মতামত

সাপকে দুধকলা দিলে পোষ মানবে কি?

প্রায় এক দশককাল লুকিয়ে লুকিয়ে রাজনীতি করার পর প্রকাশ্যে এসেছে যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতে ইসলামী। প্রাসঙ্গিকভাবে প্রশ্ন এসেছে, জামায়াতে ইসলামীর মতো চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী সংগঠন কীভাবে সমাবেশ করার অনুমতি পায়। রাজনৈতিক বিতর্কের খাতিরে যদি বলা হয়- নির্বাচন সামনে রেখে সরকারের উদারতা প্রদর্শনই এই সমাবেশের অনুমতির কারণ, তাহলেও কি এই সমাবেশের অধিকারকে স্বাভাবিক বলে মনে করা যায়?

এই সমাবেশ থেকে তাদের বক্তারা যেসব বক্তব্য উপস্থাপন করেছে, তাকে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতা হিসেবে মনে করা যায়। এর প্রমাণ ইউটিউবে বক্তৃতাগুলো। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদগুলোকেও যদি ভিত্তি ধরা হয়, তাহলেও দেখা যাবে তারা কীভাবে যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি চেয়েছে। ইউটিউবে প্রচারিত বক্তৃতাগুলো প্রচারিত সংবাদের মতো সংক্ষিপ্ত কিংবা সম্পাদিত না হওয়ায় বিস্তারিত সেখানে দেখা ও শোনা যায়।

ফাঁসিতে ঝুলে মৃত্যুবরণকারীদের বিষয়ে তারা তেমন কিছু না বললেও যুদ্ধাপরাধের দায়ে শাস্তিপ্রাপ্তদের মুক্তি দাবি করে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের প্রতি তারা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, এই যুদ্ধাপরাধী দলকে সমাবেশ করার সুযোগ না দিলে কি গণতন্ত্র প্রশ্নবিদ্ধ হতো? যদি প্রশ্নবিদ্ধই হয় তাহলে আইনানুগভাবে তাদের এই পর্যন্ত কেন যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হলো না।

তারা তাদের বক্তব্যে স্পষ্ট বলেছে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে তাদের নিবন্ধন বাতিল হয়নি। নির্বাচন কমিশন জোর করে তাদের নিবন্ধন বাতিল বলে ঘোষণা করেছে। এক্ষেত্রে তাদের যুক্তি হচ্ছে-নিবন্ধন বাতিলের বিষয়টি এখনও আদালতে অমীমাংসিত।

এই দলটি নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে বর্তমান সরকারের অনিচ্ছা আছে এমন বলা যায় না। কারণ সরকারের সিনিয়র নেতাদের মুখ থেকে এ পর্যন্ত বহুবার বলা হয়েছে, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার আইন প্রণয়নের কাজ চলছে। যতটা মনে আসে যুদ্ধাপরাধী আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছিল শুধু ব্যক্তি নয় তাদের দলও যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। আর তেমন দলটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ২০১৩ থেকে এই পর্যন্ত ১০ বছরেও কোনো কারণে আইন প্রণয়ন সম্ভব হয়নি, এটা সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে বলা হয়নি। সর্বশেষ ১১ জুন যখন আইনমন্ত্রী একই কথা বলেন, তখন বিশ্বাসের মাত্রাটাই প্রশ্নবোধক হয়ে পড়ে।

বিবিসি বাংলায় ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ তারিখে প্রকাশিত হয় তৎকালীন আইন প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন জামায়াত নিষিদ্ধ করা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। জাতীয় সংসদে শিগগির সিদ্ধান্ত হতে পারে। বর্তমান আইনমন্ত্রী ২০১৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর বলেছিলেন জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া চলছে। (রাইজিং বিডি) ২০১৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি জাগো নিউজে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী-মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ২০১৪ সালে সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে আন্তর্জাতিক অপারাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। একই বছরের ২৫ মার্চ তদন্ত প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনে দাখিল করা হয়। সেই তদন্ত প্রতিবেদনে জামায়াতের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সাত ধরনের অভিযোগ তুলে ধরা হয়। একইসঙ্গে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার সুপারিশও করা হয় ওই তদন্ত প্রতিবেদনে। (জাগো নিউজ, ২৫ ফেব্রুয়ারি,২০১৯)

বর্তমান আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দিয়েছিলেন, আইনেই এই সংশোধনীর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে দ্রুত উদ্যোগ নেবেন এবং জামায়াত নিষিদ্ধ করার বিষয়টি তার এ মেয়াদে প্রাধান্য পাবে। (সমকাল ১৯ ডিসেম্বর ২০১৯)

আদালতের রায়ে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের পর জামায়াত আপিল করেছে, যা বিচারাধীন। সেই উছিলায় তাদের নিষিদ্ধকরণ থেমে থাকার যৌক্তিক কারণ আছে বলে মনে করি না। যেহেতু একাত্তরে গণহত্যাকারী হিসেবে দলটির বিরুদ্ধে প্রামাণ্য দলিল রয়েছে, যেহেতু তাদের দলীয় গঠনতন্ত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ তথা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সহজেই তাদের নিষিদ্ধ করা সম্ভব। এমন মন্তব্য শাহরিয়ার কবির থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিভিন্ন বুদ্ধিজীবীর। এমতাবস্থায় জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার নির্দেশনাটি দশ বছরেও কেন দেওয়া হচ্ছে না তা বোধগম্য নয়।

বলা হয়ে থাকে, জামায়াত নিষিদ্ধ হলে নেতারা বিএনপিতে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা আছে। যখন কোনো সংগঠন নিষিদ্ধ হবে তখন কি শুধু সাইনবোর্ডই নিষিদ্ধ হবে? তার সঙ্গে জড়িত সব নেতাকর্মীর রাজনীতি করার অধিকারও নিষিদ্ধ হবে। সেক্ষেত্রে ওই দলের কোনো নেতাকর্মী কি নিজেরা নতুনভাবে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পাবে? কিংবা আইনানুগ অন্য কোনো দলে গিয়ে ভিড়তে পারবে? আমরা নাৎসীদের বিরুদ্ধে দুনিয়াব্যাপী গৃহীত ব্যবস্থা দেখি। তাদের দল নাম এমনকি প্রতীকও নিষিদ্ধ। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ায় তাদের প্রতীক ব্যবহারের শাস্তি প্রদানের আইন করা হয়েছে। পৃথিবীর কোথাও কি দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পর তাদের রাজনৈতিক অধিকার অক্ষুণ্ণ থাকে এমন উদাহরণ নেই। বাংলাদেশ কি ওইসব দেশ থেকে আলাদা কিছু?

জামায়াতে ইসলামীর উপজেলা পর্যায় থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় পর্যন্ত সব শাখা তাদের অঙ্গসংগঠন তাদের প্রকাশনা ও প্রকাশকদের নাম কি সরকারের কাছে নেই? না থাকলেও সেগুলো জোগাড় করা কি খুব বেশি কষ্টসাধ্য? যদি সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদেরও নিষিদ্ধ করা হয় তাহলে অন্য দলে গিয়ে বর্তমান সরকারি দলের প্রতিপক্ষকে শক্তিশালী করার সুযোগ কি থাকবে?

গুঞ্জন আছে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতির প্রেসক্রিপশনে জামায়াতকে এই ছাড় দেওয়া হয়েছে। যদি এটা সত্য হয় তাহলে বলতে হবে, জামায়াত যে সন্ত্রাসী দল সেটা বোঝানোর জন্য সরকারিভাবে তেমন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কিংবা নেওয়া হলেও তা জোরালো ছিল না। যতটা জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক সিনেটর একসময় জামায়াতের সন্ত্রাসী কার্যক্রম সম্পর্কে উদ্বেগও প্রকাশ করেছিলেন।

সন্ত্রাস ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত দলটির বিরুদ্ধে এত বছরেও কোনো কারণে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি তা বোঝা মুশকিল। যদি এমন রাজনৈতিক সমীকরণ করা হয়- ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন ও জামায়াতকে আগামী নির্বাচনে রেখে বিএনপিকে চাপে রাখা হবে তাও কি ঠিক হবে? যদি এমন হয় তাহলে বিএনপির যতটা না ক্ষতি হবে তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হবে বাংলাদেশের।

ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রধান শাহরিয়ার কবির এ বিষয়ে প্রয়াত আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে উদ্ধৃত করে মন্তব্য করেছেন- ‘এটি হলে আওয়ামী লীগ আর আওয়ামী লীগ থাকবে না। মুসলিম লীগ হয়ে যাবে। এমন কথা প্রয়াত আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীও বহু আগে বলেছেন। এর জন্য মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতি যুদ্ধ করেনি, ৩০ লাখ শহীদ রক্ত দেয়নি, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ স্বাধীন করেননি।’ (সমকাল ১২ জুন, ২০২৩)।

যদি নির্বাচনী কৌশল হিসেবে জামায়াতকে ছাড় দেওয়া হয় তাহলে হয়তো সাময়িক সুবিধা পাওয়াও যেতে পারে। যেমনি হেফাজতকে ছাড় দিয়ে সাময়িক সুবিধা হিসেবে শান্তিপূর্ণ সময় পার করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। কিন্তু তাদের ছাড় দেওয়ার কারণে দেশের ভবিষ্যৎ যে অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তা খতিয়ে দেখলে স্পষ্ট হয়ে যাবে।

দুধকলা দিয়ে সাপ পোষার মতোই হতে পারে এর পরিণতি। যদিও আওয়ামী লীগের মন্ত্রী পর্যায়ের কয়েকজন নীতি বদলায়নি বলে আশ্বস্ত করেছেন, বলেছেন অপেক্ষা করতে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ সেই অপেক্ষায়ই আছে। আর অপেক্ষার শেষ হবে যুদ্ধাপরাধী জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা এবং সংগঠন হিসেবে তাদের নিষিদ্ধ ঘোষণার।

লেখক: সাংবাদিক, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, সাহিত্যিক।

এইচআর/ফারুক/এএসএম