দেশজুড়ে

জাফলংয়ে হামলা, উৎমাছড়া থেকে বের করে দেওয়া হলো পর্যটকদের

জাফলংয়ে হামলা, উৎমাছড়া থেকে বের করে দেওয়া হলো পর্যটকদের

সিলেটের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র জাফলংয়ে পর্যটকদের ওপর ‘স্থানীয়দের’ হামলার ঘটনা ঘটেছে। ঈদের তৃতীয় দিন সোমবার (৯ জুন) বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং বিজিবি ক্যাম্প সংলগ্ন গাড়ি পার্কিং এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

Advertisement

এর আগের দিন রোববার (৮ জুন) বিকেলে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পর্যটনকেন্দ্র উৎমাছড়া থেকে পর্যটকদের বের করে দেওয়ার অভিযোগ ওঠেছে স্থানীয় মাদরাসাছাত্র ও শিক্ষকদের বিরুদ্ধে।

পৃথক দুটি ঘটনারই ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে পর্যটকদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছে। অবশ্য জাফলংয়ের ঘটনাকে ‘তুচ্ছ’ উল্লেখ করে গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রতন কুমার অধিকারী জাগো নিউজকে বলেছেন, ‘বিষয়টি সমাধান হয়েছে। পর্যটকদের খুশি করে দেওয়া হয়েছে।’

কিন্তু বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন না পর্যটন খাত সংশ্লিষ্টরা। এতে সিলেটের পর্যটন শিল্পে বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।

Advertisement

জাফংলয়ে পর্যটকদের ওপর হামলা

জানা গেছে, স্থানীয় কয়েকজন চোরাকারবারি প্রকাশ্যে পর্যটনকেন্দ্র দিয়ে অবৈধ পণ্য নিয়ে যাচ্ছিলেন। এসময় বিজিবি সদস্যরা তাদের ধাওয়া দিলে চোরাই পণ্য একটি দোকানে রেখে পালিয়ে যান চোরাকারবারিরা। পরে বিজিবি সদস্যরা প্রত্যক্ষদর্শী এক পর্যটকের কাছে জানতে চান, ওই চোরাকারবারি কোথায় গেছে। এসময় পর্যটক যে দোকানে মালামাল রেখেছে সেটি দেখিয়ে দিলে বিজিবি সদস্যরা মালামাল জব্দ করে নিয়ে যান।

পরে বিজিবিকে তথ্য দেওয়াকে কেন্দ্র করে পর্যটকদের ওপর হামলা চালান চোরাকারবারিরা। এসময় বিভিন্ন দোকানের বড় বড় ছাতার হাতল দিয়ে পর্যটকদের বেধড়ক পেটানো হয়।

এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, লাঠি হাতে পর্যটকদের মারধর করেছেন কয়েকজন যুবক। একজন যুবক উচ্চস্বরে গালিগালাজ করছেন এবং লাঠি দিয়ে দু-তিনজনকে পেটাচ্ছেন। ভিডিওতে একজন নারীর চিৎকারও শোনা যায়।

ঘটনা ধামাচাপা দিতে স্থানীয় কয়েকজন বিষয়টি দ্রুত মীমাংসা করে দিয়েছেন বলে জানা গেছে।

Advertisement

এ বিষয়ে গোয়াইনঘাটের ইউএনও রতন কুমার অধিকারী বলেন, ‘তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পর্যটকদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি ও হাতাহাতি হয়েছে। পরে স্থানীয়দের নিয়ে বিষয়টি সমাধান করা হয়েছে। পর্যটকদের খুশি করে দেওয়া হয়েছে। তারা যাওয়ার সময় খুশি হয়ে গেছেন।’

কী কারণে এ ঘটনা ঘটেছে জানতে চাইলে ইউএনও বলেন, ‘পর্যটকদের অনেক বিষয় আছে। তবে এটা স্পেসিফিক কোনো বিষয় না। ইস্যুটা তেমন বড় কিছু না। এটা মীমাংসা হয়ে গেছে। যাওয়ার সময় তারা (পর্যটকরা) খুশি মনে গেছে।’

উৎমাছড়া থেকে বের করে দেওয়া হলো পর্যটকদের

অন্যদিকে, সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার উত্তর রনিখাই ইউনিয়নের চরারবাজার এলাকার উৎমাছড়া পর্যটনকেন্দ্রে ঘুরতে আসা পর্যটকদের বের করে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে স্থানীয় কওমি মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের বিরুদ্ধে। রোববার (৮ জুন) বিকেলে এ ঘটনা ঘটে। পর্যটকদের বাধা দেওয়ার এক ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।

উৎমাছড়া থেকে পর্যটকদের চলে যেতে বলেন মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া

সেই ভিডিওতে পর্যটকদের উদ্দেশে বলতে শোনা যায়, ‘এই এলাকার আলেম-ওলামা ও স্থানীয়রা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন উৎমাছড়াকে পর্যটনকেন্দ্র করা যাবে না। তাই আপনারা যারা এখানে এসেছেন দয়া করে এখান থেকে চলে যান। আপনারা এখানে থেকে এখানকার পরিবেশ নষ্ট করবেন না। আপনাদের মতো অনেকেই এখানে এসে মদ্যপান করে, অশ্লীল কার্যকলাপ করে। এতে এলাকার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। এলাকার পরিবেশ ঠিক রাখতে আমরা পর্যটকদের এখানে আসতে নিরুৎসাহিত করছি। আজকের পর আপনারা এখানে আর কোনোদিন আসবেন না।’

ভিডিওটিতে আরও বলতে শোনা যায়, ‘ঈদের আগের দিন উত্তর রনিখাই ইউনিয়নের উলামায়ে কেরাম মুরুব্বি ও যুব সমাজ সবাই মিলে সিদ্ধান্ত হয়েছে উৎমাছড়া এলাকায় পর্যটনের নামে কেউ আসতে পারবে না।’

জানতে চাইলে ট্যুরিজম ডেভেলপার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহ-সভাপতি মোহাম্মদ খতিবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘একটি পর্যটন কেন্দ্র শুধু একটি অঞ্চলকে উন্নত করে না, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যায়। সেখানে পর্যটকদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলে এর প্রভাব খুবই ক্ষতিকর হবে। এটা কোনোভাবেই কাম্য না।’

তিনি বলেন, ‘সিলেটের বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে নিরাপত্তার শঙ্কা রয়েছে। যেটা বারবার প্রমাণিতও হচ্ছে। এটা সিলেটের পর্যটন শিল্পের জন্য বড় ধরনের হুমকি। প্রতিটি পর্যটনকেন্দ্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ট্যুরিস্ট পুলিশের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসনের সার্বক্ষণিক তদারকি বাড়াতে হবে।’

সিলেটে সাম্প্রতিক সময়ে পর্যটকদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া একাধিক ঘটনাকে হালকা করে দেখার অবকাশ নেই বলে মনে করেন পরিবেশ ও ঐতিহ্য নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সরব ভূমিকা রাখা নাগরিক আন্দোলনের সংগঠক আব্দুল করিম কিম।

তিনি বলেন, ‘পর্যটন করপোরেশন থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রশাসন সিলেটে পর্যটন সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর কথা বললেও পর্যটকদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া একাধিক ঘটনায় তাদের তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। সিলেটে যারা পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তাদের এসব বিষয় নিয়ে সরব হওয়া প্রয়োজন। অন্যথায় এ ব্যবসায় ধস নামবে।’

ট্যুরিস্ট পুলিশ সিলেট রিজিয়নের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মতিউর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘জাফলংয়ের ঘটনায় স্থানীয়রা সমাধান করে দিয়েছেন। কিন্তু আমরা পর্যটকদের নাম-ঠিকানা সবই রেখেছি। তাদের বলা হয়েছে, অভিযোগ করলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

তিনি বলেন, ‘জাফলংয়ের ওই পর্যটকরা মানিকগঞ্জ থেকে সিলেটে এসেছেন। ঘটনার আগে ওই পর্যটক গ্রুপের ১৫ বছর বয়সী একজন সদস্য বিজিবির সঙ্গে কথা বলছিলেন। এই কথা বলার বিষয়টিকে স্থানীয়রা অন্যভাবে নেওয়ায় হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে আমরা জানতে পেরেছি।’

তবে উৎমাছড়ার বিষয়ে অবগত নয় বলে জানিয়েছেন ট্যুরিস্ট পুলিশের এ কর্মকর্তা।

জেএএইচ/এমকেআর/জিকেএস