মাওলানা ওয়াহিদুদ্দিন খান (রহ.)
Advertisement
একবার সাহাবায়ে কেরাম আল্লাহর রসুলকে (স.) জিজ্ঞাসা করেন, হে আল্লাহর রসুল, এই কোরবানি আসলে কী?
উত্তরে তিনি বলেন, এটা তোমাদের বাবা হজরত ইবরাহিমের (আ.) সুন্নত। (মুসনাদে আহমদ, সুনানে ইবনে মাজা)
এই হাদিসের আলোকে আমরা বুঝতে পারি—কোরবানির ঈদের প্রকৃত তাৎপর্য হলো, হজরত ইবরাহিমের (আ.) আত্মত্যাগের অনুকরণে প্রতীকী এক কাজের মাধ্যমে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর সন্তুষ্টিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার অঙ্গীকার।
Advertisement
ঈদুল আজহা প্রতি বছর জিলহজ মাসের নির্দিষ্ট দিনে পালন করা হয়। এটি হজ নামক বৈশ্বিক ইবাদতের একটি অংশ। পুরো হজ অনুষ্ঠান মূলত হজরত ইবরাহিমের (আ.) জীবনব্যাপী আত্মনিবেদন ও ত্যাগের প্রতীকী পুনর্নির্মাণ—একটি symbolic performance। আর কোরবানি হলো তারই অংশবিশেষ, যা সারা পৃথিবীর মুসলমান নিজ নিজ স্থানে পালন করে।
হযরত ইবরাহিমের (আ.) জীবন ছিল দাওয়াতি দায়িত্বে নিবেদিত। আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত দিতে গিয়ে তাকে জন্মভূমি ছাড়তে হয়েছিল। ফিলিস্তিনে তিনি দ্বীন প্রচার করেছেন, মক্কায় দ্বীন প্রচার করেছেন। নিজের পরিবার-পরিজনকেও তিনি দাওয়াতি মিশনে সম্পৃক্ত করেছেন। তিনি কাবা শরিফ নির্মাণ করেছেন, তাকে দ্বীনি দাওয়াতের কেন্দ্র বানিয়েছেন এবং তার তাওয়াফ করেছেন। তিনি হজের নিয়ম পালনের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছেন, তার পরিশ্রম একমাত্র আল্লাহর জন্য। তিনি কোরবানি করে এই অঙ্গীকার করেছিলেন—জীবন হবে আল্লাহর পথে। তিনি ইহরামের সাদা পোশাক পরিধান করে জানিয়ে দিয়েছিলেন—জীবন হবে সরল ও পবিত্র। শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করে ঘোষণা করেছিলেন—তিনি শয়তানের ধোঁকা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর।
এই ইবরাহিমি আদর্শই প্রতি বছর ঈদুল আজহায় মুসলমানরা স্মরণ করে ও তা নিজেদের জীবনে বাস্তবায়নের প্রতিজ্ঞা করে। এই ঈদ একটি ঘোষণা—আমি হজরত ইবরাহিমের (আ.) পথকেই নিজের জীবনের পথ হিসেবে গ্রহণ করি ও মানি। এর আলোকে প্রত্যেক মুসলমানের নিজেকে মূল্যায়ন করা উচিত—সে ঈদের দিনটি যথাযথভাবে পালন করেছে কি না।
ঈদের দিন মুসলমানরা আত্মীয়-স্বজন ও আশপাশের মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। এই সাক্ষাৎ একটি বার্তা—আমি হজরত ইবরাহিমের (আ.) মতোই নিজের চারপাশে আল্লাহর বাণী ছড়িয়ে দিতে চাই। ঈদের নামাজের সময় সবাই উচ্চারণ করে, ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লা-হিল হামদ।’ অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা মহান, আল্লাহ তাআলা মহান, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নাই, আল্লাহ তাআলা মহান, আল্লাহ তাআলা মহান এবং সব প্রশংসা আল্লাহ তাআলার জন্য।
Advertisement
তারপর তারা ঈদের নামাজ পড়ে, খুতবা শোনে—যার মাধ্যমে এই চেতনাকে জাগ্রত করে যে, আমি আল্লাহর ডাকে সাড়া দিতে প্রস্তুত। আমার জীবন হবে তার ইবাদত ও আনুগত্যে পরিপূর্ণ। আমি সমাজে একা বা বিচ্ছিন্ন থাকবো না, বরং মুসলিম উম্মাহর সাথে মিলেমিশে চলবো।
ঈদের দিন কোরবানি করা হয়। আর কোরবানির সময় যে আয়াত পাঠ করা হয়:
إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلّٰهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
নিশ্চয় আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু—সবই কেবল জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। (সুরা আনআম: ১৬২)
এই বাক্যটিই কোরবানির অন্তর্নিহিত মর্মবাণী প্রকাশ করে—কোরবানি আসলে একটি প্রতীকী অঙ্গীকার (symbolic covenant)। এই অঙ্গীকার কেবল ঈদের দিনের জন্য নয়, বরং সমগ্র জীবনের জন্য। অর্থাৎ ঈদের দিন একজন মুমিন এই প্রতীকী কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর দরবারে বলে—হে রব, আমার জীবন হবে পুরোপুরি তোমার জন্য। আমি তোমার ইবাদতের প্রতিটি দাবি পূরণে প্রস্তুত। আমি তোমার কাজেই আমার জীবন ব্যয় করব। আমার মৃত্যু যখন আসবে, তখন যেন আমি তোমার মিশনে নিয়োজিত একজন বান্দা হিসেবে এই দুনিয়া ছাড়ি।
এটাই কোরবানির মূল শিক্ষা। এবং এটাই ঈদুল আজহার আসল চেতনা।
অনুবাদ: মওলবি আশরাফ
ওএফএফ/এমএস