রাজবাড়ীর পাংশার কসবামাজাইলে ‘পাঁচবাড়ীয়া হাসিনা ওয়াজেদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়লয়’র নাম পরিবর্তন করে করা হয়েছে ‘পাঁচবাড়ীয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার স্বামী ওয়াজেদ মিয়ার নামের সঙ্গে মিল থাকায় নামে এ পরিবর্তন করা হয়েছে।
জানা গেছে, স্কুলের নামে থাকা হাসিনা বা ওয়াজেদ কেউই শেখ হাসিনা বা তার পরিবারের কেউ নন। স্কুলটি প্রতিষ্ঠাকালীন পাংশার শিক্ষা কর্মকর্তা মনিবুর রহমানের মা ‘হাছিনা ওয়াজেদ’ ও বাবা ‘ওয়াজেদ আলী মিঞা’র নামে নামকরণ করা হয়েছিল।
জানা যায়, ২০১৩ সালে ১০ জুলাই বিদ্যালয়টি জাতীয়করণের সময় গেজেট বইতে ‘হাছিনা’ বানানের স্থানে ‘হাসিনা’ করা হলে সমালোচনা ঝড় ওঠে। কিন্তু ওই সময় ঝামেলা এড়াতে কোনো প্রদক্ষেপ নেয়নি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এরপর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ২০২৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি এক প্রজ্ঞাপনে হাসিনা ওয়াজেদ বাদ দিয়ে বিদ্যালয়ের নতুন নামকরণ করা হয় পাঁচবাড়ীয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এতে ক্ষোভের সৃষ্টি হয় শিক্ষার্থী, শিক্ষক, স্থানীয় বাসিন্দাসহ সাবেক শিক্ষা কর্মকর্তার মধ্যে।
এদিকে বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও জমিদাতাসহ স্থানীয়রা প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ের নামে স্কুলের নামকরণের দাবি জানিয়েছেন। তৎকালীন শিক্ষা অফিসার মনিবুর রহমান তার মা-বাবা অর্থাৎ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন নাম (পাঁচবাড়ীয়া হাছিনা ওয়াজেদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়) পুনর্বহালের দাবিতে প্রধান উপদেষ্ঠা, প্রাথমিক শিক্ষা উপদেষ্ঠা, সচিবসহ সংশিষ্ট দপ্তরের লিখিত আবেদন জানিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৮৮ সালে রাজবাড়ী পাংশার কসবামাজাইলে পাঁচবাড়ীয়ায় ৩৩ শতক জমির উপর স্থানীয়দের চাহিদার প্রেক্ষিতে পাংশার তৎকালীন শিক্ষা কর্মকর্তা মনিবুর রহমানের মা ‘হাছিনা ওয়াজেদ’ ও বাবা ‘ওয়াজেদ আলী মিঞা’র নামে ‘পাঁচবাড়ীয়া হাছিনা ওয়াজেদ বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা হয়। ওই সময় স্থানীয় ৪ জমিদাতা পরিবার থেকে ৪ জন স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তাদের মধ্যে তিনজন অবসরে গেলেও এখনো কর্মরত আছেন বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আলফাজ উদ্দিন। আট মাস পর তিনিও অবসরে যাবেন।
২০১৩ সালে ১০ জুলাই এক প্রজ্ঞাপনে বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ করা হলেও দেখা দেয় হাছিনা বানানে নামের জটিলতা। হাছিনার স্থলে হয়ে যায় হাসিনা। ফলে স্কুলটির নাম গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামের সঙ্গে মিলে যায়।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের নামের সঙ্গে মিল থাকা দেশের ৮০৮টি প্রতিষ্ঠান এবং স্থাপনার নাম পরিবর্তন করে অন্তর্বর্তী সরকার। সে সময় উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের চাহিদা মোতাবেক বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নতুন নাম নির্বাচন করে রেজুলেশন পাঠায়। পরে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি এক প্রজ্ঞাপনে পাঁচবাড়ীয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামকরণ করা হয়।
সরজমিনে বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যালয়টির ভবনে পূর্বের নাম রং দিয়ে মুছে নতুন নাম লেখা হয়েছে। তারপরও আগের নাম বোঝা যাচ্ছে। এছাড়া বিদ্যালয়ের লাইব্রেরিসহ শ্রেণিকক্ষে টানানো নামফলকসহ ফেস্টুন-প্ল্যাকার্ডে রয়েছে পুরাতন নাম।
স্কুলের সাবেক শিক্ষার্থী আপন বলে, আমারা যখন এই স্কুলে পড়েছি, তখন এক নাম ছিল আর এখন অন্য নাম। কোথাও স্কুলের নাম বলতে গেলে খারাপ লাগে। তবে স্কুলের একটি নির্দিষ্ট নাম হলে আমাদের সবার জন্য ভালো হবে।
স্থানীয় তাপস বিশ্বাস বলেন, এই স্কুল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে ছিল না। কিন্তু তারপরও নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। এতে আমর কষ্ট লেগেছে। আগের নাম ভালো ছিল।
স্কুলের সাবেক সভাপতি সৈলনাথ বিশ্বাস ও সাবেক শিক্ষক দ্বীনবন্ধু বিশ্বাস বলেন বলেন, প্রতিষ্ঠাকালে আমরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্কুলের উন্নয়নের জন্য পাংশার তৎকালীন শিক্ষা অফিসার মনিবুর রহমানের মা হাছিনা ও বাবা ওয়াজেদের নামে পাঁচবাড়ীয়া হাছিনা ওয়াজেদ বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামকরণ করি। ২০১৩ সালে জাতীয়করণের সময় হাছিনার স্থলে হাসিনা ওয়াজেদ হয়ে যায়। এরপর ছাত্র আন্দোলনের পর একবারে হাসিনা ওয়াজেদ বাদ দিয়ে স্কুলের নতুন নাম হয়।
তিনি আরও বলেন, আমরা যখন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করি তখন শেখ পরিবারের কারও নামের সঙ্গে এই স্কুলের কোনো সম্পর্ক ছিল না এবং এখনও নাই। তাই আমরা যেহেতু ওই সময় স্বতঃস্ফূর্তভাবে মনিবুর রহমানের মা-বাবার নামে স্কুলের নামকরণ করেছিলাম, সেহেতু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ হিসেবে আমরা চাই পুনরায় স্কুলের নাম পাঁচবাড়ীয়া হাছিনা ওয়াজেদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামকরণ করা হোক।
সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার মনিবুর রহমান মিঞা বলেন, ২০১৩ সালে জাতীয়করণের আগ পর্যন্ত বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন নাম ব্যবহার হলেও জাতীয়করণের সময় গেজেটে হাছিনা নামের বানানে হাসিনা চলে আসে। কিন্তু এই বিদ্যালয় শেখ পরিবার বা শেখ হাসিনা ও ওয়াজেদ মিয়ার নাম না। এটা আমার মা ও বাবার নামে। ৫ আগস্টের পর হয়তো শেখ পরিবারের নাম মনে করে আমার মা-বাবার নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। এতে আমরা ব্যথিত হয়েছি। তাই প্রতিষ্ঠাকালীন নাম পুনর্বহালের জন্য আমি এরই মধ্যে প্রধান উপদেষ্ঠা, প্রাথমিক শিক্ষা উপদেষ্ঠা ও সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবর চিঠি দিয়েছি। আশা করছি সঠিক তথ্য যাচাই করে প্রতিষ্ঠাকালীন নাম বহাল করা হবে।
বিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আলফাজ উদ্দিন বলেন, ২০১৩ সালে যখন স্কুল জাতীয়করণ হয়, তখন বানানের পার্থক্য হয়। গেজেট বইতে হাছিনা বানানের স্থানে আসে হাসিনা। তখন সংশোধন না করতে পারায় এভাবে থেকে যায়। ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর উপজেলা অফিসের নির্দেশে স্কুলের নতুন নামকরণ করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, স্কুলের নাম পাঁচবাড়ীয়া হাসিনা ওয়াজেদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হওয়ায় অনেকে ভেবেছে এটা সাবেক প্রধানমন্ত্রী বা তার পরিবারের নামে। কিন্তু না, এটা আমাদের সাবেক শিক্ষা কর্মকর্তা মনিবুর রহমানের মা-বাবার নামে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলে এবং ওই নামেই আমরা ভালো ছিলাম।
রাজবাড়ী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. তবিবুর রহমান বলেন, স্কুল কর্তৃপক্ষসহ উপজেলা ও জেলা কমিটির সুপারিশের প্রেক্ষিতে এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বিদ্যালয়টির নামের কিছু অংশ বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে বিদ্যালয়েলয়ের পূর্বের নাম বহাল রাখার দাবিতে সচিব বরাবর একটি আবেদন করা হয়েছে। এর অনুলিপি আমাকে দেওয়া হয়েছে। এখন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী প্রয়োজনীয় কার্যক্রম নেওয়া হবে।
রুবেলুর রহমান/এমএন/জিকেএস