দেশজুড়ে

আড়াই মাসে ধান সংগ্রহ হয়নি এক ছটাকও

চলতি আমন মৌসুমের আড়াই মাসেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে। অথচ কুমিল্লার ১৭ উপজেলার ১৪ খাদ্যগুদামে এক ছটাক ধানও সংগ্রহ করতে পারেনি জেলা খাদ্য বিভাগ। ধান সংগ্রহের আরও প্রায় এক মাস সময় হাতে থাকলেও লক্ষ্যমাত্রা পূরণ তো দূরের কথা, আংশিক পূরণ নিয়েও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

ধান-চাল সংগ্রহের সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, এবারের ভয়াবহ বন্যায় কুমিল্লায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এজন্য কৃষকরা আমনের কাঙ্ক্ষিত ফলন ঘরে তুলতে পারেননি। অন্যদিকে সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে খোলাবাজারে ধানের দাম বেশি। এজন্য সরকারের কাছে ধান বিক্রিতে অনীহা দেখা দিয়েছে কৃষকদের। যে কারণে এখনো কুমিল্লায় ধান সংগ্রহ শূন্যের কোঠায়।

সূত্রমতে, চলতি মৌসুমে জেলায় সরকারিভাবে দুই হাজার ৮৩৪ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। গত বছরের ১৭ নভেম্বর থেকে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়। চলবে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। তবে এখন পর্যন্ত এক ছটাক ধানও সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।

আরও পড়ুন:

তীব্র পানি সংকটে বরেন্দ্র অঞ্চলে কমবে ধান চাষ

একই সময়ের মধ্যে ১২ হাজার ৩৬ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। সে অনুসারে কুমিল্লার ৮৪টি মিলের মধ্যে ৬৫টি মিলের সঙ্গে ১০ হাজার ৭৩৭ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহের জন্য চুক্তি করে জেলা খাদ্য বিভাগ। বৃহস্পতিবার (৬ ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত সরকারি গুদামে চাল জমা হয়েছে মাত্র আট হাজার ৩৬ মেট্রিক টন। তবে ধান সংগ্রহ না হলেও চালের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে বলে আশাবাদী খাদ্য বিভাগ।

রাইস মিলমালিকরা বলছেন, ২০২৪ সালের আগস্টে কুমিল্লাসহ সারাদেশে ভয়াবহ বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ফলে কৃষকরা ধান উৎপাদনে ব্যাপক ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছেন। যে কারণে বাজারে ধান সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে বাধ্য হয়ে বেশি মূল্যে ধান সংগ্রহ করতে হচ্ছে তাদের।

মিলমালিকদের ভাষ্য, সংগৃহীত ধান থেকে গাড়িভাড়া, শ্রমিক খরচ, বিদ্যুৎ বিলসহ প্রতিকেজি চাল উৎপাদনে খরচ হচ্ছে সরকার নির্ধারিত মূল্য থেকে পাঁচ টাকা বেশি। এরপরও বাধ্য হয়ে লোকসান দিয়ে সরকারি গুদামে চাল দিতে হচ্ছে আমাদের।

আরও পড়ুন:

বিনা চাষে সরিষার নতুন সম্ভাবনা, বাড়বে উৎপাদন

কুমিল্লা জেলা রাইস মিল সমিতির সভাপতি আবু ইউসুফ বাচ্চু জাগো নিউজকে বলেন, ‘ধান সংকটে কুমিল্লায় অনেক মিল বন্ধ হয়ে গেছে। মিলারদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহের জন্য সরকার যে দাম নির্ধারণ করেছে, এটি উৎপাদন খরচের সঙ্গে মেলে না। আমাদের এককেজি চাল উৎপাদনে খরচ পড়ছে ৫২ টাকা। কিন্তু সরকার দাম নির্ধারণ করেছে ৪৭ টাকা। এই দামে গুদামে চাল দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তারপরও জামানত ফেরতের আশায় চাল দিতে হচ্ছে মিলমালিকদের।’

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ সূত্র জানায়, এ বছর জেলায় আমন ধান আবাদ করা জমির পরিমাণ ছিল এক লাখ ৩৫ হাজার ২৩৮ হেক্টর। বন্যার কারণে ৪৯ হাজার ৬০৮ হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলায় চার লাখ ৩৫ হাজার ৬৯৪ জন কৃষক রয়েছেন। বন্যা-পরবর্তী সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মাঝে প্রণোদনা হিসেবে ধানবীজ, ধানের চারা এবং সার দেওয়া হয়। এবার কুমিল্লায় আমন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় তিন লাখ ৪১ হাজার ৯৫৭ মেট্রিক টন। কিন্তু অর্জিত হয়েছে মাত্র এক লাখ ৮৮ হাজার ৭৫০ মেট্রিক টন ধান।

নাঙ্গলকোট উপজেলার কৃষক সালেহ আহমদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘সরকারি গুদামে ধান বিক্রি করলে টাকা পেতে সময় লাগে। তাছাড়া প্রতিমণ ধানের দাম ধরা হয় বাজারমূল্য অনুসারে দেড় থেকে দুইশ টাকা কমে। এ কারণে কৃষরা সরকারি গুদামে ধান দিতে চান না। এটাই বাস্তবতা। সরকারের উচিত বাজারমূল্যের সঙ্গে মিল রেখে ধানের দাম নির্ধারণ করা। তা হলে গুদামে দানের অভাব হবে না।’

আরও পড়ুন:

সেচের অভাবে মাস পেরোলেও রোপণ হয়নি বোরোর চারা

মুরাদনগরের কৃষক আবদুল জলিল বলেন, ‘সরকারিভাবে ধান সংগ্রহের সময় আর্দ্রতা ১৪ শতাংশের নিচে থাকার বাধ্যবাধকতা করে দেওয়া হয়েছে। এই বাধ্যবাধকতা হাটবাজার বা আড়তে মানা হয় না। ব্যাপারীদের খবর দিলে বাড়ি থেকে ওজন করে নগদ টাকা দিয়ে ধান নিয়ে যায়। বাজারে নিলেও তাৎক্ষণিক টাকা পাওয়া যায়। সরকারি খাদ্যগুদামে ধান বিক্রি করতে গেলে নানা ধরনের ঝামেলা পোহাতে হয়। তাই আমরা স্থানীয় ব্যাপারীদের কাছে বিক্রি করি।’

চৌদ্দগ্রামের বাতিসা সোনাপুর গ্রামের কৃষক আবদুর রশিদ বলেন, ‘এবারের বন্যায় সব শেষ হয়ে গেছে। যা কয়টা ধান পাইছি নিজের খোরাকিও হবে না। সরকারের কাছে কীভাবে বিক্রি করবো? এক-দুমাস পর উল্টো বাজার থেকে আমাদের চাউল কিনে খেতে হবে।’

সরকার নির্ধারিত ধান সংগ্রহের কোনো সম্ভাবনা নেই বলে জানান কুমিল্লা জেলার ভারপ্রাপ্ত খাদ্য নিয়ন্ত্রক নিত্যানন্দ কুন্ডু।

এর কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, সরকার এ মৌসুমে প্রতিকেজি ধানের দাম নির্ধারণ করেছে ৩৩ টাকা। কিন্তু খোলাবাজারে প্রতিকেজি ধান বিক্রি হচ্ছে সরকার নির্ধারিত মূল্যের দু-তিন টাকা বেশি দরে। যে কারণে কৃষকরা সরকারের কাছে ধান বিক্রি না করে স্থানীয় হাটবাজারে বিক্রি করছেন। এবারের বন্যায় কুমিল্লায় ধান উৎপাদনে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এসব কারণে সরকার নির্ধারিত ধান সংগ্রহের কোনো সম্ভাবনা নেই।

জেডআইপি/এসআর/এমএস