ক্যাম্পাস

বছরজুড়ে বেসামাল শাবি ছাত্রলীগ

এক বছর মেয়াদি কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে সাড়ে চার বছরে পদার্পণ করলেও কোনো পরিবর্তন না আসায় ক্ষমতার অপব্যবহারে বেসামাল হয়ে পড়েছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবি) শাখা ছাত্রলীগ। গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালেও পুরো বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল ছাত্রলীগের বিতর্কিত এই ইউনিট। বছরজুড়ে বিবাদমান গ্রুপগুলো আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রায়ই লিপ্ত হয়েছে সংঘর্ষে। ঘটেছে যৌন হয়রানি, চাঁদাবাজি, ফাও খাওয়া, ছিনতাই থেকে শুরু করে সাংবাদিক নির্যাতনের মতো ঘটনা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কমিটির মেয়াদ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হওয়ায় বাড়ছে এসব অপরাধমূলক কার্যক্রম। যদিও নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের জন্য গত ১০ অক্টোবর জীবনবৃত্তান্ত সংগ্রহ করে নিয়ে গেলেও এ পর্যন্ত কোনো আশার আলো দেখা যায়নি।

ক্যাম্পাস ও ছাত্রলীগ সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালের ৮ই মে সঞ্জীবন চক্রবর্তী পার্থকে সভাপতি ও ইমরান খানকে সাধারণ সম্পাদক করে এক বছর মেয়াদি ৭ সদস্যের একটি কমিটি অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। ২০১৬ সালের ৮ মে কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার এক বছর পর পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটিতে মামলার আসামি, ছাত্রদল-শিবির, অছাত্র, বিবাহিত ও বিতর্কিতরা স্থান পেলেও কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ঘেটে দেখা গেছে, মেয়াদোত্তীর্ণ এই কমিটির নেতাকর্মীরা গত সাড়ে চার বছরে ছোট-বড় মিলিয়ে অন্ততপক্ষে ৮০টি সংঘর্ষে জড়িয়েছে।

সংঘর্ষে বছর পার

২০১৭ সালের ৩১ জানুয়ারি দুটি বিভাগের ক্রিকেট টুর্নামেন্টের বিবাদকে নিজেদের গায়ে নিয়ে সংঘর্র্ষে জড়ায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মৃণ্ময় দাশ ঝুটনের নেতৃত্বে জুনিয়ররা। অন্তত ১০জন আহত হওয়া ছাড়াও ঘটনাটি নিয়ে শেষ পর্যন্ত তিনটি পাল্টাপাল্টি মামলাতে জড়ায় দুই গ্রুপ। ২৩ মে কথাকাটাকাটির জের ধরে দু গ্রুপের সংঘর্ষে অন্তত ২০ নেতাকর্মী আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে।

সাধারণ সম্পাদক ইমরান খান ও যুগ্ম সম্পাদক সাজিদুল ইসলাম সবুজের অনুসারীরা এ সংঘর্ষে জড়ায়। ২২ জুলাই সিগারেট খাওয়াকে কেন্দ্র করে আবারও সংঘর্ষে ইমরান ও সবুজের গ্রুপের চারজন আহত হয়। ১ আগস্ট রুম দখলকে কেন্দ্র করে গভীর রাতে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রুহুল আমিন ও যুগ্ম সম্পাদক সাজিদুল ইসলাম সবুজের কর্মীরা। এতে পাঁচজন আহত হন। এ ঘটনাতেও একাধিক মামলা দায়ের হয়।

বিতর্কিত ছাত্রলীগ নেতাকে হল থেকে বিতাড়ন

ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতি, চাঁদাবাজি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতর্কিত সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলামকে ২৩ মে হল থেকে বিতাড়িত করে কমিটির সিনিয়র নেতারা। তাছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি নিয়ে লেখালেখি করায় সহ-সভাপতি সৈয়দ জুয়েমকেও হল থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে তিনি সমঝোতার মাধ্যমে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন।

যৌন হয়রানি

জানুয়ারিতে পদার্থবিজ্ঞানের এক সিনিয়র শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ আসলেও ব্যপারটি ধামাচাপা দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও ছাত্রলীগ। এপ্রিলে এক স্কুলছাত্রী ক্যাম্পাসে ঘুরতে আসলে তাকে হয়রানি করে চার ছাত্রলীগ কর্মী। এ ঘটনার প্রতিবাদ করলে সভাপতি সঞ্জীবন চক্রবর্তী পার্থের নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকের ওপর হামলা করে তার অনুসারীরা। এ ঘটনায় শাবি ছাত্রলীগের কমিটি স্থগিত করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। পরবর্তীতে সহ-সভাপতি রুহুল আমিনকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করে ইউনিটটিতে পাঠানো হয়। সাংবাদিকের ওপর হামলার ঘটনায় মাহমুদুল হাসান রুদ্র, মো. সাজ্জাদ হোসেন রিয়াদ, রাহাত সিদ্দীকি, সুমন সরকার জনি নামে চার ছাত্রলীগ কর্মীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়।

জাতীয় দিবসগুলোতে বিভক্তি

২০১৭ সালের সবকটি জাতীয় দিবসেই আলাদা আলাদা গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পালন করেছে শাবি ছাত্রলীগ। সর্বশেষ ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের সামনেই আলাদা আলাদা স্লোগান, ব্যানার ও পুষ্পস্তবক অর্পণ করে ছাত্রলীগ। গত কয়েক বছরের সবগুলো জাতীয় দিবসেই শুধুমাত্র শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করে নিজেদের দায়িত্ব শেষ করেছে ছাত্রলীগের এই ইউনিট।

নেতৃত্ব ছাড়তে টালবাহানা

২৭ জুলাই সহ-সভাপতি রুহুল আমিনকে ১০ অক্টোবর কাউন্সিল করার দায়িত্ব দিয়ে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করে পাঠালেও নেতৃত্ব ছাড়তে টালবাহানা করছে ছাত্রলীগের সিনিয়র নেতাকর্মীরা। সম্মেলনের কোনো ধরনের প্রস্তুতি না নিলেও ঘটা করে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইনের ছবি সম্বলিত ব্যানারে সংবাদ সম্মেলন করে শিক্ষার্থীদের চলমান বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে ২০ দফা পেশ করা হয়। পরে ১০ অক্টোবর সম্মেলন না করে কর্মীসভা করেন তারা। কর্মীসভায় কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সামনেই নিজেদের সিনিয়র নেতাদের ব্যর্থতা তুলে ধরে হতাশা প্রকাশ করেন জুনিয়র নেতাকর্মীরা।

সাধারণ সম্পাদকের ছাত্রত্ব বাতিল

নীতিমালা অনুযায়ী কোর্স সম্পূর্ণ না করায় ১৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত একাডেমিক কাউন্সিলের ১৪৯তম সভায় শাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও পরিসংখ্যান বিভাগের ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ইমরান খানের ছাত্রত্ব বাতিল করা হয়। তাছাড়া একই শিক্ষাবর্ষের ও বিভাগের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান শিবলীর ছাত্রত্বও বাতিল করা হয়েছে। পরবর্তীতে সিন্ডিকেট সভার মাধ্যমে সিদ্ধান্তটি কার্যকর হয়।

জুনিয়র নেতাকর্মীদের হতাশা

মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়ে ছাত্রলীগের কার্যক্রম চলায় হতাশা প্রকাশ করেছেন জুনিয়র অনেক নেতা। তারা বলেন, এতো দীর্ঘ সময় কমিটি থাকায় জুনিয়রদের মধ্যে থেকে নেতৃত্ব উঠে আসছে না এবং অনেকেই ছাত্রলীগের প্রতি আস্থা হারাচ্ছে।

শাবি ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সৈয়দ জোয়েম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বর্তমান যে অবস্থা তাতে যে কোন সময় কোনো কিছু ঘটলে তার দায় কে নেবে?

কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে ক্যাম্পাস নিয়ে ভুল ধারণা দিচ্ছে বর্তমান নেতাকর্মীরা বলে দাবি করেন শাবি ছাত্রলীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন।

শাবি ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোহাম্মদ রুহুল আমিন বলেন, আমি নিজেও চাই এই ইউনিটটিতে নতুন নেতৃত্ব আসুক। পুরো সিদ্ধান্তটাই কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের উপর নির্ভর করছে।

আব্দুল্লাহ আল মনসুর/আরএআর/আইআই