জ্যোতিষ সমাদ্দার বাবু
দুপুরটা ছিল একেবারেই সাধারণ। মাইলস্টোন কলেজে তখন স্বাভাবিক নিয়মে পাঠদান চলছিল। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডেই পাল্টে গেলো সবকিছু। বিকট শব্দ, আগুনের হলকা, কান্না, ধোঁয়া আর মৃত্যু—সব একসাথে নেমে এলো উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকায় অবস্থিত দেশের অন্যতম বৃহৎ এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি এফ-৭ বিজিআই সিরিজের যুদ্ধবিমান কুর্মিটোলা ঘাঁটি থেকে উড্ডয়ন করে মাত্র ১২ মিনিট পর মাইলস্টোন কলেজ ভবনে আছড়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন শ্রেণিকক্ষে, যেখানে ক্লাস চলছিল। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মচারীরা আতঙ্কে ছোটাছুটি শুরু করেন।
যা হারালামএ মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩১ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে আছেন পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম এবং সাহসী শিক্ষক মাহরিন চৌধুরী—যিনি ২০ শিক্ষার্থীর প্রাণ বাঁচিয়েছেন। আহত হয়েছেন ১৬৫ জনের বেশি, যাদের বেশিরভাগই শিক্ষার্থী।
ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে—জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউট, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ আরও কয়েকটি স্থানে আহতরা মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। ছোট ছোট শিশুদের দগ্ধ মুখ, কান্নারত অভিভাবক আর পোড়া বইয়ের পাতা—সব মিলিয়ে এ দৃশ্য কেবল একটি সংবাদের উপাদান নয় বরং আমাদের জাতিগত ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি।
বিমান রক্ষণাবেক্ষণের দায় কার?চীনে তৈরি এফ-৭ সিরিজের যুদ্ধবিমান নিয়ে এর আগেও বাংলাদেশে একাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। প্রশ্ন হচ্ছে—রক্ষণাবেক্ষণ এবং উড্ডয়ন-নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কতটা নিরাপদ?
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর দিয়ে প্রশিক্ষণ বিমান কেন?জনবহুল, শিশু-কিশোর অধ্যুষিত একটি এলাকায় প্রশিক্ষণ বিমান পরিচালনার সিদ্ধান্ত কতটা যৌক্তিক? উন্নত বিশ্বে স্কুল, হাসপাতাল বা আবাসিক এলাকার ওপর দিয়ে বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকে। আমাদের দেশে কি তেমন কোনো কার্যকর নীতিমালা আছে?
অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা কোথায়?মাইলস্টোন কলেজে কার্যকর কোনো অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না। জরুরি নির্গমন পথ বা মহড়া ছিল না বলেই শিক্ষার্থীদের জানালা ভেঙে বা পেছনের গেট দিয়ে ভয়ে পালাতে হয়েছে। এমন প্রতিষ্ঠানে এটি চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় নয় কি!
নিরাপত্তা নীতিমালার পুনর্বিবেচনা জরুরিএ দুর্ঘটনার পর এখন সময় এসেছে—শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও জনবহুল এলাকাকে ‘নো-ফ্লাই জোন’ হিসেবে শ্রেণিবিন্যাস করার। যুদ্ধবিমান বা প্রশিক্ষণ বিমান যেন এসব অঞ্চলের ওপর দিয়ে উড়তে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলকভাবে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র, মাসিক মহড়া এবং জরুরি নির্গমন প্রশিক্ষণ বাস্তবায়ন করতে হবে।
রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব কী হবে?সরকার একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে। রাষ্ট্রপতি ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ বহু দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা শোক প্রকাশ করেছেন। সেনাবাহিনী ও উদ্ধারকর্মীরা দ্রুততার সঙ্গে কাজ করেছেন। তবে প্রতিক্রিয়ামূলক ব্যবস্থার বাইরে গিয়েই প্রয়োজন দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা, যাতে নতুন প্রজন্মের মধ্যে জন্ম নেওয়া আস্থাহীনতা দূর হয়। তাই দোষারোপ নয়, সিস্টেমকে শক্তিশালী করাই এখন সময়ের দাবি।
পরিসংখ্যান যা বলছেচীনের তৈরি এফ-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান মূলত সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মিগ-২১-এর আদলে তৈরি একটি এক ইঞ্জিনবিশিষ্ট হালকা ফাইটার জেট। ২০১৩ সালের মে মাসে এর উৎপাদন বন্ধ হলেও বাংলাদেশের জন্য তৈরি করা ইউনিট ছিল জে-৭ সিরিজের শেষ সংস্করণ।
এফ-৭-এর উল্লেখযোগ্য দুর্ঘটনা (বাংলাদেশে)৮ এপ্রিল ২০০৮: টাঙ্গাইলে বিধ্বস্ত, স্কোয়াড্রন লিডার মোরশেদ নিহত২৯ জুন ২০১৫: পতেঙ্গা উপকূল, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তাহমিদ নিখোঁজ২৩ নভেম্বর ২০১৮: টাঙ্গাইলে, পাইলট আরিফ আহমেদ নিহত২১ জুলাই ২০২৫: মাইলস্টোন কলেজে বিধ্বস্ত, ৩১ নিহত
অন্যান্য দেশে দুর্ঘটনাচীন: ৪টি দুর্ঘটনা (২০১০-২০২২), ৩ হতাহতপাকিস্তান: ২টি (২০১৫-২০২০), ৩ পাইলট নিহতমিয়ানমার: ২টি (২০১৮-২০২৫), ৮ নিহতইরান ও জিম্বাবুয়ে: ১টি করে দুর্ঘটনা।
বাংলাদেশে ১৯৯১ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত বিমান বাহিনীতে ৩৭টি ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। এত অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও কেন জনবসতিপূর্ণ এলাকায় প্রশিক্ষণ ফ্লাইট চালানো হলো?
দুঃখ প্রকাশ কি যথেষ্ট?কর্তৃপক্ষ দুঃখ প্রকাশ করেছেন কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়—শিশুদের প্রাণ ফিরবে কি? যারা বেঁচে আছে, তারা পোড়া শরীর নিয়ে সারাজীবন কষ্ট ভোগ করবেন। এ বেদনা কোনো ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
শেষ কথাএ মৃত্যু কেবল একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষতি নয়—এটি পুরো জাতির ভবিষ্যতের ওপর এক ভয়াবহ আঘাত। আমরা যেন আর কোনো ‘মাইলস্টোন’ না হারাই—না কোনো দুর্ঘটনায়, না কোনো অব্যবস্থাপনায়।
লেখক: সাংবাদিক ও সংগঠক।
এসইউ/এএসএম