কাজী কাদের নেওয়াজের কবিতা থেকে জানতে পারি, মৌলভী শিক্ষকের মাধ্যমে বাদশাহ আলমগীর সব শিক্ষককে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেয়ার কথা বলেছেন। নিজের ছেলের শিক্ষককে কুর্ণিশ করে কবির ভাষায় তিনি বলেছিলেন, ‘আজ হতে চির উন্নত হলো শিক্ষাগুরুর শির।’
শিক্ষাগুরু বললে এই কয়েকবছর আগেও যে সম্মানের চেহারাটা ভেসে উঠতো, যে ভয়মিশ্রিত শ্রদ্ধা জাগতো। সেটা এখন বিলুপ্তপ্রায়। প্রশ্ন উঠতে পারে শুধু শিক্ষকরা কেনো, সব জায়গার চিত্র কি একই নয়? সবজায়গায় অবক্ষয়, নৈতিকতা ধ্বংস প্রায়। কিন্তু কিছু কিছু পেশার মধ্যে শিক্ষকতা শুধু পেশা নয়। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে আমাদের আগামীর পথচলার নৈতিক শিক্ষা। একজন শিক্ষার্থীর মানুষের মতো মানুষ হওয়ার আদর্শের বীজ কিন্তু শিক্ষকই বুনে দিয়ে থাকেন। কাজেই শিক্ষকতা পেশার বাইরে মহান আদর্শকে ধারণ করে এগিয়ে চলা। তার সমাজের প্রতি তার দায়বদ্ধতাও সে কারণে বেশি।
আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকের পর সম্প্রতি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড একটি আদেশ জারি করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, যৌন হয়রানিসহ নারী ও শিশুর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে, প্রতিটি মাদ্রাসায় একজন নারী শিক্ষককে মেন্টর নিযুক্ত করে মাদ্রাসার ছাত্রীদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এবং পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া বাড়াতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে অন্তঃর্ভুক্ত জেন্ডার সম্পর্কিত বিষয়গুলো পর্যালোচনা, মাদ্রাসার ছেলেমেয়েদের প্রজনন স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সচেতনতা বাড়ানো এবং মেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা ও পরিচ্ছন্ন টয়লেটের ব্যবস্থা করতে হবে।
নারী নির্যাতন ও যৌন হয়রানি প্রতিরোধে যে সব আইন, নীতিমালা ও হাইকোর্টের যে নীতিমালা আছে তা প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। ফ্রি হেল্পলাইন-১০৯ সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের জানাতে হবে। আদেশটি নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু আমরা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যেটা বারবার দেখে আসছি কোনো একটি ঘটনার পর প্রশাসনের টনক নড়ে। কমিটি হয়। নানা কিছু হয়, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। তাই মনিটরিং ব্যবস্থা কতোটা জোরদার হবে তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। এই যেমন বাংলাদেশে লাখ লাখ মাদ্রাসা, কিন্তু এমন অনেক মাদ্রাসা রয়েছে যেখানে কোনো নারী শিক্ষকই নেই। তাহলে সেখানে নারী মেন্টর ব্যবস্থার কী হবে।
বাংলাদেশের মেয়েরা যে স্বকীয়ভাবে নিজেদের অবস্থান করে নিয়েছে এই চলার পথ কিন্তু মোটেও সহজ ছিল না। নানা প্রতিবন্ধকতা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে তারা এই অবস্থানে। কিন্তু তাদেরকে ‘মহলে’ থাকা ‘মহিলা’ বলতে যারা অধিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে তারা সহজেই সেটা মানতে রাজি নয়। বিশেষ করে মাদ্রাসায়তো নয়ই। তাই নারীরা ঘরে বাইরে আজ নিগৃহীত, বঞ্চিত, লাঞ্ছিত। মুক্তির অনাবিল আনন্দ তারা উপভোগ করতে পারছেন না। আনন্দের পরিবর্তে একধরনের আতঙ্কে তারা সংকুচিত ও সন্ত্রস্ত। বন্য শিকারির মতো তাদের তাড়া করছে ধর্ষকের দল। সম্প্রতি ফেনীর সোনাগাজীতে মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগে মামলা করার পর মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে মারা হয়। সারা দেশে ঘটনাটি আলোড়ন তুলে।
এই ঘটনার রেশ না কাটতেই চাঁদপুরে আরেক মাদ্রাসা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে শিক্ষিকাকে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠে। ক্লাস বর্জন করে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। প্রায় প্রতিদিনই এমন কোনো না কোনো ঘটনা সামনে এসে হাজির হচ্ছে। অথচ এক সময় নৈতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হতো মাদ্রাসাগুলো। আর শিক্ষকরা ধর্ম ও নৈতিকতার মূর্তরূপ। আর এখন সেখানে একের পর বেরিয়ে আসছে যৌন হয়রানির ঘটনা। তাহলে কি এতোদিন নীতিকথার আড়ালে, অঙ্গ ঢাকা পোশাকে নারীদের অবরুদ্ধ করে অবাধে যৌন সন্ত্রাস চলছিল মাদ্রাসাগুলোতে।
কাজেই শুধু মেন্টর এর কাজ বা মনিটরিং করে সমাধান সম্ভব নয়। প্রয়োজন কঠোর হওয়া। প্রয়োজন বিবেকের আলো জ্বেলে দেয়া। প্রশ্ন উঠতে পারে হঠাৎ করে মাদ্রাসায় এমন যৌন হয়রানির ঘটনা বাড়লো কেনো? প্রকৃতপক্ষে এসব ঘটনা আগেও ঘটতো। কিন্তু ছাত্রীরা সচেতন ছিলেন না, জনগণ সচেতন ছিল না বা লোকলজ্জার ভয়ে আপস মীমাংসা হয়ে যেতো বলে সেগুলো প্রকাশ্যে আসতো না। আগে এগুলো নৈতিক রক্ষণশীলতার বিষয় ছিল। এখন সেগুলো প্রকাশ্যে আসছে। অথচ যৌন হয়রানি রোধে উচ্চ আদালত সেই দশবছর আগেই নির্দেশনা দিয়েছিলেন। কিন্তু এখনো সেটি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি।
সম্প্রতি ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় আবারো আলোচনায় আসে সেই আদেশ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে যৌন হয়রানি ঠেকাতে ২০০৯ সালে নীতিমালা করে দিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্ট। নীতিমালার বাস্তবায়ন নিয়ে ২০১৮ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা সর্বোচ্চ আদালত করে দিলেও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৮৭ শতাংশ শিক্ষার্থীই সেটি সম্পর্কে জানেন না। আন্তর্জাতিক সংস্থা অ্যাকশন এইডের উদ্যোগে ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধঃ সুপ্রিম কোর্টের ২০০৯ সালের নির্দেশনার প্রয়োগ ও কার্যকারিতা’ শিরোনামে গবেষণাটি করা হয়।
এবার অবশ্য আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে নারী মেন্টর রাখা ও মনিটরিং এর বিষয়টি সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে অন্তঃর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। প্রথমে মাদ্রাসা দিয়েই শুরু হলো। তবে এ বিষয়ে কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদের একটা লেখা থেকে উদ্বৃত করছি। কুমিল্লার সমবায় পদ্ধতির উদ্ভাবক আখতার হামিদ খান একবার সন্তোষে গিয়েছিলেন মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। মাওলানা তাঁর প্রস্তাবিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা বর্ণনা করে তাঁকে বলেন, কাজ শুরু করার জন্য আমি প্রফেসর মীর ফখরুজ্জামানকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছি। ভাসানীর কথা শুনে আখতার হামিদ বলেন, ‘কমিটি দিয়ে কাজ হয় না, মানুষ দিয়ে কাজ হয়।’ নারী মেন্টর বা মনিটিরিং সেল বা যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি যেন শুধু কমিটিই না হয় সেদিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে।
একজন শিক্ষকের কাছে তার ছাত্রীরা সবচেয়ে নিরাপদ থাকার কথা ছিল। কিন্তু এখন কেনো জানি সব উল্টো। পিতৃতুল্য শিক্ষকরা এখন ধর্ষকের ভূমিকায়। কেনো এই পরিবর্তন সেটা খুঁজে বের করাটাও জরুরি। শুধু নৈতিক অবক্ষয় বলে গলা ফাটিয়ে আখেরে কোনো কাজে আসবে না। গবেষণার পাশাপাশি দরকার প্রয়োগও।
এক সময় শিক্ষার্থীর বিপদে এগিয়ে আসতেন শিক্ষক। সেখান থেকেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন আদর্শ শিক্ষক। যাদের কথা এখনো বিখ্যাতদের স্মৃতিচারণে উঠে আসে। আর এখন একজন শিক্ষকের কাছে শিক্ষার্থী হয়রানির শিকার হচ্ছেন। সেই চিত্রটা কীভাবে বদলে গেলো? এই নৈতিক অবনতির জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে কোনো গলদ আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা উচিত। আইন নীতির কঠোর বাস্তবায়ন এবং অপরাধীর এমন শাস্তি হওয়া উচিত যাতে অন্যরা ভয় পায়। কারণ জানতে হবে, এই সমাজে ধর্ষণের শাস্তি কঠোর।
সেই সচেতনতা এমনভাবে প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে দিতে হবে যাতে সেটার গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। না হলে নারী মেন্টর বা মনিটরিং অতোটা কাজে আসবে না যতোটা না প্রয়োগিক শিক্ষা বা আইনের কঠোর প্রয়োগ কাজে আসবে। আমরা যদি সামাজিক অবক্ষয়ের কথা বলি তবে মাদ্রাসাগুলোতো সমাজেরই অঙ্গ। কাজেই সেই অঙ্গে যদি রোগ বাসা বাঁধে সেটিতো সমাজের ওপরই প্রভাব পড়বে। সে কারণে মনিটরিং ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দিয়েই এগুতে হবে। আর আদেশে ছাত্রীদের সঙ্গে শিক্ষকের যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা বলা হয়েছে সেই বন্ধুত্ব যেন নির্ভরশীলতার প্রতীক হয়। বন্ধু মানে যেন লাম্প্যটের অনুমতি না হয়। সেদিকেও নজর রাখতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক। shantanu.reporter@gmail.com
এইচআর/জেআইএম