সাহিত্য

দুয়েকটা খাসা প্রেমপত্র লিখতে পারি না এবং অন্যান্য

দুয়েকটা খাসা প্রেমপত্র লিখতে পারি না

প্রিয়তমা, আজ আমি এক বন্দি পাখি,নিসর্গের সাথে যার অরণ্য-নিবিড় সম্পর্ক নেই...

কী করে আজ লিখবো বলোচপলা-চঞ্চলা মেঘবালিকাদের কথা?শেষ শ্রাবণে যারা সুখের স্নান দিয়েছিল বৃষ্টিজলেঅতিক্রান্ত এক শুভ্র শরতের পরতাদের সাথে আমার ক্ষণকালেরও দেখা নেই।

কী করে লিখবো বলোঘুম ভাঙানো ভোরের পাখির গানের লিরিক?দেওয়ালের এপারে আজ কােনো গানের পাখি নেই,আলো-আঁধারির মাঝেকিছু কীটপতঙ্গ কেবল নৈঃশব্দে বেঁচে আছে,তাদের বুকে দূরত্ব প্রশমনের গান নেইকিংবা গানের ভেতর কোকিলের পলাশ-বসন্ত নেই।

কী করে আজ লিখবো বলোউদ্যানের শুচিস্মিতা ফুলগুলোর কথা?তাদের নির্মল হাসিকেমন করে আকৃষ্ট করে রঙিন প্রজাপতিদের,মোহনীয় সৌরভ কেমন করে নেশাগ্রস্ত করে তোলেপথচারী মৌমাছিদের।আমি আজ পথ চলতে পারি না, প্রেমাসক্ত হয়েশরীরে মাখতে পারি না সুতপ্ত সুরভী।

বালিকাদের চোখের ভেতর নেশা হয়ে ডুবে থাকেপৃথিবীর সকল প্রেমাকাঙ্ক্ষা, নিসর্গের সেইসব সুশৃঙ্খল সুকেশিনী কন্যাদের সাথেআমার দেখা হয় না বহুদিন।চোখে চোখ রাখা হয় না ফুল, পাখি ও প্রকৃতির।বুকের ভেতরে তাই প্রেম নেই আজকাল,আজকাল লিখতে পারি না দুয়েকটা খাসা প্রেমপত্র।

****

আমারও মনে পড়ে

রাত যখন এগারোটা বেজে তেত্রিশ মিনিটতখন নিস্তব্ধ রাতের ভেতর বিষণ্ন দেওয়ালঘড়িরটিকটিক শব্দ শোনা যায়;ঠিক বারোটায় মিলিত হবে ঘণ্টা ও মিনিটের কাঁটাদিবসের পুনরুত্থান ঘটবে নিশ্চয়ই অন্ধকারেসে অপেক্ষার পরিধিজুড়ে হাঁটতে হাঁটতেকাঁটাগুলো ক্লান্ত হয়ে পড়ে—আমিও সারাদিনের ক্লান্তি ঝেরে বিছানায় যাবো,হ্যাঁ ঠিক সেসময়,ঠিক সেসময়ে আমারও মনে পড়ে দুধমাখা ভাতের কথাচোখের অশ্রু মোছা নরম হাত ও কোমল আঁচলের কথা।দীর্ঘশ্বাস অনুভব করে বুকের দেওয়াল,টিকটিক শব্দে সায় দেয় একটা রাতজাগা টিকটিকিতার রক্তের মতো আমার শিরার ভেতর বোধ হয়রূপান্তরিত লোহিত রক্তের সফেন সাদা সমুদ্র।আমি শ্বাসরুদ্ধ হই, শিথীল হয়ে পড়ে আমার সারাদেহ।

আমারও মনে পড়ে পুরোনো সাইকেলের টুংটাং আহ্বানহ্যাঁ বোধক সকল সরল স্বীকারোক্তি ও প্যাঁচানো ব্যঞ্জনবর্ণের কথাযে কোনো ক্ষতচিহ্ন ঘঁষতে ঘঁষতে মুছে ফেলার কথাএখন চাইলেই মুছে ফেলা যায় না বলপেনের দুঃখ,মুছতে গেলেই স্পষ্ট হয় ব্যথা,এমনকি নষ্ট হয় একটা সাদা কাগজের সুন্দর জীবন।

আমারও মনে পড়ে ঝুম বাদলের দিনে মা-পাখিটার ডানার ভেতর নিশ্চুপ লুকিয়ে থাকা কোমল উষ্ণতার কথা—মনে পড়ে রৌদ্রোজ্জ্বল দুপুরবেলা বাজারে বটবৃক্ষের শীতল ছায়া মাখে পাড়ার কৃষক,গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলে তন্বী নদী।ডিঙি নৌকার বৈঠা ধরে কিশোর ছুটে চলে নানার বাড়িচাইলেই আমি আজ লাফিয়ে পড়তে পারি না শৈশবের সেই নোনাঘাম মাখা নদীর জলে,কাটতে পারি না চিত-সাঁতার, মনে পড়েমাচায় লকলক করে বেড়ে ওঠা কুমড়ো লতার কথা।মনে পড়ে অনন্ত আকাশের মেঘে হারিয়ে যাওয়াশৈশবের পলিথিন ঘুড়িমাথা ঘোরাতে ঘোরাতে নিচে নেমে আসা রেইনট্রির শুকনো পাতা।পড়শির ষোড়শী মুখের চাপা হাসি আমার খুব মনে পড়েমনে পড়ে তার নিঃশব্দ অভিমান, গোলগাল মুখ।মনে পড়ে কাঁচের চিমনির ভেতর জমে থাকা কালো ধোঁয়াপৃথিবীর সব আলো নিভে গেলে ঝরের দিনকেরোসিন কুপির নিদালি আলোর নিবু নিবু ভাব।

এসইউ/এমএস