছে।
এই ঘনিষ্ঠতার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রেরও ভূমিকা রয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন ভারতের ওপর শুল্ক বাড়ানো, রাশিয়ার তেল আমদানির সমালোচনা এবং পাকিস্তানের সেনাপ্রধানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা দেখিয়ে দিল্লিকে কিছুটা অস্বস্তিতে ফেলেছে। তবে কূটনৈতিক উষ্ণতার বড় শর্ত ছিল লাদাখে উত্তেজনা কমা। সীমান্তে নতুন করে অস্থিরতা দেখা দিলে পুরো সম্পর্ক আবারও ভেঙে পড়তে পারে।
ভারত ও চীনের মধ্যে সুনির্দিষ্ট সীমান্ত নেই। রয়েছে ‘লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল’ বা এলএসি, যা নিয়েও উভয় পক্ষের ব্যাখ্যা ভিন্ন। এই বিভ্রান্তিই ২০২০ সালের সংঘর্ষের মূল কারণ। গালওয়ানের পর দুই দেশই এলএসি থেকে কিছুটা পিছিয়ে যায়, কয়েকটি এলাকায় বাফার জোন তৈরি হয়। ২০২৪ সালের শেষ দিকে কূটনৈতিক অগ্রগতির অংশ হিসেবে ডেপসাং ও দেমচোক এলাকায় সীমিত আকারে আবার পায়ে হেঁটে টহলের অনুমতি দেওয়া হয়, তবে দুই পক্ষের সেনাদের মধ্যে অন্তত ৩০০ মিটার দূরত্ব বজায় রাখা হচ্ছে।
এর ফলে সাময়িক স্বস্তি এলেও বিতর্ক রয়ে গেছে। স্থানীয় কিছু কর্মকর্তা ও অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় জেনারেলদের দাবি, বাফার জোন আসলে চীনের পক্ষে সুবিধাজনক। যদিও লাদাখে দায়িত্বপ্রাপ্ত ভারতীয় সেনা কর্মকর্তারা বলেন, এই ব্যবস্থা উভয় পক্ষের জন্যই সমান এবং চীনা সেনারা চুক্তি মেনেই চলছে।
তবে গালওয়ানের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব স্পষ্ট। ২০২০ সালে লাদাখে ভারতের ছিল মাত্র একটি ডিভিশন, এখন তা দ্বিগুণেরও বেশি, সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একটি সাঁজোয়া ব্রিগেড। নতুন বিমানঘাঁটি, স্থায়ী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। অন্যদিকে, চীনও থেমে নেই। প্যাংগং হ্রদের ওপর নতুন সেতু, সীমান্তঘেঁষা গ্রামে অবকাঠামো এবং এলএসি বরাবর স্থাপনা নির্মাণ বেড়েছে বহুগুণ।
ভারতের বড় চ্যালেঞ্জ হলো ভৌগোলিক বাস্তবতা। চীনের নিয়ন্ত্রণাধীন আকসাই চিন একটি মালভূমি হওয়ায় তারা দ্রুত সেনা সরাতে পারে। ভারতের পক্ষ থেকে আগাম নজরদারি বাড়ানোর চেষ্টা চললেও স্যাটেলাইট কাভারেজ এখনো সীমিত বলে স্বীকার করছেন কর্মকর্তারা।
সব মিলিয়ে বাস্তব চিত্র বলছে, ২০২৬ সালে বড় ধরনের সংঘর্ষের ঝুঁকি আগের তুলনায় কমেছে। তবে সীমান্ত বিরোধের মূল কারণগুলো অমীমাংসিতই রয়ে গেছে। চীনের দ্রুত সামরিক ও অর্থনৈতিক উত্থান, ভারত মহাসাগরে তার নৌ উপস্থিতি এবং দীর্ঘ সীমান্তজুড়ে বিরোধ—সবকিছু মিলিয়ে ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটেনি। বিজয় গোখলের ভাষায়, ‘এই সশস্ত্র সহাবস্থানের অবস্থা আরও অনেকদিন চলবে।’
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্টকেএএ/