বছর ঘুরে আবারো এসেছে নরসিংদীর ঐতিহ্যবাহী বাউলের মেলা। সপ্তাহব্যাপী এ মেলার আয়োজন নিয়ে চলছে মহা ধুমধাম। ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হবে ৬০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী এই বাউলের মেলা। ইতিমধ্যেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বাউলের মেলায় অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা দোকান বসিয়েছেন। অন্যদিকে বাউল ভক্ত ও সাধুরা যার যার আসনের জায়গা বাছাইয়ে নেমে পড়েছেন। নরসিংদীর মেঘনার তীরে বাউল ঠাকুরের আখড়া ধামকে ঘিরে প্রতি বছর এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। ভারত-নেপালসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বাউল সাধকরা এ মেলায় অংশ নিয়ে থাকে। বাউল সম্প্রদায়ের নিয়ম অনুযায়ী প্রায় ৬০০ বছর ধরে মাঘী পূর্ণিমা তিথীতে শহরের কাউরিয়াপাড়াস্থ শ্রী শ্রী বাউল ঠাকুরের আখড়ায় এই মেলার আয়োজন করা হয়। এর এক মাস পূর্বে জেলার শিবপুর উপজেলার তেলিয়া বাজারে পূজা অর্চনার মাধ্যমে মেলার সময়সূচি নির্ধারণ করা হয়। সেই অনুয়ায়ী মঙ্গলবার রাতে বাউলদের বৈঠক (গানের আসর) বসে। সেই বৈঠক এক টানা চলে বুধবার দুপুর পর্যন্ত। এতে খোল, করতাল, বেহালার সুরে চলে ধর্মীয় সঙ্গীত। বাউল ভক্তদের পাশাপাশি অনেকেই এই গানের আসরে যোগ দেয়।আয়োজক সূত্রে জানা গেছে, মেলার তৃতীয় দিন ১০ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার মাঘী পূর্ণিমায় শ্রী শ্রী বাউল ঠাকুরের মহাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হবে। মেলার উদ্যোক্তা ডা. সাধন বাউল, মৃদুল বাউল মিন্টু ও প্রানেশ বাউল ঝন্টু এই মেলার সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও সার্বক্ষণিক তদারকি করবেন। এ মেলার বিশেষত্ব হচ্ছে এটি একটি গ্রাম্য মেলা। কখন এই মেলা শুরু হয়েছিল তা নির্ধারিত কোনো তারিখ বা সন জানা যায়নি। তবে বিটিশ শাসনামলেরও পূর্ব থেকে নরসিংদীর মেঘনার তীরে এই বাউলের মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে বলে মেলা আয়োজনকারীরা জানান। কম বেশি ৬০০ শত বছরের এই পুরনো মেলায় গ্রাম বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক বাঙালির যুগ যুগের সংস্কৃতিকে ঘিরে এই মেলা আয়োজন করা হয়। মেলায় আমদানি হয় বাঙালির পুরনো কৃষি উপকরণ, কৃষি পণ্য, কৃষিজাত দ্রব্য, গৃহের আসবাবপত্র, গৃহস্থালির তৈজসপত্র, মাটির তৈরি জিনিসপত্র, খেলনা, বিভিন্ন ধরনের মিষ্ট দ্রব্য, বিভিন্ন ধরনের খাদ্যদ্রব্য, বিশেষভাবে ঢেঁকি, গাইল, ছেহাইট, চঙ্গ, লাঙল-জোয়াল, উমবাড়ি, লাঙলের ঈশ, লাঙলের ফাল, আঁচড়া এবং ছেলে মেয়েদের প্রাচীন খেলনা, বাঁশি ইত্যাদি।কুমিল্লার মুরাদনগর থেকে আসা ভক্ত সুমন বাউল বলেন, জীবের মঙ্গলার্থে বাউল ঠাকুরের আর্বিভাব হয়েছিল। কিভাবে সহজে মানুষ নিজকে নিজে চিনতে পারবে সেই পথ তিনি দেখিয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন, সবার ওপর মানুষ সত্য, তাহার ওপর কেউ নেই। আমরা গানের মাধ্যমে চিরন্তন সেই সত্য কথাটিই সবার মধ্যে প্রচার করছি।বৈঠকে যোগ দেয়া মিনাক্ষি বাউল বলেন, ‘আত্মরূপে সবার মধ্যে ভগবান অবস্থান করছে। আমরা গানের মাধ্যমে তারই অন্বেষণ করার জন্য এখানে এসেছি। এই ভাবটা যদি আমাদের সবার মধ্যে থাকে তাহলে আমাদের মধ্যে এই উপলব্ধি হবে, আমার মধ্যে যে ভগবান বিরাজ করছে সেই ভগবান তোমার মধ্যেও বিরাজ করছে। তাহলে আমি ইচ্ছা করলেও তোমাকে কোনো কষ্ট দিতে পারবো না, আঘাত করতে পারবো না। এই ভাবটা যদি পুরো জগতের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া যায় তাহলে আমি মনে করি জঙ্গিবাদ পৃথিবী থেকে ওঠে যাবে।মেলায় আসা ভক্তরা মনোবাসনা পূরণে বাউল ঠাকুরের সমাধিতে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করেন। নিজের ও পরিবারের সদস্যদের মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করেন। পরে দুপুরে জগৎবন্ধু ঠাকুরের মহাপ্রসাদ বিতরণ করা হয়। মেলায় শ্রীমঙ্গল থেকে আসা শংকর লাল পোদ্দার বলেন, যুগ যুগ ধরে আমাদের পরিবারের সদস্যরা বাউল মেলায় আসছি। পূর্বে আমাদের বাপ-দাদারা এই মেলায় এসেছিল। এখন আমরা আসছি। সারা বছর এই মেলার অপেক্ষায় থাকি। মেলায় নিজের ও পরিবারের জন্য ঠাকুরের নিকট প্রার্থনা করি। বাউল আখড়ার তত্বাবধায়ক ডা. প্রানেশ কুমার বাউল ঝন্টু বলেন, দেশ ও বিদেশ থেকে কয়েকশত বাউল ও আমাদের অনুসারীরা এই মেলায় যোগ দিয়েছে। মানবের মিলনের তাগিদে তারা সবাই এখানে মিলিত হয়েছে। এখানে জাতি, ধর্ম ও বর্ণের কোনো ভেদাভেদ নেই। আমাদের বিশ্বাস, একদিন সকল ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে পৃথিবীর সবাই একটি ধর্মে মিলিত হবে, সেটা হলো মানবধর্ম। সঞ্জিত সাহা/এআরএ/পিআর