খেলাধুলা

অভিষেক টেস্টের সহঅধিনায়ক পাইলট আছেন ক্রিকেট একাডেমী ও ব্যবসা নিয়ে

মুশফিকুর রহিম, লিটন দাস, জাকের আলী অনিক এবং নুরুল হাসান সোহান- এখন জাতীয় দল ও তার আশপাশে উইকেরক্ষকের ছড়াছড়ি।

এবং সবচেয়ে বড় কথা তারা সবাই আবার স্বীকৃত ব্যাটারও। তাদের যে কাউকে উইকেরক্ষক কাম মিডল অর্ডার ব্যাটার হিসেবে দলে রাখা যায়। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে দলে যেমন আছেন লিটন দাস আর জাকের আলী অনিক।

কিন্তু জানেন কি, বাংলাদেশ যখন টেস্ট খেলতে শুরু করে তখন জাতীয় দলের আশপাশে উইকেরক্ষক ছিলেন হাতে গোনা দু’একজন। উইকেটের পিছনে গ্লাভস হাতে বিশ্বস্ত কিপার বলতে বোঝাতো একজনকেই; তিনি খালেদ মাসুদ পাইলট।

তার আগে বাংলাদেশ যখন দেশের মাটিতে এমসিসি, হায়দরাবাদ ব্লুজ, ডেকান ব্লুজ আর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে খেলেছে, সেই ৭০ ও ৮০‘র দশকে জাতীয় দলে উইকেরক্ষক বলতে বোঝানো হতো শুধু একজনকেই। তিনি শফিকুল হক হীরা।

১৯৭৯ ও ৮২‘র আইসিসি ট্রফিতে অধিনায়কত্ব করার পাশাপাশি উইকেরক্ষকের দায়িত্বটাও পালন করেন হীরা। ৮২‘র আইসিসি ট্রফির পর থেকে শুরুতে সাবেক অধিনায়ক শফিকুল হক হীরার পর দক্ষ কিপার হিসেবে উঠে আসেন তিনজন; নাসির আহমেদ নাসু, হাফিজুর রহমান সানি ও ফয়সাল হায়দার।

এই তিনজনের মধ্যে হাফিজুর রহমান সানি ছিলেন উঁচুমানের কিপারের প্রতিচ্ছবি; কিন্তু উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশ চলে গেলে তার জায়গায় উইকেটের পিছনে জায়গা নিশ্চিত হয়ে যায় নাসির আহমেদ নাসুর। তিনি ৯০ দশকের শুরু থেকে বেশ কয়েক বছর সুনামের সাথে জাতীয় দলের কিপারের দায়িত্ব পালন করেন।

কিন্তু ৯০ দশকের মাঝামাঝি তার জায়গায় উঠে আসেন রাজশাহীর ছেলে দেশ বরেণ্য ফুটবলার শামসু তনয় খালেদ মাসুদ পাইলট। খুব অল্প সময়েই নিজের ক্ষিপ্রতা, চপলতা আর দক্ষতার প্রমাণ দিয়ে পাইলট হয়ে ওঠেন দেশ সেরা উইকেরক্ষক। বাংলাদেশ যখন টেস্ট মর্যাদা পায় পাইলট তখন উইকেরক্ষক হিসেবে অপ্রতিদ্বন্দী।

তাই অভিষেক টেস্টের প্রথম একাদশে পাইলটের থাকা নিয়ে ছিল না কোন সংশয়। তিনি ছিলেন অটোমেটিক চয়েজ। আর তাই তখনকার বোর্ড নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের ডেপুটি হিসেবেও পাইলটকে বেছে নেয়। পাইলট ছিলেন অভিষেক টেস্টের সহ-অধিনায়ক।

তবে পাইলটের আক্ষেপ, টেস্ট মর্যাদা প্রাপ্তির রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠানে অভিষেক টেস্ট অধিনায়ক নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের পাশাপাশি তার পক্ষেও উপস্থিত থাকা সম্ভব হয়নি।

তখন তিনি জার্মানির হামবুর্গে অবস্থান করছিলেন। রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠানের আগে জার্মানির হামবুর্গ থেকে মুঠোফোন জাগোনিউজের সঙ্গে আলাপে পাইলট জানান, ক্যাপ্টেন দুর্জয় হয়তো রাজনৈতিক কারনেই উপস্থিত থাকতে পারেনি। আমি কানডায় পড়াশোনা করতে থাকা একমাত্র ছেলের সাথে এবার ঈদ করতে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে ইউরোপ আসি। ডেনমার্ক হয়ে জার্মানিতে গিয়েছিলাম। এরপর রোম (ইটালি) হয়ে দেশে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ২৭-২৮ জুন। তাই অভিষেক টেস্ট দলকে যে সংবর্ধনা দেয়া হবে তাতে অংশগ্রহন করতে পারছি না ‘ এজন্য ভিষণ মন খারাপ পাইলটের। অভিষেক টেস্টের স্মৃতিচারণ করতে বলা হলে পাইলট জানান, ‘আসলে দুই যুগের বেশি সময় আগের কথা। সেভাবে মনে নাই। তবে সে সময় আমি ঢাকা লিগে আবাহনী আর ন্যাশনাল লিগে রাজশাহীর হয়ে খেলেছি, তা মনে আছে।’ টেস্ট খেলা প্রসঙ্গে পাইলটের স্বভাবসূলভ সংলাপ, ‘আসলে আমি একা নই, আমাদের সবার কাছে ‘টেস্ট’ ছিল এক স্বপ্ন। এক ‘মায়া।’ আর সবার মত আমিও স্বপ্ন দেখতাম টেস্ট খেলবো। এক সময় সুযোগ চলে এলো। তখনতো আর এত হিসাব-নিকাশ করে দল সাজানো হতো না। কোন রিজার্ভ কিপারও ছিল না। আমিই ছিলাম একমাত্র উইকেরক্ষক। তাই দলে অবস্থান ছিল নিশ্চিত। সে কারনে আমাকে সহ-অধিনায়কও করা হলো।’

‘খেলার কথা কিছুই মনে নেই। শুধু এটুকু বলতে পারি, টেস্ট শুরুর আগের রাতে ঘুম হয়নি। শুধু মনে হয়েছে আমরা পুকুরে সাঁতার কাটতাম। সেখান থেকে মহা সাগরে পড়তে যাচ্ছি। এখন বুঝি, আমরা সবাই তখন অপরিপক্ক ছিলাম। আমরা ক্রিকেটার থেকে শুরু করে কোচিং স্টাফ কর্মকর্তা, বোর্ডসহ সবাই অ্যামেচার ছিলাম। টেস্ট ক্রিকেট কি, আমরা তখন জানতাম না। বুঝতাম না। সে কারণেই প্রথম ইনিংসে ৪০০ রান করার পরও ম্যাচে থাকতে পারিনি। ছিটকে দুরে সরে গিয়েছিলাম।’

বলে রাখা ভাল, অভিষেক টেস্টে পাইলট দেখিয়ে দেন, ‘উইকেটে টিকে থাকার ক্ষমতা আছে আমার।’ আট নম্বরে নেমে ১৬৯ মিনিটে ১২১ বলে একটি মাত্র বাউন্ডারি দিয়ে করা ৩২ রানের ইনিংসে ছিল সে বার্তা।

অভিষেক টেস্ট নিয়ে আলাপের পর পাইলট ফিরে তাকাতে চান গত ২৫ বছরের দিকে। তার অনুভব, শুরুর দিকে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড পেশাদার মানসিকতার চেয়ে আবেগ, উচ্ছ্বাস নিয়ে চলেছে এবং কিছু ভুল পদক্ষেপ নিয়েছে। সে কারণেই টেস্টে থিতু হতে, টেস্ট ক্রিকেট বুঝতে এবং নিজেদের টেস্ট উপযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে দেরি হয়েছে।

পাইলটের কথা, ‘আমরা শুরুতে কিছু ভুল করেছি। যেমন দেশে খেলার চেয়ে প্রথমেই আমরা বড় বড় দেশে ট্যুর করেছি। একটি হলো দেশের চেয়ে বাইরে অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকার মত দেশে শুরুর দিকেই টেস্ট খেলতে যাওয়া। এত বড় বড় ট্যুর করে আমরা সমুদ্রের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম। এখন আমাদের অফিসিয়ালরা বুঝে, ঘরের মাঠে খেলতে হবে বেশি। স্পিন ট্র্যাক বানাতে হবে। শুরুর কয়েক বছর আমরা ওসব বুঝতাম না। তাই বড় দলগুলোর সাথে ‘ট্রু’ উইকেটে খেলা হতো। তবে ধীরে ধীরে খেলতে খেলতে আমরা অ্যাডজাস্ট করতে শুরু করলাম। একটা পর্যায়ে গিয়ে একটু ধাতস্ত হতে শিখলাম। ২০০০ সালে শুরুর পর আমাদের তখন ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ডে মানিতে নিতেই ৩-৪ বছর লেগে গেল।’

দেশের ক্রিকেট ব্যবস্থাপনা নিয়েও রাজ্যের আক্ষেপ পাইলটের। তার অনুভব, আমাদের দেশের ক্রিকেটে কাঙ্খিত উন্নতি হয়নি। কেন হয়নি, জানেন? শুধু মাত্র ‘ভিশন’ না থাকার কারণে। এছাড়া দলবাজি, রাজনীতিকরণটাও ক্রিকেটে উন্নতি না হওয়ার প্রধান কারণ।

জাতীয় দলের এ সাবেক অধিনায়কের কথা, ২৫ বছরে ক্রিকেটকে এগুনোর পরিবর্তে রাজনীতি করেছি। রাজনীতিকরণ করেছি। রাজনীতির মধ্য দিয়ে চেষ্টা করেছি বোর্ডে থাকবো। কোনো দল ক্ষমতায় আসবে, সেই দলে থেকে না হয় সমর্থন পুষ্ট হয়ে কিভাবে বোর্ডে যাব? এসব করেছি। তাতে কি আর ক্রিকেট ডেভেলপ হবে? হয়নিও।’

বোর্ডের অপেশাদারিত্ব পাইলটকে কষ্ট দেয়। তার আক্ষেপ মাখা সংলাপ, ‘ক্রিকেট আমাদের দেশের মানুষের আশা আকাঙ্খার প্রতীক। কিন্তু আমাদের বোর্ড আনপ্রফেশনাল। তাই পলিটিক্যাল পারসনরা চলে আসে নেতৃত্বে। অথচ দেখেন শাহরুখ খান আর আম্বানির মত ধনকুবেররাও ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডে জায়গা পান না; কিন্তু আমাদের দেশে সরকারি দলের কাছকাছি থাকতে পারলেই বিসিবিতে থাকা যায়।’

আপনি কি বোর্ডে আসতে চান না? দেশের ক্রিকেটের জন্য কিছু করতে ইচ্ছে হয় না? ‘কেন হবে না। অবশ্যই হয়। আমিতো কায়মনোবাক্যে দেশের ক্রিকেটের মঙ্গল, কল্যাণ চাই। আর তাই চাকুরিও নিয়েছি ক্রিকেট ওরিয়েন্টেড।’ বলে রাখা ভাল, ক্রিকেট ছেড়ে সেই ২০১৩ সাল থেকে আকিজ গ্রুপে চাকুরি করছেন পাইলট। ‘আমি আকিজ গ্রুপে জব করি। কি পদে? ২০০৯ সাল থেকে আকিজ গ্রুপে জব করছি। ১৬ বছর ধরে ক্লেমন স্পোর্টস এর চিফ অপারেটিং অফিসার। রাজশাহী, দিনাজপুর, যশোর, নারায়নগঞ্জসহ ৭টা শহরে ক্রিকেট একাডেমির কর্মকান্ড পরিচালনা আমার দায়িত্ব।’

বিসিবিতে থাকা প্রসঙ্গে পাইলটের কথা, ‘আমার আসলে বলেকয়ে যাওয়ার ইচ্ছা নাই। আমাকে ডাকলে আমি কাজ করবো। আমি চিন্তা করি সুযোগ আসলে কাজ করবো। দেশের ক্রিকেট নিয়ে কাজ করবো। রাজশাহী থাকি বলে রাজশাহীর নার্ভ বুঝি, তাই ক্রিকেট একাডেমি করেছি রাজশাহীতে। সারা দেশের ক্রিকেটের জন্য কাজ করতে চাই।’ চাকুরি ও ক্রিকেট একাডেমি চালানোর বাইরে রাজশাহীতে আরও একটি প্রজেক্টে হাত দিয়ে সফল পাইলট। রাজশাহী শহরে পদ্মা পাড়ে নোংরা, আবর্জনায় পড়ে থাকা জমি সিটি কর্পোরেশেনের কাছ থেকে লিজ নিয়ে নির্মাণ করেছেন রেস্টুরেন্ট ‘নোঙ্গর।’

‘ওই জায়গাটা নোংরা, আবর্জনায় ভরা খালি পড়ে ছিল। সিটি কর্পোরেশনের কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে প্রথমে সবুজ গাছ লাগিয়ে একটা গার্ডেন তৈরি করি আগে। সামনে সবুজ লন। গার্ডেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাথে আমার পরিকল্পনায় নতুন করে সাজানো নোঙ্গর রেস্টুরেন্ট এখন রাজশাহী শহরে সাড়া ফেলেছে। সবাই ছবি তুলতে যায়। ভীড় লেগেই থাকে।’

ব্যক্তি জীবনে এক ছেলের জনক পাইলট। কানাডা প্রবাসী ২৫ বছর বয়সী ছেলে কম্পিউটার সায়েন্সে গ্র্যাজুয়েশন্স শেষে চাকুরি করছে। পাইলটের মনটা তাই খুব খুশি, ‘জানেন এবার ছেলের সাথে কানাডায় ঈদ করেছি। গ্র্যাজ্যুয়েশন শেষে ফুল টাইম জব করছে। আমার যে কি ভাল লাগছে। ছেলে আমার নিজের মত করে জীবনটাকে গড়ে তুলতে পেরেছে।’

এআরবি/আইএইচএস/