আবু জাহলের প্রকৃত নাম ছিল আমর ইবনে হিশাম। ইসলামপূর্ব জাহেলি যুগে প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার কারণে অনেকে তার উপাধি দিয়েছিল আবুল হাকাম অর্থাৎ হেকমত বা প্রজ্ঞার পিতা। পরবর্তীতে নবিজির (সা.) নবুয়্যত লাভের পর ইসলাম প্রচারে বাঁধা, মুসলমানদের ওপর নির্যাতন ও শত্রুতায় তিনি যখন নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, তখন নবিজি (সা.) তার উপাধি দেন আবু জাহল অর্থাৎ মূর্খতার পিতা।
নবিজি (সা.) যখন নবুয়্যত লাভ করেন, তখন আবু জাহল ছিলেন কোরায়শের শাখা গোত্র বনু মাখজুমের নেতা এবং কোরায়শের বড় সর্দারদের অন্যতম। নবিজির (সা.) নবুয়্যতের দাবিকে তিনি তার নেতৃত্বের জন্য হুমকি বিবেচনা করতেন। তিনি মনে করতেন, বনু হাশেমের একজন ব্যক্তিকে নবি হিসেবে মেনে নিলে তাকেই নেতা মেনে নিতে হবে এবং বনু হাশেমের ক্ষমতা বেড়ে যাবে, তার এবং তার গোত্র বনু মাখজুমের ক্ষমতা খর্ব হবে।
আবু জাহল বিভিন্নভাবে ইসলামের প্রচার প্রসারে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করেন। তার গোত্রের যারা ইসলাম গ্রহণ করতো, তাদেরকে তিনি বন্দী করতেন, তাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালাতেন। দাসশ্রেণীর যারা ইসলাম গ্রহণ করতো, তাদের ওপরও অকথ্য নির্যাতন চালাতেন। ইসলামের প্রথম শহীদ হজরত সুমাইয়াকে (রা.) ইসলাম গ্রহণ করার কারণে আবু জাহলই হত্যা করেছিলেন।
নবিজিকেও (সা.) আবু জাহল বিভিন্নভাবে কষ্ট দিয়েছেন। নবিজি (সা.) কাবার আশেপাশে নামাজে দাঁড়ালে আবু জাহল তাকে নামাজ পড়তেও বাঁধা দিতেন। কোরআনে আবু জাহলের নামাজে বাঁধা দেওয়ার কথা উল্লেখ করে আল্লাহ তাআলা তাকে কঠোর শাস্তি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন, মানুষ তো সীমালঙ্ঘন করে কারণ সে নিজেকে ভাবে অভাবমুক্ত। নিশ্চই তোমার রবের কাছে প্রত্যাবর্তন সুনিশ্চিত। তুমি কি দেখেছো সেই ব্যক্তিকে যে এক বান্দাকে নিষেধ করে যখন সে নামাজ পড়ে। ভাবো, যদি সে সঠিক পথে থাকে! অথবা খোদাভীতি শিক্ষা দেয়! যদি সে মিথ্যারোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়। সে কি জানে না, আল্লাহ দেখছেন? কখনোই নয়, যদি সে বিরত না হয়, তবে আমি মাথার সামনের কেশগুচ্ছ ধরে হেঁচড়াবোই। সেই কপালের চুল যে মিথ্যুক ও কঠিন অপরাধী। সে তার সমর্থক দলকে ডেকে নিক আমি ডেকে নিই আজাবের ফেরেশতাদের। কিছুতেই তার কথা মেনে নিয়ো না, তুমি সিজদা করো এবং তোমার রবের নৈকট্য অর্জন করো। (সুরা আলাক: ৬-১৯)
মুফাসসিরগণের মতে এ আয়াতগুলো আবু জাহলের ব্যাপারেই অবতীর্ণ হয়েছিল।
নবিজির (সা.) হিজরতের আগে তাকে হত্যার পরিকল্পনায় প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন আবু জাহল। নবিজির হিজরতের পর মক্কার মুশরিকদের বদর যুদ্ধে যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ ও প্রস্তুত করার ব্যাপারেও প্রধান ভূমিকা পালন করেন আবু জাহল।
ছবি: সংগৃহীত
বর্ণিত রয়েছে, বদর যুদ্ধের জন্য মক্কা ছেড়ে বের হওয়ার আগে মক্কার মুশরিকদের নিয়ে আবু জাহল কাবায় যান এবং কাবার গিলাফ ধরে কেঁদে কেঁদে দোয়া করেন, হে আল্লাহ! আপনি সাহায্য করুন আমাদের মধ্যকার সর্বাধিক অতিথি আপ্যায়নকারী, সর্বাধিক আত্মীয়তা রক্ষাকারী ও বন্দী মুক্তি দানকারী দলকে। হে আল্লাহ! মুহাম্মাদ যদি সত্যের ওপরে থাকে, তবে আপনি তাকে সাহায্য করুন আর যদি আমরা সত্যের উপর থাকি, তবে আমাদেরকে সাহায্য করুন। আরেকটি বর্ণনায় এসেছে, তিনি দোয়া করেছিলেন, হে আল্লাহ! আপনি সাহায্য করুন আমাদের দুই দলের মধ্যকার সেরা সেনাদলকে, সেরা হেদায়াতপ্রাপ্ত ও সেরা সম্মানিত দলকে। (তাফসিরে কাশশাফ, ইবনে কাসির)
আবু জাহলের এই দোয়া আল্লাহ তাআলা কবুল করেন। বদরের যুদ্ধে মক্কার মুশরিকরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। মুশরিকদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরাসহ ৭০ জন সৈন্য নিহত হয়, ৭০ জন বন্দী হয়।
আবু জাহল নিজেও নিহত হন। তিনি নিহত হন হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদের (রা.) হাতে যার ওপর মক্কায় তিনি নানাভাবে নির্যাতন চালিয়েছিলেন।
মুশরিকদের নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে আরও নিহত হন উতবা ইবনে রাবিআ, উমাইয়া ইবনে খালাফ, শায়বা ইবনে রাবিআ, ওয়ালিদ ইবনে উতবা প্রমুখ। বন্দীদের মধ্যে ছিলেন উকবা ইবনে আবু মুঈত, সুহাইল ইবনে আমর, আবুল আস প্রমুখ।
আবু জাহলের উল্লিখিত দোয়ার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে কোরআনের সুরা আনফালের ১৯ নং আয়াতে। আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমরা ফয়সালা চাচ্ছিলে, ফয়সালা তো তোমাদের কাছে এসে গেছে। যদি তোমরা অন্যায় থেকে বিরত হও, তবে তা তোমাদের জন্যই কল্যাণকর। তোমরা যদি আবার অন্যায় কর, আমিও আবার শাস্তি দেব। তোমাদের বাহিনী সংখ্যায় অধিক হলেও তোমাদের কোনো উপকারে আসবে না এবং আল্লাহ তো মুমিনদের সঙ্গে আছেন। (সুরা আনফাল: ১৯)
ওএফএফ/জিকেএস