গ্রামের পিছিয়ে পড়া গরীব ছাত্রছাত্রীদের বিনা বেতনে পড়ান তিনি। প্রতিমাসে এসব শিক্ষার্থীদের খাতা-কলমও কিনে দেন। প্রায় এক বছর যাবত ছুটির দিনে ১৮০ জন ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাদান করে আসছেন রাকিবুল আলম রানা। তিনি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার শ্রীপুর ইউনিয়নের ধর্মপুর পিএন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক।
গাইবান্ধা সদর উপজেলার গিদারী ইউনিয়নের দক্ষিণ গিদারী গ্রামে জন্মগ্রহণ করা এ শিক্ষক ২০১৬ সালে জেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবেও নির্বাচিত হয়েছেন। তার এ কাজে সহযোগিতা করছেন গাইবান্ধা সরকারি কলেজের সম্মান শেষ বর্ষের ছাত্র সেলিম মিয়া।
রাকিবুল আলম রানার পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, বাবা মরহুম আব্দুল ওয়াহাব মিয়া ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা আর মা রাবেয়া বেগম গৃহিণী। দুই ভাই ও ছয় বোনের মধ্যে রাকিবুল সবার ছোট। ভাই-বোনদের সবাই বিয়ে করেছেন। এক ভাই ফিরোজ আলম ঢাকায় একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন। আর সপ্তম বোন সেলিনা সুলতানা গিদারী দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকা।
গত শনিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) সকালে গাইবান্ধা জেলা শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলার গিদারী দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের ল্যাপটপের মাধ্যমে ইংরেজি শেখাচ্ছেন রাকিবুল আলম রানা। তার সঙ্গে গলা মিলিয়ে ইংরেজি উচ্চারণ রপ্ত করছে ছাত্র-ছাত্রীরা। পাশের কক্ষে গণিত শেখাচ্ছেন সেলিম মিয়া।
তার এ শিক্ষালয়ে গিদারী ইউনিয়নের গিদারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চরকেরহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পূর্বধুতিচোরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আনালের ছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ধুতিচোরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, গিদারী দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় ও পাশ্ববর্তী কামারজানি ইউনিয়নের কামারজানি মার্চেন্টস উচ্চ বিদ্যালয়ের চতুর্থ, পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির প্রায় ১৮০ জন ছাত্রছাত্রীকে গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে পড়ানো হয়।
পূর্বধুতিচোরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র মিজানুর রহমান বলে, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে সে খুব দুর্বল ছিলাম। স্যার খুব ভালোভাবে পড়ান। রানা স্যারের কাছে পড়ে খুব ভালো লাগছে। পড়া না বুঝলে তিনি ভালোভাবে বুঝিয়ে দেন। তার কাছে পড়ে খুব উপকার হচ্ছে।
গিদারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী রুপালী আক্তার বলে, চার ভাইবোনের মধ্যে আমরা তিনজন পড়াশুনা করি। এতে অনেক টাকা খরচ হয়। বাবার পক্ষে এত টাকা খরচ করা সম্ভব হয় না। স্যারের কাছে পড়ি কিন্তু স্যার কোনো টাকা নেন না। আবার ভালোভাবেও পড়ান।
ধুতিচোরা গ্রামের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক সোহরাব হোসেন। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, আমি কৃষি কাজ করে কোনো রকমে সংসার চালাই। আমার এক ছেলে অষ্টম ও এক মেয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। রানা স্যার খুব ভালোভাবে পড়ান। ছাত্রছাত্রীদের আবার খাতা-কলমও কিনে দেন তিনি।
স্থানীয় সমাজসেবক গোলাম আশিক যাদু বলেন, রানা স্যারের এই উদ্যোগ খুবই প্রশংসনীয়। তার কাছে বিনা বেতনে পড়ে গরীব ছাত্রছাত্রীদের উপকার হচ্ছে। তার পাশে সকলের দাঁড়ানো উচিত। এ রকম সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত থাকলে আমাদের ছেলেমেয়েরা দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত হবে এবং সমাজের উন্নয়নমূলক কাজে অংশগ্রহণ করতে পারবে।
গিদারী দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু বকর সিদ্দিক মুঠোফোনে জাগো নিউজকে বলেন, তার এই উদ্যোগ খুব ভালো। তাকে সব সময় উৎসাহ ও পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া তাকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করা হয়। রানা স্যারের কাছে পড়ে ছাত্রছাত্রীদের জন্য খুব উপকার হচ্ছে। আগের চেয়ে ফলাফল অনেক ভালো হচ্ছে।
গিদারী দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মো. হোসেন আলী মুঠোফোনে জাগো নিউজকে বলেন, তার এই ভালো উদ্যোগের কারণে আমাদের স্কুলের দুইটি শ্রেণিকক্ষে ক্লাস নিতে অনুমতি দেয়া হয়েছে। গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে যারা দুর্বল আশেপাশের কয়েকটি স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের ছুটির দিনগুলোতে শুধু তাদের ক্লাস চলে। এ জন্য কোনো ছাত্র-ছাত্রীর কাছ থেকে কোনো টাকা নেয়া হয় না।
এ বিষয়ে রাকিবুল আলম রানা বলেন, পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে পাস করতে না পারলে অনেক ছাত্রছাত্রী ঝরে পরে। তারা আর স্কুলমুখী হয় না। তারা যাতে স্কুল থেকে ঝরে পরে না যায় তাই গরীব ছাত্রছাত্রীদের বিনা বেতনে ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে পড়ানো হয়। আমি ভবিষ্যতে ওদের জন্য সকল বিষয়ের ক্লাস নিতে চাই। ঘর করার মত জায়গা আছে কিন্তু অবকাঠামো করার মত আর্থিক অবস্থা আমার নেই।
তিনি আরও বলেন, পিছিয়ে পড়া দরিদ্র ঘরের এসব ছাত্রছাত্রীরা প্রাইভেট পড়ার সুযোগ পায় না। স্কুলে ঠিকমত গণিত ও ইংরেজি বুঝতে পারে না বলে এই দুই বিষয়ে পরীক্ষার ফলাফল খুব ভালো হয় না। এর প্রভাব পড়ে হাইস্কুল ও কলেজে গিয়ে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পায় না। তাই শুধুমাত্র ছুটির দিনগুলোতে এসব ছাত্রছাত্রীদের গণিত ও ইংরেজি বিষয়ের ক্লাস নেয়া হয়।
রওশন আলম পাপুল/আরএস/আইআই