স্কুল ছুটির সময় বাচ্চাদের অভিভাবকরা আসেন স্কুল গেইটে। একজন একজন করে বাচ্চা অভিভাবকের হাতে তুলে দেন এক শিক্ষিকা। কাউকে কপাল ছুঁয়ে, কারো কপোল ছুঁয়ে আদর করেন তিনি। সেদিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষিকা মাহরীন ম্যাম এর। তিনি অভিভাবকদের হাতে বাচ্চাদের তুলে দেয়ার কথা গেইটে দাঁড়িয়ে। তখনই ঘটে বিপর্যয়। আকাশ কাঁপিয়ে বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে স্কুল ভবনে। অকল্পনীয় সেই দৃশ্য। এমন ভয়াবহ দৃশ্য কেউ দেখেনি এর আগে,জানেও না কেউ। বাড়ি ফেরার আনন্দে শিশুদের উল্লাস মুহূর্তেই আর্তনাদে পরিণত হয়। দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে শিশুরা ছোটাছুটি করছে।স্কুল অঙ্গনে আগুনের ফুলকি।স্কুল গেইটে থাকা মানুষগুলো যার যার বাচ্চা নিয়ে দৌড়াচ্ছে।
জীবন বাঁচানোর জন্য মাহরীন ম্যামকেও দৌড়ে বাইরে চলে যাওয়াই স্বাভাবিক ছিল। তিনি নিজের জীবনের কথা ভাবলেন না। ভাবলেন না নিজ পরিবার-পরিজনের কথাও।তার সামনে ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের জীবন-বাঁচানোর দায়। ঠিক মায়ের মতো।তার সামনে স্ফুলিঙ্গ,এর ভিতর প্রাণপ্রিয় শিশুরা। সেই আগুনেই ছুটলেন তিনি।
ওইসময়ই স্বামীর ফোন-স্ত্রীকে অনুরোধ করলেন, বেরিয়ে আসো তুমি।
জবাব তাঁর-আমার বাচ্চারা মারা যাচ্ছে। তাদের বাঁচাতে হবে।
এত বড় ঘটনার পরও একজন শিক্ষক প্রতিটি বাচ্চার বাবা মা কিংবা অভিভাবকের হাতে তুলে দেন শিশুটিকে। কাউকে হয়তো কপাল ছুঁয়ে দেন কারো গাল টিপে দেন আদর করে। এভাবেই দীর্ঘদিন ঢাকার মাইলস্টোন স্কুলের একজন শিক্ষক মাহরীন পাঠদানের পাশাপাশি শিশুদের নিরাপত্তা বিধানেরও দায়িত্ব পালন করছিলেন। একে একে বের করে আনতে থাকেন শিশুদের। এভাবে কুড়িটা শিশুকে বের করে আনলেন।তখন তার গায়ে আগুন। দগ্ধ হলেন তিনিও। শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে আত্মসমর্পণ করলেন মৃত্যুর কাছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে মহীয়সী মাহরীনের কথা।এতগুলো শিশুর প্রাণহানি ও আহত হয়ে হাসপাতালে কাতরানোর সংবাদের মধ্যে আনন্দ-বেদনার এই সংবাদ। অবশ্যই যে কারো মনে বিদ্ধ হতে পারে। এমনটাই বলা স্বাভাবিক-হ্যাঁ, মাহরীনদের মতো কিছু মানুষ বেঁচে আছে বলেই সমাজ টিকে আছে। বার বার হোঁচট খাওয়া মানুষগুলোও বাঁচার সংগ্রামে লড়াই করতে পারে। মানবতার দুর্ভিক্ষ থাকলেও অবশিষ্ট কিছু আছে, নিঃশেষ হয়ে যায়নি পুরোপুরি।
মাহরীনকে আমরা স্মরণ করবো তার সাহসিকতার জন্য, একজন সুশিক্ষক, অভিভাবক হিসেবে। আর আমাদের সন্তানেরাও যেন মাহরীনের কীর্তি দেখে বুঝতে পারে, একজন শিক্ষকের জীবনটাও শিক্ষার্থীদের প্রতি নিবেদিত। তারা যেন যোগ্য সম্মানটুকু পান।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশংসায় ভাসছেন এই শিক্ষিকা, দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও তাঁর মহান আত্মত্যাগের কথা স্বীকৃত হয়েছে। প্রমাণ পাওয়া যায়, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর তাঁর বীরত্বসূচক কর্মকাণ্ডের প্রশংসা করার মধ্য দিয়ে।একজন শিক্ষিকা মাহরীনকে নিয়ে যখন আমরা গর্ববোধ করি, মনের অজান্তেই শিক্ষকের মর্যাদা এবং আমাদের বর্তমান সমাজচিত্র ফুটে আসে চোখের সামনে।
এই যে হাজার হাজার ফেসবুক ব্যবহারকারী মানুষ-তাকে প্রশংসা করছেন,তাদেরই কেউ কেউ এমন শিক্ষককে এই দেশেই কী নির্যাতনই না করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই সেই চিত্র বিশ্বব্যাপী মানুষ দেখেছে, একজন শিক্ষককে হয়তো জুতোপেটা করা হচ্ছে,গাছের সঙ্গে বেধে পেটানো হচ্ছে, কিংবা জোরপূর্বক পদত্যাগপত্রে সই করাচ্ছে। হুমকি-ধমকসহ নানা নির্যাতনের উদাহরণতো হাজার হাজার।
সেই শিক্ষকদের অনুভূতি কেমন খুব জানতে ইচ্ছা হলো। সেই সুবাদেই সম্মানীয় একজন শিক্ষক কুমিল্লা জেলার মাধবপুর আবু জাহের কলেজের অধ্যক্ষ সৈয়দ আব্দুল কাইউম এর সঙ্গে কথা বলি। কয়েক মাস আগে তাকেও বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছিলো মবশিক্ষার্থীদের কাছে। এইচএসসি পরীক্ষার আগে টেস্ট পরীক্ষায় তার কলেজের যে-সব শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছিল, তারা মব সৃষ্টি করে দাবি জানায়,তাদের বোর্ড ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দিতে হবে।
তিনি সিদ্ধান্তে অনড়। যারা ফেল করেছে তারা এইচএসসি বোর্ড ফাইনাল পরীক্ষার সুযোগ পায়নি। তবে তাকে খেসারত দিতে হয়েছে। তার রুমসহ কলেজে ভাঙচুর চালিয়েছে সেই কলেজেরই শিক্ষার্থীরা। কলেজের পানির পাম্পের মটর লুট করে নিয়ে গেছে সেই কলেজের শিক্ষার্থীরা, বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে,জানালার কাচ টুকরো টুকরো করে দিয়েছে বিক্ষোভকারী কিছু ছেলে। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষিকা মাহরীন সম্পর্কে তাঁর অভিমত জানার খুবই ইচ্ছা হচ্ছিল।
তাঁর কথা, শিক্ষক শুধু পাঠদানই করেন না। প্রতিটি শিক্ষার্থীর অভিভাবকও তিনি। তাদের সামনে আগামীর দেশ। দেশের কারিগরদের যেমন হাতেকলমে তারা তৈরি করেন, একইভাবে তারা বাবা-মায়ের জায়গাতেও চলে যান। এটাই প্রমাণ করেছেন মাহরীন। প্রতিটি প্রকৃত শিক্ষকই একেকজন মাহরীন। তবে আশঙ্কার কথা-ব্যতিক্রমছাড়া একটা জেনারেশন এমন মাহরীনদের অপমান করাকে গৌরবের মনে করছে। তাদের এই মবরাজনীতির কারণে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে তা দেশের জন্য মোটেও মঙ্গলজনক নয়।
গুরুগম্ভীর কোনো আলোচনা না করে আলাপচারিতাকেই এই নিবন্ধে আনার চেষ্টা করি। শিক্ষিকা মাহরীন, মবসংস্কৃতি ও প্রাসঙ্গিক বিষয় আলোচনাতেই এসে গেছে শিক্ষকদের মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়েও। জবাব ছিল তার-সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, যে-সব শিক্ষককে পদত্যাগ করানো হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ হলে তাদের যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে নিজ নিজ অবস্থানে ফিরিয়ে আনা হবে। অত্যন্ত লজ্জাজনক সিদ্ধান্ত এটা।
মবসংস্কৃতিতে একজন শিক্ষক চাকরি হারানোকে প্রকারান্তরে উৎসাহিত করেছে সরকার। অন্তত সরকারের এহেন বক্তব্য থেকে তাই প্রমাণ হয়। অথচ বিনা বিচারে এবং বিনা অধিকারে আইন অমান্য করেছে এসব ছোকরাগুলো। তাদের বিষয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো বলে দেওয়া হলো অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ হওয়া সাপেক্ষে।
অথচ অধিকাংশ শিক্ষকই মা ও বাবার দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষকের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই যে তেমনটা। প্রত্যেক অভিভাবক তার সন্তানকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন সেই কারণেই। ব্যতিক্রম ছাড়া শিক্ষকদের এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই শিক্ষা ব্যবস্থা এখনও সচল। মাহরীন তেমনি একজন শিক্ষক। যাদের নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। যাদের হাতে আমাদের সন্তানদের ছেড়ে দিয়ে নিরাপদ বোধ করতে পারি। মাহরীনকে আমরা স্মরণ করবো তার সাহসিকতার জন্য, একজন সুশিক্ষক, অভিভাবক হিসেবে। আর আমাদের সন্তানেরাও যেন মাহরীনের কীর্তি দেখে বুঝতে পারে, একজন শিক্ষকের জীবনটাও শিক্ষার্থীদের প্রতি নিবেদিত। তারা যেন যোগ্য সম্মানটুকু পান।
লেখক : সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।
এইচআর/জেআইএম