উপাচার্যের মেয়ে ভর্তি হয়েছেন পোষ্য কোটায়! তিনি ঢাবির স্থায়ী নিয়োগপ্রাপ্ত অধ্যাপক, কুবিতে এসেছেন ডেপুটেশনে। তবে পোষ্য কোটা কেবল স্থায়ী নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক কর্মকর্তা কর্মচারীর সন্তানরা পেয়ে থাকেন। সে হিসাবে ডেপুটেশনে আসা উপাচার্যের মেয়ের পোষ্য কোটায় ভর্তি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নেটিজেনরা।
উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও রেজিস্ট্রার বলছেন, অ্যাকাডেমিক কমিটির সিদ্ধান্তক্রমে এটি হয়েছে। আর সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলছেন, উপাচার্যের সন্তান পোষ্য কোটা পেলে ঢাবিতে পাবে, কুবিতে নয়। কুবিতে কোটা নিয়ে এ ভর্তি অবৈধ।
এদিকে স্থায়ী নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক কর্মকর্তা কর্মচারীর সন্তানরাই কেবল পোষ্য কোটা পাবে, এমন মতামতই দিয়েছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার, অধ্যাপক ও ইউজিসি সদস্যরা।
ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান বলছেন, তিনি এখানে স্থায়ী কর্মকর্তা না। ডেপুটেশনে এসেছেন, তাই এগুলো বড় বিতর্ক তৈরি করে। এখানে তো কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের বিষয় আছে। উপাচার্যের উচিত এসব বিষয় এড়িয়ে চলা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ বছর মেধায় কুবিতে যারা ভর্তি হয়েছেন তাদের নম্বর ৬০ এর বেশি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হায়দার আলীর মেয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় ১০০ নম্বরের মধ্যে ৪৬.২৫ নম্বর পেয়ে পোষ্য কোটায় কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগে ভর্তি হয়েছেন।
তবে বিগত সময়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে আসা শিক্ষকরা পোষ্য কোটা ব্যবহার না করায় বিষয়টি একেবারেই নতুন একটি ঘটনা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে। এই বিষয়টি অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটেছে কি না এবং ঘটলে কেমন প্র্যাকটিস রয়েছে জানতে একাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের সঙ্গে কথা হয়। তারাও বিষয়টি নতুন শুনছেন বলে জানান।
এছাড়া নিয়ম রয়েছে ভর্তি পরীক্ষায় যদি কোনো শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর নিকটাত্মীয় কেউ অংশগ্রহণ করেন তাহলে তারা ভর্তি পরীক্ষার কোনো দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। কিন্তু জানা যায়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হায়দার আলী।
ব্যাপারে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ডেপুটেশন অস্থায়ী একটি বিষয়। বাহির থেকে কেউ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এলে সেক্ষেত্রে এটি (পোষ্য কোটা) প্রযোজ্য হবে না। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ বিষয় নিয়ে আমি কনফিউজড।’
পরীক্ষা কার্যক্রমের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কারো সন্তান বা নিকটাত্মীয় পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলে তিনি পরীক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন না। এটি সর্বত্রই আছে।’
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) রেজিস্ট্রার ড. মনজুরুল হক বলেন, ‘আমাদের এখানে যেটা আছে পোষ্য কোটা বলতে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্মানেন্ট (স্থায়ী) শিক্ষক বা কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকেই বুঝি। তবে আপনি (প্রতিবেদক) যে বিষয়টি বলছেন এমন সিচুয়েশন আমাদের এখানে কখনো হয়নি।’
নিকটাত্মীয় পরীক্ষা দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কারো নিকটাত্মীয় থাকলে তিনি আগে থেকেই কনফার্ম করে দেন এবং তিনি পরীক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারেন না।’
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এখানে এরকম কিছু লেখা নেই যে তিনি (উপাচার্য) এই কোটা পাবেন না। তিনি তো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল কিছু ব্যবহার করছেন। তিনি চ্যান্সেলর কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত এবং তিনিও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দিচ্ছেন। তার (উপাচার্য) কোথাও কি লেখা রয়েছে যে তিনি এই সুবিধা পাবেন, এটি পাবেন না? ভর্তি পরীক্ষার বিষয়গুলো কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিংয়ে আলোচনা হয়, এরপর সেটি অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে ওঠে। তারপর সিন্ডিকেটে যায়। তখন কোনো সদস্য না করেননি যে এটি এমন হবে না। কোটার বিষয়টি স্পেসিফিক না।’
পরীক্ষা কমিটিতে থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘উপাচার্য কেন্দ্রীয় ভর্তি কমিটির দায়িত্ব পালন করেছেন। ইউনিট অনুযায়ী ভাগ করে দিয়েছেন। তবে ‘এ’ ইউনিটের কোনো দায়িত্ব তিনি পালন করেননি। কেন্দ্রীয় ভর্তি কমিটিতে পদাধিকারী বলে তিনি সভাপতি ছিলেন। এখানে নিয়মের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। তিনি দায়িত্বে ছিলেন কেন্দ্রীয় কমিটির, কিন্তু তিনি যাননি। তিনি ‘এ’ ইউনিটের দায়িত্ব ‘এ’ ইউনিটের আহ্বায়ককে দিয়ে পালন করিয়েছেন।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাসুদা কামাল বলেন, ‘আসলে এই ব্যাপারে সুস্পষ্ট নীতিমালা নেই। তবে নিয়মগুলো মেনেই করা হয়েছে। নিয়ম লঙ্ঘন করে কিছু হয়নি। আমরা বিবেচনা করেছি উনার (উপাচার্য) মেয়ে বাচ্চা। তিনি দূরে কোথাও দিতে চাচ্ছেন না। এটি বিবেচনা করা হয়েছে।’
সিন্ডিকেটে সিদ্ধান্ত হয়েছে কি না? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটি কেন্দ্রীয় পরীক্ষা কমিটিতে আলোচনা হয়েছিল।’
নিকটাত্মীয় কেউ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলে পরীক্ষার কোনো দায়িত্বে থাকা যায় না, কিন্তু উপাচার্য থেকেছেন। এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ডা. মাসুদা কামাল বলেন, ‘তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির দায়িত্বে ছিলেন উপাচার্য হিসেবে। কিন্তু ‘এ’ ইউনিটে যেহেতু উনার মেয়ে পরীক্ষা দিয়েছেন তাই ‘এ’ ইউনিটের কোনো কার্যক্রমে তিনি যাননি।’
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান বলেন, ‘যেহেতু উপাচার্য কোনো স্থায়ী পদ নয়, সরকার চাইলে যেকোনো সময় সরিয়ে নিতে পারেন সেক্ষেত্রে এমন সুবিধাগুলো (পোষ্য কোটা) না নেওয়ায় ভালো। তিনি এখানে পার্মানেন্ট কর্মকর্তা না। ডেপুটেশনে আসছেন, তাই এগুলো বড় বিতর্ক তৈরি করে। এখানে তো কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের বিষয় আছে। এছাড়া কারো নিকটাত্মীয় যদি ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন তাহলে তার ভর্তি পরীক্ষা কার্যক্রমে থাকার সুযোগ নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ঘটনাটি ঘটেছে সেটি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা নেই। তবে, একজন উপাচার্যের উচিত এমন বিতর্কিত বিষয়গুলো এড়িয়ে চলা। এতে উপাচার্যের গ্রহণযোগ্যতা থাকে না।’
সার্বিক বিষয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হায়দার আলী বলেন, ‘আমি এখানে একা কিছু করি নাই। অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল ও অন্যান্য জায়গা থেকে অনুমোদিত হয়েছে বিষয়টা। কোনো জায়গা থেকে আপত্তি জানানো হয়নি।’
এফএ/এমএস