সুরা কলম কোরআনের ৬৮তম সুরা, এর আয়াত সংখ্যা ৫২ এবং রুকু সংখ্যা ২। সুরা কলম মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে। ইবনে আব্বাসের (রা.) মতে নাজিল হওয়ার দিক থেকে এটি দ্বিতীয় সুরা, সুরা আলাকের পরই সুরাটি নাজিল হয়। সুরাটির বিষয়বস্তু থেকেও বোঝা যায় যে, এ সুরাটি যে সময় নাযিল হয়েছিলো, তখন মক্কা নগরীতে আল্লাহর রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের) বিরোধিতা বেশ তীব্র হয়ে উঠেছিলো। তাকে বিভিন্ন অপবাদ দেওয়া হচ্ছিলো।
সুরা কলমের আলোচ্যবিষয় নবিজির (সা.) নবুয়ত, তার উন্নত চরিত্র, মক্কার কিছু কাফেরদের মন্দ চরিত্র, রাসুলের (সা.) প্রতি অপবাদ, আখেরাতে মুমিন ও কাফেরদের পরিণতি ইত্যাদি।
সুরা কলমের ১৭-৩৪ আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন,
(১৭)إِنَّا بَلَوْنَاهُمْ كَمَا بَلَوْنَا أَصْحَابَ الْجَنَّةِ إِذْ أَقْسَمُوا لَيَصْرِمُنَّهَا مُصْبِحِينَইন্না বালাওনাহুম কামা বালাওনা আসাহাবাল জান্নাতি ইয আকছামূ লাইয়াসরিমুন্নাহা মুসবিহীন।আমি তাদেরকে (অর্থাৎ মক্কাবাসীকে) পরীক্ষায় ফেলেছি, যেমন পরীক্ষায় ফেলেছিলাম এক বাগানের মালিকদেরকে; যখন তারা শপথ করেছিল, ভোর হওয়া মাত্র আমরা বাগানের ফসল কাটব।
(১৮)
وَلا يَسْتَثْنُونَ
ওয়ালা-ইয়াছতাছনূন।এবং তারা কোন ব্যতিক্রম রাখেনি। (ইনশাআল্লাহ বলেনি)
(১৯)فَطَافَ عَلَيْهَا طَائِفٌ مِنْ رَبِّكَ وَهُمْ نَائِمُونَফাতাফা আলাইহা তাইফুম মিররাব্বিকা ওয়া হুম নাইমূন।তারপর তারা যখন ঘুমিয়ে ছিল, তোমার রবের পক্ষ থেকে এক বিপর্যয় সেই বাগানে হানা দিল,
(২০)
فَأَصْبَحَتْ كَالصَّرِيمِফাআসবাহাত কাসসারীম।ফলে সকালে তা হয়ে গেল এক কালো নিষ্ফলা জমির মতো।
(২১)فَتَنَادَوْا مُصْبِحِينَফাতানাদাও মুসবিহীন।সকালে তারা একে অপরকে ডেকে বলল,
(২২)أَنِ اغْدُوا عَلَى حَرْثِكُمْ إِنْ كُنْتُمْ صَارِمِينَ
আনিগদূ আলা হারসিকুম ইন কুনতুম সারিমীন।তোমরা ফল কাটতে চাইলে ভোর বেলায়ই বাগানে চল।
(২৩)فَانْطَلَقُوا وَهُمْ يَتَخَافَتُونَফানতালাকূওয়া হুম ইয়াতাখাফাতূন।তারা চলল ফিসফিস করে বলতে বলতে,
(২৪)أَنْ لا يَدْخُلَنَّهَا الْيَوْمَ عَلَيْكُمْ مِسْكِينٌ
আল্লা ইয়াদখুলান্নাহাল ইয়াওমা আলাইকুম মিছকীন।আজ যেন কোন মিসকিন তোমাদের কাছে এ বাগানে ঢুকতে না পারে।
(২৫)وَغَدَوْا عَلَى حَرْدٍ قَادِرِينَ
ওয়া গাদাও আলা হারদিন কাদিরীন।এবং তারা এই সিদ্ধান্তে সংকল্পবদ্ধ হয়ে সতেজে পথ চললো।
(২৬)فَلَمَّا رَأَوْهَا قَالُوا إِنَّا لَضَالُّونَ
ফালাম্মা রআওহা কালূ ইন্না লাদাললূন।তারা যখন বাগানের অবস্থা দেখল, বলে উঠল, আমরা নিশ্চয়ই রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি।
(২৭)بَلْ نَحْنُ مَحْرُومُونَ
বাল নাহনূ মাহরূমূন।(কিছুক্ষণ পর বলল) না, বরং আমরা তো হৃতসর্বস্ব।
(২৮)قَالَ أَوْسَطُهُمْ أَلَمْ أَقُلْ لَكُمْ لَوْلا تُسَبِّحُونَ
কালা আওছাতুহুম আলাম আকুল্লাকুম লাওলা তুসাব্বিহূনতাদের মধ্যে যে সবচেয়ে ভালো ছিল, সে বলল, আমি কি তোমাদের বলিনি যে, তোমরা তাসবিহ পড়ছ না কেন?
(২৯)قَالُوا سُبْحَانَ رَبِّنَا إِنَّا كُنَّا ظَالِمِينَকালূ সুবহানা রাব্বিনা ইন্না কুন্না জালিমীন।তখন তারা বলল, আমরা আমাদের রবের পবিত্রতা ঘোষণা করছি। নিশ্চয়ই আমরা জালেম ছিলাম।
(৩০)فَأَقْبَلَ بَعْضُهُمْ عَلَى بَعْضٍ يَتَلاوَمُونَফাআকবালা বা‘দুহুম আলা বা‘দিইঁ ইয়াতালাওয়ামূন।তারা পরস্পরকে দোষারোপ করতে লাগল।
(৩১)قَالُوا يَا وَيْلَنَا إِنَّا كُنَّا طَاغِينَকালূ ইয়া ওয়াইলানা ইন্না কুন্না তাগীন।তারপর সবাই (একযোগে) বলল, হায় আফসোস! নিশ্চয়ই আমরা অবাধ্য হয়ে গিয়েছিলাম।
(৩২)عَسَى رَبُّنَا أَنْ يُبْدِلَنَا خَيْراً مِنْهَا إِنَّا إِلَى رَبِّنَا رَاغِبُونَআসা রাব্বুনা আইঁ ইউবদিলানা খাইরাম মিনহা ইন্না ইলা রাব্বিনা রাগিবূন।সম্ভবত আমাদের রব আমাদেরকে এর চেয়েও উৎকৃষ্টতর বিনিময় দেবেন। অবশ্যই আমরা আমাদের রবের প্রতি আগ্রহী।
(৩৩)كَذَلِكَ الْعَذَابُ وَلَعَذَابُ الْآخِرَةِ أَكْبَرُ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَকাযালিকাল আযাবু ওয়ালা আযাবুল আখিরাতি আকবারু লাও কা-নূ ইয়া‘লামূন।শাস্তি এভাবেই আসে এবং পরকালের শাস্তি আরও কঠিন; যদি তারা জানত!
এ আয়াতগুলো থেকে যে শিক্ষা ও নির্দেশনা আমরা পাই:
১. দুনিয়াতে আল্লাহ মানুষকে ভালো ও মন্দ অবস্থায় রেখে পরীক্ষা করেন। যারা ভালো অবস্থায় থাকলে আল্লাহর শোকর আদায় করে, মন্দ অবস্থায় পড়লে আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্যের ওপর থেকে ধৈর্য ধারণ করে, তারাই সফল ও সৌভাগ্যবান।
২. কোনো কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময়, সংকল্প করার সময় তা আল্লাহর ইচ্ছার দিকে সম্পৃক্ত করে ‘ইনশাআল্লাহ’ বলা জরুরি। মনে এই বিশ্বাস থাকা জরুরি যে আল্লাহ তওফিক দিলে ওই কাজটি আমরা করতে পারবো, তিনি তওফিক না দিলে পারবো না।
৩. নতুন ফল-ফসল কাটলে তা থেকে একটা অংশ অভাবী ও দরিদ্রদের দান করা উচিত। মুমিনদের বৈশিষ্ট্য হলো নিজেদের সব রকম নেয়ামতে দরিদ্রদের শরিক করা। সুরা মাআরিজে মুমিনদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَالَّذِينَ فِي أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ مَّعْلُومٌ لِّلسَّائِلِ وَالْمَحْرُومِআর যাদের ধন-সম্পদে রয়েছে ভিক্ষুক ও বঞ্চিতদের নির্ধারিত হক। (সুরা মাআরিজ: ২৪, ২৫)
৪. দুনিয়ায় বিপদ-আপদে পড়লে ধৈর্য ধারণ করে আল্লাহর পক্ষ থেকে উত্তম বিনিময় লাভের আশা করা, আল্লাহর রহমতের ব্যাপারে আশাবাদী থাকা মুমিনদের বৈশিষ্ট্য।
৫. দুনিয়ায় মানুষ যেসব বিপদ-আপদের মুখোমুখি হয়, আখেরাতের শাস্তির তুলনায় তা তুচ্ছ। দুনিয়ায় শাস্তির মুখে পড়ে যারা নিজেদের সংশোধন করবে, তারা বেঁচে যাবে। পাপাচারের পথে থেকেই যারা দুনিয়া থেকে বিদায় নেবে, তাদের জন্য আখেরাতের কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করছে।
ওএফএফ/এমএস