ষোড়শ সংশোধনীর আপিল শুনানিতে অ্যামিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু) হিসেবে সাবেক বিচারপতি ও প্রবীণ আইনজীবী টিএইচ খান তার বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন।
আদালতে তিনি বলেছেন, ষোড়শ সংশোধনী যে সংসদে পাস হয়েছে সে সংসদের নির্বাচনই অবৈধ।
বিচারপতি টিএইচ খান ছাড়াও বৃহস্পতিবার অন্য দুই অ্যামিকাস কিউরিও তাদের যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। তারা হলেন প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার এম আমির উল ইসলাম ও ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা জাতীয় সংসদের কাছে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা সংক্রান্ত আপিল শুনানি সাতদিনের মতো শেষ হয়েছে বৃহস্পতিবার।
প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ এ শুনানি গ্রহণ করেন। এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ২৮ মে (রোববার) দিন ঠিক করেছেন আদালত।
এ সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা। ছিলেন এ আদেশের বিরুদ্ধে রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদও।
ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ সকাল ৯টার দিকে আদালতে তার বক্তব্য শুরু করেন। পরে নিজের শারীরিক অবস্থার কথা তুলে ধরে আদালতের কাছে প্রবীণ আইনজীবী টিএইচ খান অনুরোধ জানান, তাকে বক্তব্য উপস্থাপনের সুযোগ দেয়ার জন্য।
আদালত সঙ্গে সঙ্গে বিচারপতি টিএইচ খানকে সে সুযোগ দেন, টিএইচ খানের পক্ষে তার ছেলে আফজাল এইচ খান লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
অল্প সময়ে টিএইচ খান তার বক্তব্য শেষ করলে আবারও লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন শুরু করেন ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ।
এরপর ১১টায় বিরতিতে যান আদালত। বিরতির পর আবার রোকন উদ্দিন মাহমুদ বক্তব্য উপস্থাপন শেষ করেন। পরে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
আদালতে নিজের বক্তব্য উপস্থাপনের পর আফজাল এইচ খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘উনি (বিচারপতি টিএইচ খান) যে সাবমিশন দিয়েছেন সেটি হলো- হাইকোর্টের রায় বহাল রাখার বিষয়ে।’
‘ওই রায়ে বলা হয়েছে, ষোড়শ সংশোধনী ভয়েড এবং আল্ট্রাভাইরাস অর্থাৎ সংবিধানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এটাকে বাতিল করে দেয়াটাই শ্রেয়।’
ষোড়শ সংশোধনীর অন্তর্নিহিত কিছু বিষয় আছে তার পরিণতি কী হতে পারে, ভবিষ্যতে কী হতে পারে, বর্তমানে কী হতে পারে তার একটি ব্যাখ্যাও দিয়েছেন টিএইচ খান।
সেখানে তিনি বলেছেন, ‘ত্রয়োদশ সংশোধনীর বিষয়টি সেটেলড না করে ষোড়শ সংশোধনী আলোচনা ঠিক নয়। এটাকে প্রাসঙ্গিকভাবে দেখতে হবে ‘
অপর এক বিশ্লেষণে বিচারপতি টিএইচ খান বলেন, ‘ষোড়শ সংশোধনী যেটাকে বলা হচ্ছে এবং এটি পাস করেছে যে সংসদ, সেই সংসদ যেভাবে নির্বাচিত হয়েছে সে নির্বাচনটাই বৈধ না।’
‘সরকার বলে আসছে ত্রয়োদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানটি তারা বাতিল করেনি, করেছেন আদালত। ত্রয়োদশ সংশোধনী আসলেই আদালত বাতিল করেছিল? আর যদি ত্রয়োদশ সংশোধনী থেকে থাকে, এখনও বহাল থাকে তাহলে ত্রয়োদশ সংশোধনীর যে রায় দিয়েছেন ১৬ মাস পরে তখন তার (সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক) শপথ ছিল না।’
তিনি বলেন, ‘অবসরে যাওয়ার ১৬ মাস আগে তিনি (সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক) যখন শর্ট অর্ডার দিয়েছিলেন, সেখানে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দশম এবং একাদশ নির্বাচন হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছিলেন। তবে সেটা মূল রায়ে ছিল না। ওই রায়ের কোনো বৈধতা নেই। কারণ ওই রায়টা যখন দিয়েছেন, তখন তিনি বিচারক ছিলেন না। বিচারক হিসেবে তিনি রায় দেননি।’
ওই রায়ে যে দুজন বিচারপতি স্বাক্ষর করেছেন তারাও এ কাজটি ঠিক করেননি বলে উপস্থাপনায় বলেছেন বিচারপতি টিএইচ খান।
তিনি বলেন, ওই স্বাক্ষরটাও গ্রহণযোগ্য না। বাকি চারজন যারা ছিলেন তাদের মধ্যে বর্তমান প্রধান বিচারপতি আলাদা রায় দিয়েছেন এবং বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা এবং বিচারপতি ইমান আলী আলাদা রায় দিয়েছেন।
‘উনারা ত্রয়োদশ সংশোধনীকে বৈধ আইন বলে উনাদের রায়ে উল্লেখ করেছেন। প্রশ্ন হলো ত্রয়োদশ সংশোধনী কে বাতিল করল?’
পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিচারপতি টিএইচ খান বলেন, ‘মজার বিষয় হলো পঞ্চদশ সংশোধনী যেদিন পাস হয়েছে, তার পরে কিন্তু রায় প্রকাশ হয়েছে। রায় প্রকাশের আগেই সরকার পঞ্চদশ সংশোধনী সংসদে পাস করেছে। অথচ সরকার বলেছে, এটা আদালত বাতিল করেছে আমরা করিনি।’
‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে চাইলে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে আরও শক্তিশালী করে সেখানে একটা নমিনাল বডি না করে সেখানে একটা ফাংশনাল বডি করে ক্ষমতা আরও বাড়ানো উচিত,’ উপস্থাপনায় বলেন টিএইচ খান।
এক প্রশ্নের জবাবে টিএইচ খানের পক্ষে তার ছেলে আফজাল এইচ খান বলেন, ‘‘৯৬ অনুচ্ছেদ নিয়ে যে এত বিতর্ক, সেখানে বলা হচ্ছে, ‘ইন ক্যাপাসিটি’ অথবা ‘গ্রস মিসকন্ডাক্ট’ এ দুটো বিষয় বলা আছে সংবিধানে। আমাদের কথা হলো এর বাইরেও অনেক বিচারপতিরা শত শত মামলার রায় না লিখে অবসরে চলে যান।’
‘এছাড়া আদালতে বসে অনেক রকম কটূক্তি করেন বা এমন এমন বক্তব্য রাখেন যেগুলো গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের ব্যক্তিগত আচার-আচরণও নিয়ন্ত্রণ করা উচিত,’ বলেন তিনি।
এফএইচ/এমএমএ/জেআইএম