সম্পূর্ণ গালোয়ান উপত্যকা নিজেদের ভূখণ্ড বলে দাবি চীনের
কাশ্মীর অঞ্চলের লাদাখ সীমান্তের চীন ও ভারতের মধ্যে যে গালওয়ান উপত্যকায় দুই দেশে সেনাদের সংঘর্ষের ঘটেছিল সেই বিতর্কিত অঞ্চলটিকে সম্পূর্ণ নিজেদের বলে দাবি করে বেইজিং বলছে, ওই অঞ্চল পুরোপুরি তাদের ভূখণ্ডের মধ্যে পড়ে। গত সোমবারের ওই সংঘর্ষে ভারতের ২০ সেনা নিহত হয়।
গত ১৫ জুনের ওই সংঘাতের জন্য নয়াদিল্লিকে দোষারোপ করে বেইজিং এই দাবি তুলে ধরেছে। সীমান্তে দুই পক্ষের প্রাণঘাতী সংঘর্ষ নিয়ে প্রথম সরকারি প্রতিক্রিয়ায় ভারতীয় সেনাদের বিরুদ্ধে ‘ইচ্ছাকৃত উস্কানির’ অভিযোগও তুলেছে চীন। ওই সংঘর্ষে আহত ভারতের ৭৬ সেনা এখন চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিঝিয়ান টুইট করে জানান, লাদাখের মালিকানা বিরোধপূর্ণ। ওই অঞ্চলের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর চীন-ভারত সীমান্তের গালোয়ান উপত্যকা দীর্ঘদিন ধরেই চীনের অংশ। সেখানে এর আগে থেকেই চীনা সেনারা নিয়মিত টহল দিয়ে এসেছে।
ধারাবাহিক কয়েকটি টুইটে গালওয়ান উপত্যকার অবস্থান প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার (এলএসি) চীনা অংশে বলে দাবি করা ছাড়া ঝাও আরও বলেছেন, গালওয়ান উপত্যকা পরিস্থিতি যখন প্রায় স্বাভাবিক তখন ভারতীয় সেনারা ইচ্ছাকৃতভাবে উস্কানি দিতে আবার প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা অতিক্রম করে।
গালোয়ান সংঘর্ষ নিয়ে চীনের অবস্থান তুলে ধরে তিনি বলেন, চীনা সেনা ও কর্মকর্তারা আলোচনার জন্য গেলে সীমান্তে মোতায়েন করা ভারতীয় সেনা সদস্যরা তাদের ওপর চড়াও হয়। এসময় দুইপক্ষে হাতাহাতি লড়াইয়ের সূত্রপাত হয়, যার ফলেই হতাহতের ঘটনা ঘটে।
তিনি আরও বলেন, কোনটা ঠিক আর কোনটা নয়, তা খুবই পরিষ্কার। সংঘাতের দায় যে পুরোটাই ভারতের তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এদিকে চীনা মুখপাত্রের এই দাবি ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রামনিয়াম জয়শঙ্করের ইতোপূর্বে দেওয়া বিবৃতির সম্পূর্ণ বিপরীত।
সীমান্তে সামরিক উপস্থিতি বাড়াচ্ছে দুই দেশ
গত সপ্তাহে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৪ হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত গালওয়ান উপত্যকায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের জেরে কূটনৈতিক-সামরিক পর্যায়ে টানা বৈঠকের পরেও সীমান্তে উত্তেজনা কমেনি দেশ দুটির মধ্যে। বরং উভয় পক্ষই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় সামরিক শক্তি বাড়িয়ে চলেছে বলে জানা গেছে।

টাইমস অব ইন্ডিয়া জানিয়েছে, চীন সীমান্তবর্তী ঘাঁটিগুলোতে আরও যুদ্ধবিমান পাঠানোর পাশপাশি বঙ্গোপসাগর এলাকায় রণতরিগুলোকেও তৈরি রাখা হয়েছে। লাদাখে অত্যাধুনিক অ্যাপাচে হেলিকপ্টার মোতায়েন করেছে ভারত, যাতে রয়েছে ট্যাংকবিধ্বংসী মিসাইল ও রকেট।
চীন যে ওই সংঘর্ষের আগে থেকেই সীমান্তে সামরিক উপস্থিতি বাড়াতে শুরু করেছে উপগ্রহ চিত্রে তাদের সেই তৎপরতাও প্রকাশ পেয়েছে। তারা প্যানগং লেকে কয়েক ডজন ঘাঁটি ছাড়াও তিব্বতের হোতান ও কাশগার বিমানঘাঁটিতে অত্যাধুনিক জে-১১ ও জে৮ যুদ্ধবিমান মোতায়েন করেছে বেইজিং।
এদিকে গতকাল শুক্রবার টেলিভিশনে সম্প্রচারিত এক বিবৃতিতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেছেন, ‘ভারতের ভূখণ্ডে আকস্মিক হামলার কোনো ঘটনা ঘটেনি। আমাদের সীমান্ত অতিক্রম করে কেউ প্রবেশ করেনি, সেখানে কেউ অবস্থানও নেয়নি, আমাদের কোনো পোস্টও হাতছাড়া হয়নি।’
দেশের ২০ সেনা নিহত, অর্ধ শতাধিক আহত ও চীনের হাতে ১০ সেনা আটকের পরও মোদির এমন মন্তব্যের পরপরই ভারতীয় গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, প্রকৃত ঘটনাটি তাহলে কী?
সোমবারের সংঘর্ষ ও তার আগের উত্তেজনার নেপথ্য ঘটনা
সোমবারের সংঘর্ষের ঘটনাকে সামরিক বিশ্লেষকরা উদ্বেগজনক বলছেন কারণে, দুই দেশের মধ্যে সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটারের সীমানা সংযোগ থাকলেও দীর্ঘ সাড়ে চার দশকে কোনো পক্ষে প্রাণহানির কোনো ঘটনা ঘটেনি। ১৯৭৫ সালে অরুণাচলে শেষ বার মৃত্যু হয়েছিল ৪ ভারতীয় সেনার।
দুই পরাশক্তি দশক ধরে বৃহত্তর জনমানবশূন্য অঞ্চল নিয়ে লড়াই করে আসছে। বিতর্কিত এসব সীমান্ত নিয়ে ১৯৬২ সালে দুই দেশের মধ্যে সংক্ষিপ্ত যুদ্ধ হয়েছিল। অবশ্য ভারতের তাতে শোচনীয় পরাজয় ঘটে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রতিবেশী এই দেশ দুটির মধ্যে সামরিক উত্তেজনার ঘটনা বেড়েছে।

কয়েক বছর ধরেই দুই দেশের সীমানা বিভাজনকারী রেখায় (এলএসি) ভারতের সড়ক ও সেতু বানানো নিয়ে চীনের অসন্তোষকে কেন্দ্র করে ওই অঞ্চলে দুই পক্ষের মধ্যে নতুন করে এ উত্তেজনার শুরু। ভারত বলছে, নিজেদের সীমানার ভেতর স্থানীয় মানুষের জন্যই এসব অবকাঠামো নির্মাণ হচ্ছে।
চীন সীমান্তে ভারত ষাট এর বেশি সড়ক তৈরি করছে বা সংস্কার করছে। মূলত লাদাখ থেকে ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি ঘাঁটি পর্যন্ত আড়াইশো কিলোমিটারের সড়ক নিয়েই চীন আপত্তি জানিয়ে আসছে। গত বছরের অক্টোবরে এই সড়কটির উদ্বোধণ করেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং।
স্থানীয়দের জন্য অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে বলে নয়াদিল্লি দাবি করলেও চীনের গণমাধ্যমগুলো সীমান্তে উসকানির জন্য ভারতকে দায়ী করে আসছে। নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর ভারতের এসব অবকাঠামো নির্মাণে চীন তাই বারবার বাধা দিয়ে আসছে। কৌশলতভাবে লাদাখের গলওয়ান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

সবশেষ উত্তেজনার শুরু গত মে মাসের শুরুতে। তিব্বত ও লাদাখ সীমান্তে সেনাদের মধ্যে হাতাহাতি-ধস্তাধস্তির মধ্য দিয়ে। মে মাসের শুরুতে লাদাখের গলওয়ান উপত্যকা ও প্যাংগং লেক ছাড়াও নেপাল সীমান্তবর্তী সিকিমের নাকু লায় দুই দেশের বাহিনীর মধ্যে উত্তেজনা ছড়ায়।
গত ৫ মে ভারতের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে, চীনা সেনারা তিনটি আলাদা পয়েন্টে সীমানা পেরিয়ে তাঁবু এবং প্রহরী চৌকি তৈরি করেছিল এবং মৌখিক সতর্কবাণী দেওয়া সত্ত্বেও তারা ফিরে যাওয়ার বিষয়টি অগ্রাহ্য করে। এ নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে বাগবিতন্ডা ও ধ্বস্তাধস্তির ঘটনা ঘটে।
৯ মে সিকিম সীমান্তে সেনাদের ধ্বস্তাধস্তি ও পাথর নিক্ষেপের ফলে সৃষ্ঠ সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন ভারতীয় ও চীনা সেনা আহত হয়। ভারত জানায়, লাদাখ অঞ্চলে সীমানা পেরিয়ে কয়েক কিলোমিটারে মধ্যে একাধিক ছাউনি গড়েছে চীনা সেনারা। এরপর ভারতও ওই অঞ্চলে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করে।
এরপর স্থানীয় সামরিক কর্মকর্তা স্তরে ও কূটনৈতিকভাবে বিবাদ নিরসন প্রচেষ্টা বিফলে যাওয়ার পর জুনের শুরুতে দুই পক্ষের শীর্ষ সামরিক কমান্ডাররা আলোচনা শুরু করেন; যা আগে কখনোই হয়নি। কয়েক দফা আলোচনা শেষে ভারত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বলে জানালেও সোমবার ওই ঘটনা ঘটে।
এসএ